সুদে মানুষের অন্তর্নিহিত মমতা শুকিয়ে যায়!

মানুষের স্বভাবজাত বাসনা, সে নিজে যে সম্মান ও সুখ স্বাচ্ছন্দ অর্জন করেছে-তার সন্তানেরাও তা করুক। প্রকৃত প্রস্তাবে আরাম ও শান্তি বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না, অর্ডার মাফিক বানানোও যায় না। বস্তুত, এটা আল্লাহর একটি অশেষ রহমত।

একটি সুখনিদ্রার কথাই ধরা যাক, পাশ্চাত্য দুনিয়ায় এমনকি আমাদের দেশেও এক বিপুল অংশ মানুষ ঘুমের বড়ি না খেয়ে বিছানায় যেতেই পারে না। অনেকে এমন আছেন, ঋণেরভারে জর্জরিত হয়ে বা এ থেকে উদ্ভূতজাত সমূহ সমস্যায়, কোনো মূল্যেই ঘুম কিনে আনতে পারে না। অপরাপর আরাম ও সুখের অবস্থাও তদ্রূপ। যেমন হারাম ঘোষণা করে সুদ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতেই শুধু নয়, আইন হিসেবেও জারি করেছিলেন। খলিফাতুল মুসলেমীন-ফারুকে আযম-হযরত ওমর রাযি ওয়াল্লাহু আনহু যখন গোটা দুনিয়ায় অর্ধেকেরও বেশি অঞ্চলজুড়ে ইসলামি হুকমত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তখনও সুদ ও ব্যবসার প্রকৃত ব্যাখ্যা নির্ধারণে নানাপ্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলেন। এ অবস্থায় তিনি যে উক্তি করেছিলেন, তা প্রণিধানযোগ্য।

ওমর (রা.) বলেন, ‘সুদের আয়াত হচ্ছে কুরআন পাকের সর্বশেষ আয়াতগুলোর অন্যতম। যার সম্পূর্ণ বিবরণদান করার আগেই খাতিমুল আম্বিয়া আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়া থেকে বিদায় নেন। তাই খুবই সর্তক পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। সুদতো বটেই তদুপরি যেসব ব্যাপারে সুদের সন্দেহ হয়, সেগুলোকেও পরিহার করা উচিত।

 

উপমহাদেশে হাদিসশাস্র আনয়নকারী মুজাদ্দিদ হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.) “হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ” গ্রন্থে সুদকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন। প্রকৃত তথা সরাসরি সুদ এবং পরোক্ষ তথা নির্দেশগত সুদ। বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় দ্বিতীয় প্রকার সুদ (যা ক্রয় বিক্রয়ের মাধ্যমে হয়) এর ব্যাপক প্রচলন নেই।

মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক আর্থসামাজিক ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করে চলমান পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থায় প্রচলিত যে সুদকে প্রধান নিয়ামক চালিকাশক্তি হিসেবে ধরা হয়, সে সুদের অবৈধতা সাতটি আয়াত, চল্লিশটিরও বেশি হাদিস এবং ইজমা দ্বারা প্রমাণিত।

প্রকৃত প্রস্তাবে সহীহ সুদ মুক্ত ব্যবস্থা তথা ইসলামি ব্যাংকিং সম্পূর্ণ কার্যকর করতে হলে তদনুযায়ী রাষ্ট্রীয় আইন সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রে চালু করতে হবে। এবং সর্বোপরি যার পরিপূরক হিসেবে পৃথিবীর ৫৭টি মুসলিম রাষ্ট্রেও অনুরূপ শরীয়াহর আইনগত কাঠামো চালু করা জরুরি। এই ব্যবস্থা চালু তথা প্রয়োগ করতে পারলে, উভয় গোলার্ধে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত সর্বত্র ইসলামি ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা সত্যিকার অর্থে বেগবান হবে।

সহীহ আবু দাউদ শরীফে হযরত আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, এমন এক সময় আসবে যখন এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে সুদী চক্রের সাথে কোনো না কোনোভাবে জড়িত থাকবে না। আত্মরক্ষা করতে চাওয়া কারো পক্ষে এ থেকে বেঁচে থাকা হবে এক অসম্ভব ব্যাপার।

নবীজী (সা.) হুঁশিয়ারিতে বর্ণিত সেই যুগেই বর্তমানে আমরা প্রবেশ করেছি। “আহাল্লাল্লাহুল বাই’আ ওয়া হাররামার রিবা” (আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল ও সুদকে হারাম করেছেন)। সুদী ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত কদর্যতায় মানুষের অন্তরের মমতা শুকিয়ে যায়। চক্রবৃদ্ধির শোষণমূলক চক্ররে পড়ে মানুষ নিঃশেষ হয়ে যায়। শয়তানের স্পর্শে মোহাবিষ্ট হয়ে, লালসার এক বিরামহীন প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতায় আরেক শ্রেণির মানুষ মরণাতক গাফেল থাকে। এ অবস্থায় কবরের মাটি ছাড়া অন্যকিছু দিয়ে ঐসব অতৃপ্ত মানুষের মুখ ভর্তি করা সম্ভব হয় না। অষ্টম হিজরিতে অবতীর্ণ সূরা বাকারার ছয়টি আয়াতে রিবা অর্ণব সুদ সম্পর্কিত শরীয়তী দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণিত হয়েছে। হযরত মুসা (আ.) পবিত্র তাওয়াতে সুদকে হারাম ঘোষণা করেছেন। প্রকৃত প্রস্তাবে সুদ ছাড়াও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান সম্ভব একটি সুষম পীড়নহীন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

সুত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন