সিডন্স, না হাতুরাসিংহে?

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

বয়েজ লাভ মি আ লট’—ট্রেভর চ্যাপেলের আপাত প্রাণহীন অভিব্যক্তিতে আবেগের ঢেউ।

২০০২ সালের জাতীয় লিগের একটি ম্যাচ চলছিল তখন বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। সে ম্যাচে জাতীয় দলের তৎকালীন অধিনায়ক খালেদ মাসুদ ডাবল সেঞ্চুরির অপেক্ষায় ব্যাটিংয়ে। বিকেলের দিকে বিদায়ি কোচ চ্যাপেল এসেছিলেন শিষ্যদের কাছ থেকে বিদায় নিতে। এ অস্ট্রেলীয় নিশ্চিত ছিলেন, শিষ্যরা হয়তো গভীর বেদনায় কান্নাকাটি করবে। হায়, তিনি যদি ঘুণাক্ষরেও টের পেতেন এমন একটি দিনের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষায় ছিলেন জাতীয় দলের প্রায় সবাই।

সেই আয়ারল্যান্ড সফর থেকেই বোঝা যাচ্ছিল বাংলাদেশ দলের বর্তমান কোচ স্টিভ রোডসের ভাগ্যেও ওরকম একটা দিন অত্যাসন্ন। বোর্ড কর্মকর্তা এবং খেলোয়াড় মিলে সর্বদলীয় রোডসবিরোধী জোট গঠন হয়ে গেছে। এখন শুধু এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দেওয়া বাকি। বিশ্বকাপের ‘ঝামেলা’ না থাকলে তো কবেই পথ দেখিয়ে দেওয়া হতো রোডসকে। পেছনে এত আয়োজন হচ্ছে, অথচ কোচ নাকি কিছুই জানেন না। দিন কয়েক আগে জাতীয় দলের এক সিনিয়র ক্রিকেটার বলছিলেন, ‘কোচ এসবের কিছুই জানে না।’ ট্রেভর চ্যাপেল যেমন জানতে পারেননি তাঁর শিষ্যদের মনের কথা।

যাঁরা জানেন, তাঁরা কয়েক দফা সভাও করে ফেলেছেন। স্টিভ রোডসকে সরানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত একরকম নিয়েই ফেলেছে বিসিবি। তবে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের যুগে ভালো কোচ পাওয়া দুষ্কর। তাই আগে নতুন কাউকে খুঁজে এরপর স্টিভ রোডসকে ইংল্যান্ডে ফেরত পাঠানোর পক্ষে বিসিবি। সম্ভাব্য নতুন কোচের খোঁজে নিউজিল্যান্ড সফরেই নাকি বিসিবির কয়েকজন ঊর্ধ্বতন বসেছিলেন সিনিয়র ক্রিকেটারদের সঙ্গে। নতুন কোচ বাজারে নেই, তাই পুরনো দুজনের নাম আপাতত আছে আলোচনার টেবিলে—জেমি সিডন্স ও চন্দিকা হাতুরাসিংহে। খেলোয়াড়দের ভোটাভুটিতে এগিয়ে সিডন্স। তবে নীতিনির্ধারকদের প্রিয়পাত্র হাতুরাসিংহে।

অস্ট্রেলিয়ার রাজ্য দল সাউথ অস্ট্রেলিয়া রেডবাকসকে কোচিং করাচ্ছেন বাংলাদেশের কোচ পদে ডেভ হোয়াটমোরের উত্তরাধিকার জেমি সিডন্স। আর হাতুরার বর্তমান চাকরির ঠিকানা তো সবাই-ই জানেন, শ্রীলঙ্কার হেড কোচ তিনি। বিশ্বস্ত সূত্রের খবর, দুজনের সঙ্গে পরোক্ষে যোগাযোগও শুরু করা হয়েছে বিসিবির তরফ থেকে। বাংলাদেশের হেড কোচ পদে ফিরতে বরাবরই আগ্রহী জেমি। তবে হাতুরাসিংহে নাকি একটু ইতস্তত করছেন। বিদায়বেলায় দলের সিনিয়র ক্রিকেটারদের সঙ্গে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, সেটি নিয়ে নাকি দ্বিধান্বিত তিনি। কার্ডিফে বিশ্বকাপ প্রস্তুতি ম্যাচের সময় বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা দলের টিম হোটেলের দূরত্ব ছিল রাস্তার এপার-ওপার। সেখানেই বেসরকারিভাবে হাতুরাকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। দ্বিধার কথা বললেও তিনি নাকি নিমরাজি।

অথচ ইংল্যান্ড বিশ্বকাপকে মাথায় রেখে ইংরেজ কোচ রোডসকে নিয়োগ দিয়েছিল বিসিবি। বিশ্বকাপের মাঠে অবশ্য তাঁর কোনো ইনপুটই সেভাবে কাজে লাগেনি। অবশ্য দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম পরিচয়েই রোডস ‘ফেল’ করে গিয়েছিলেন। সেদিনের সভা থেকে বেরিয়ে জাতীয় দলের এক সিনিয়র ক্রিকেটারের মন্তব্য ছিল, ‘এই লোক এখানে বেশি দিন টিকতে পারবে না।’ বিস্তারিত ব্যাখ্যায় বলেছিলেন, ‘ওল্ড স্কুল অব থটসের লোক তিনি।’ মানে মান্ধাতার আমলের চিন্তাভাবনা রোডসের।

এরপর প্রথম অ্যাসাইনমেন্টেই রোডস ‘উন্মুক্ত’ হয়ে যান বোর্ড পরিচালকদের কাছে। গত বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজে টেস্ট ভরাডুবির পর তিনি এমন একটি ই-মেইল করেছিলেন, যা পড়ে বিস্মিত এক বোর্ড কর্মকর্তা, ‘কোনো কোচ এ রকম মেইল করতে পারে, ভাবা যায় না!’ সেই থেকে বোর্ড কর্তা থেকে শুরু করে জাতীয় দলের ক্ষমতার বলয়ে কোনো কদর নেই রোডসের। অসম্ভব ভদ্রলোক, কিন্তু কাজের লোক নন—তাঁর সম্পর্কে এটাই সর্বজনীন ধারণা। রোডসের অতি ঘনিষ্ঠ এক ক্রিকেটারের মন্তব্য, ‘তিনি সাধারণত কোনো সিদ্ধান্ত দেন না। তবে যে দু-একটা এ পর্যন্ত দিয়েছেন, তার সবগুলোই আবার ভুল ছিল!’

তাতে ২০২০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পর্যন্ত চুক্তিবদ্ধ রোডসের জাতীয় দলে এখনকার অবস্থান অনেকটা ‘রিজার্ভ প্লেয়ার’-এর মতো। তিনি এমনিতেই টিম মিটিংয়ে স্বল্পবাক। যাও বা দু-একটা কথা বলেন, কেউ নাকি পাত্তাটাত্তা দেয় না! অবশ্য রোডস একা নন, বাংলাদেশ দলের কোচিং স্টাফদের প্রায় সবাই-ই এখন খেলোয়াড়দের মন জুগিয়ে চলেন। গ্রেড অনুযায়ী একেক খেলোয়াড় একেক রকম গুরুত্ব পান।

জেমি সিডন্স কিংবা চন্দিকা হাতুরাসিংহের সময় এমনটা ছিল না। বিশেষ করে হাতুরাসিংহের জমানায় তো নয়ই। শুনেই সেদিন তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন দল পরিচালনার সঙ্গে জড়িত একজন, ‘আপনারা অর্ধেকটা জানেন। হাতুরাসিংহেরও পছন্দ-অপছন্দ ছিল। দু-একজনকে শাস্তি দিলেই হয় না।’ আর পক্ষপাতের কারণে চাকরি-জীবনেই বিস্তর সমালোচিত হয়েছিলেন জেমি। তাই এঁরাও একেবারে ‘সজ্জন’ নন!

পছন্দ-অপছন্দ ছাড়া কি মানুষ আছে নাকি? নাকি, সবাইকে সমান চোখে দেখা কারো পক্ষে সম্ভব? তাই ব্যক্তিগত ওই ত্রুটি এড়িয়ে গিয়ে জেমি বনাম হাতুরাসিংহেকে নিয়ে অঙ্ক করা হয়ে গেছে ক্রিকেটারদের। জেমির ঘোর অপছন্দের একজন এখন ‘পঞ্চপাণ্ডবে’র একজন। তিনি বলছিলেন, ‘আমার দেখা বাংলাদেশের সেরা কোচ। মুখের ওপর সব বলে দিতেন। আর উনার ক্রিকেট শেখানোর সামর্থ্য বাংলাদেশের ক্রিকেটকেই বদলে দিতে পারে।’ হাতুরাসিংহের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ ঘটানো আরেক ক্রিকেটার মনে করেন, ‘তিনিই আমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো। অসাধারণ স্ট্র্যাটেজিস্ট। উনার গেম রিডিং খুব ভালো। সবাই ভয়ও পায়। জাতীয় দলে তো আর নতুন করে ক্রিকেট শেখানোর কিছু নেই। শুধু প্ল্যানিংটা যেন ভালো হয়, সেটা দরকার। সে কাজে জেমির চেয়ে হাতু ভালো।’ তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে পঞ্চপাণ্ডবের ভোটাভুটিতে ৩-২ ব্যবধানে এগিয়ে জেমি।

অবশ্য এই ভোটের গুরুত্ব থাকলে তো রোডসের পরিবর্তে ফিল সিমন্সকেই দেখা যেত বাংলাদেশ দলের সঙ্গে। জেমিও তো খেলোয়াড়দেরই পক্ষ নেন, তার চেয়ে সব সময় ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করা হাতুরাসিংহেই ভালো— বিসিবির পরিচালনা পর্ষদের ভোট তাই যাবে শ্রীলঙ্কানের পক্ষে।

অবশ্য এখনো অনেক কিছুই ‘যদি’, ‘কিন্তু’র ওপর নির্ভর করছে। বললেই জেমি চলে আসবেন কিংবা হাতুরাসিংহে এরই মধ্যে টোপ গিলে ফেলেছেন বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। সে ক্ষেত্রে বিকল্প খুঁজতে গিয়ে আবার সংকটের মুখে পড়বে বিসিবি। তাই অন্তত জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে শুরু হওয়া শ্রীলঙ্কা সফরে সম্ভবত স্টিভ রোডসকেই কোচ পদে রেখে দিতে চায় বিসিবি।

‘ওদের দুজনের সঙ্গে এখনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়নি। তখন কি পরিস্থিতি হয়, আমরা কেউ জানি না। তাদের সঙ্গে আলোচনা থেমে গেলে যদি নতুন কোচ না পাওয়া যায়? বিশ্বকাপের পরপরই তো শ্রীলঙ্কা সফর আছে’—আলোচনার টেবিলে অস্থিরতা বিরাজ করলেও ভবিষ্যৎ চিন্তায় কিছুটা সতর্ক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিসিবি পরিচালক।