সুদের হার না কমিয়ে বাড়াল মুনাফা

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

দেশীয় শিল্প বিকাশ ও বিনিয়োগ বাড়াতে সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছিল সরকারি-বেসরকারি সব বাণিজ্যিক ব্যাংক।

কিন্তু এটি সরকারি ব্যাংকগুলো কার্যকর করলেও অধিকাংশ বেসরকারি ব্যাংক তা কার্যকর করেনি। এতে সরকারি ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা কমলেও বেড়েছে বেসরকারি ব্যাংকের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক বাজারে দ্বৈত নিয়ম চলতে পারে না। সরকারি ব্যাংকের সঙ্গে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকেও সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে হবে। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত জনতা ব্যাংক পরিচালন মুনাফা করেছে ৩০০ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৪৪১ কোটি টাকা।

জানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. আবদুছ ছালাম আজাদ বলেন, সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণ দেয়ার কারণে শুধু চট্টগ্রামের একটি শাখায় গত ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা কমেছে ৬০ লাখ টাকা। এভাবে সব শাখার একই অবস্থা।

তবুও সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা মানতে পেরেছি, এতেই আমরা আনন্দিত। তিনি বলেন, সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংকের ক্ষেত্রে সিঙ্গেল ডিজিট কার্যকর হওয়া উচিত। তা না হলে বাজারে একধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।

চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে অগ্রণী ব্যাংক পরিচালন মুনাফা করেছে ৩১০ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৪০০ কোটি টাকা।

জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ শামস উল ইসলাম বলেন, সরকারের নির্দেশনা মেনে সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণ দিয়েছি।

এতে সাময়িক পরিচালন মুনাফা কিছুটা কম হলেও দীর্ঘমেয়াদে দেশের উপকার হয়েছে। স্বল্পসুদে দেয়া ঋণ দেশের শিল্পায়ন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে কাজে লেগেছে। তিনি বলেন, আমাদের অতিমুনাফার লক্ষ্য কখনও ছিল না, এখনও নেই। স্বল্পসুদে ঋণ দিয়ে কম লাভ করে দেশ এবং দেশের মানুষের সেবা করে যেতে চাই।

রূপালী ব্যাংক গত ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা করেছে ৭৮ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৯৪ কোটি টাকা।

জানতে চাইলে রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. আতাউর রহমান প্রধান বলেন, পরিচালন মুনাফা কিছুটা কমেছে। তবে তৃপ্তির বিষয় হল- প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণ দিয়ে জনগণের সেবা করতে পেরেছি। কখনও বেশি মুনাফার চিন্তা করিনি।

তিনি বলেন, পরিচালন মুনাফা কিছুটা কমলেও অন্যান্য সূচকে রূপালী ব্যাংক ভালো করেছে। লোকসানি শাখার সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। আগে ২৭টি ছিল। এখন লোকসানি শাখা ১৬টিতে নামিয়ে এনেছি।

এছাড়া গত ছয় মাসে বেসিক ব্যাংক পরিচালন মুনাফা করতে পারেনি। উল্টো আরও ১৬৪ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। ব্যাংকটির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা  বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আমরা ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে এনেছি। আমানতের সুদহারও ছিল ৬ শতাংশ। কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকগুলো এ নির্দেশনা মানেনি।

এ কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা কমলেও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বেড়েছে। স্বল্পসুদে আমানত সংগ্রহ করে ওই ব্যাংকগুলো বেশি সুদে বিনিয়োগ করেছে।

এদিকে বেসরকারি ৪০টি ব্যাংকের কয়েকটি ছাড়া বাকি সব ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। একটি ব্যাংক প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত পরিচালন মুনাফা করেছে। এছাড়া অন্য ব্যাংকগুলো ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পরিচালন মুনাফা করেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আনিস এ খান বলেন, সুদের হার বড় কারণ নয়। বিনিয়োগের আকার বাড়ায় পরিচালন মুনাফা বেড়েছে।

পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল হালিম চৌধুরী বলেন, সরকারি ব্যাংকের মুনাফা কমার ক্ষেত্রে সিঙ্গেল ডিজিটের পাশাপাশি খেলাপি ঋণও একটি বড় কারণ। এত বেশি খেলাপি ঋণ বেসরকারি ব্যাংকে নেই। তাই আমাদের মুনাফা বেশি হয়েছে।

ব্যাংকাররা জানান, ব্যাংকগুলোর আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে ঋণের বিপরীতে সুদ এবং বিভিন্ন কমিশন ও চার্জ। একসময় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ থেকে আয়ের বড় একটি অংশ এলেও এখন সে পরিস্থিতি নেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা  বলেন, ঋণের সুদ সিঙ্গেল ডিজিটে না নামানোর অনেক কারণের মধ্যে একটি বড় কারণ বেসরকারি ব্যাংকের অতিমুনাফার মানসিকতা। তিনি বলেন, বেসরকারি খাতের এমনও অনেক ব্যাংকের মালিক আছেন, যারা বছর শেষে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ লভ্যাংশ নেন।

এছাড়া ১৫, ২০ ও ২৫ শতাংশ লভ্যাংশ তো প্রায় সব ব্যাংক দিয়ে থাকে। পৃথিবীর কোথাও এত বেশি লভ্যাংশ নিতে দেখা যায় না। তাই বিদেশে ব্যাংক ঋণে সুদের হারও কম।

প্রসঙ্গত, গত বছরের বাজেট ঘোষণার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির সাবেক সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ।

পরে তিনি সুদের হার কমানোর বিষয়ে উদ্যোগ নেন। এ লক্ষ্যে গত বছরের ২০ জুন এক বৈঠক থেকে ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেয় বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)।

তখন সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, ১ জুলাই থেকে ঋণের সুদ হবে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ এবং ছয় মাস মেয়াদি আমানতের সুদ হবে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ। একই ঘোষণা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোও দিয়েছে।

এটি পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় গত বছরের ২ আগস্ট আবার তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বৈঠক ডাকেন। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষের ওই বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থ সচিব, সব ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং এমডির উপস্থিতিতে সাবেক অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আজ প্রধানমন্ত্রী আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ এবং ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ কার্যকরের নির্দেশ দিয়েছেন। তবে এটা ৯ আগস্ট থেকে সব ব্যাংকে কার্যকর করতে হবে।’ এরপর থেকে কেবল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণ দিলেও অধিকাংশ বেসরকারি ব্যাংক তা কার্যকর করেনি। বর্তমানে বেসরকারি ব্যাংকে ঋণের সুদ ১৩-১৪ শতাংশে পৌঁছে গেছে।