সিগারেটও বিক্রি করবে, ধূমপানজনিত রোগের ওষুধও বিক্রি করবে তামাক কোম্পানি

বিশ্বজুড়েই ধূমপায়ীর সংখ্যা কমে আসছে। সে কারণে সিগারেট কোম্পানিগুলোরও আগের সেই রমরমা নেই। এখন বেশি বিনিয়োগ হচ্ছে বৈদ্যুতিক সিগারেটে। কিন্তু কোনো বৃহৎ তামাক কোম্পানিই মার্লবোরো সিগারেট উৎপাদনকারী কোম্পানি ফিলিপ মরিস ইন্টারন্যাশনালের মতো এত মরিয়া হয়ে সম্পূর্ণ নতুন ব্যবসার ক্ষেত্র খুঁজতে নামেনি।

রুথ ট্যাল-সিঙ্গার দুই দশক ফুসফুসের রোগ সিওপিডি নিয়ে গবেষণা করছেন। সিওপিডি হয় ধূমপানের কারণে। অলাভজনক সিওপিডি ফাউন্ডেশনও চালান রুথ।

তাই এই গ্রীষ্মে যখন বিশ্বের বৃহত্তম তামাক কোম্পানি ফিলিপ মরিস ইন্টারন্যাশনাল সঙ্গে কাজ করার প্রস্তাব পান, রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

রুথ ট্যাল-সিঙ্গারকে কাজ করার প্রস্তাব দেওয়া তামাক কোম্পানিটির একটা বড় পরিকল্পনার অংশ। নিউ ইয়র্কভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি সিগারেট থেকে সরে নতুন ব্যবসায় প্রবেশ করতে চায়। প্রতিষ্ঠানটির ইচ্ছা, তারা ধোঁয়ামুক্ত পণ্য উৎপাদন করবে। ফিলিপ মরিস ইন্টারন্যাশনাল তাদের এই উদ্যোগের নাম দিয়েছে ‘বিয়ন্ড নিকোটিন’। ২০২৫ সালের মধ্যে এই নতুন ব্যবসা থেকে প্রতিষ্ঠানটি ১০০ কোটি ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে।

বিশ্বজুড়েই ধূমপায়ীর সংখ্যা কমে আসছে। সে কারণে সিগারেট কোম্পানিগুলোরও আগের সেই রমরমা নেই। এখন বেশি বিনিয়োগ হচ্ছে বৈদ্যুতিক সিগারেটে। কিন্তু কোনো বৃহৎ তামাক কোম্পানিই ফিলিপ মরিস ইন্টারন্যাশনালের মতো এত মরিয়া হয়ে সম্পূর্ণ নতুন ব্যবসার ক্ষেত্র খুঁজতে নামেনি।

তামাক কোম্পানিটি সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে বেশ কিছু ওষুধ-সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কিনে নিয়েছে। তাদের এ কর্মকাণ্ড বেশ সমালোচিত হয়েছে। কোম্পানিটির উদ্দেশ্য নিয়েও সন্দিহান ডাক্তার, বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।

বিজ্ঞানী ও ডাক্তাররা বলছেন, ফিলিপ মরিসের এই অধিগ্রহণ পীড়াদায়ক। কারণ অধিগ্রহণ করা কিছু প্রতিষ্ঠানগুলোর কয়েকটা ধূমপানজনিত রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ তৈরি করত।

ফিলিপ মরিসের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া ট্যাল-সিঙ্গার বলেছেন, ‘ব্যাপারটা এমন—আপনি কারও পা ভেঙে দিয়ে তার কাছে ক্রাচ বিক্রি করছেন।’

ইতিমধ্যে কিছু ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান কিনে নেওয়া ফিলিপ মরিস ইন্টারন্যাশনাল সামনে এরকম আরও কিছু প্রতিষ্ঠান কিনে নিচ্ছে বলে ঘোষণা দিয়েছে।

ফিলিপ মরিস ইন্টারন্যাশনাল আমেরিকা ছাড়া বাকি বিশ্বে সিগারেট বিক্রি করে। কোম্পানিটির সবচেয়ে বিখ্যাত সিগারেট ব্র্যান্ড ‘মার্লবোরো’।

সামনে ব্রিটিশ ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ভেকচুরা কিনে নেওয়ার জন্য আলোচনা করছে ফিলিপ মরিস ইন্টারন্যাশনাল। ভেকচুরা সিওপিডি ও অন্যান্য শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য ওষুধ বানায়। সিগারেট কোম্পানিটির ভেকচুরাকে কিনে নেওয়ার উদ্যোগটির বিরুদ্ধে বেশি প্রতিবাদ হচ্ছে। এই সেপ্টেম্বরেই ভেকচুরার পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানটি বিক্রির ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানো হবে।

ফিলিপ মরিস ইন্টারন্যাশনাল বলছে, নতুন কিনে নেওয়া কোম্পানিগুলো তাদের সিগারেট-ব্যবসার ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমাতে সাহায্য করবে। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহীরা আরও বলছেন, অ-তামাকজাত ওষুধ ও পণ্য উৎপাদনে আসার আগ্রহ থেকেই নতুন কোম্পানিগুলো কিনেছে তারা।

কিন্তু এসব আশ্বাস সত্ত্বেও সমালোচকদের সন্দেহ বিন্দুমাত্র কমছে না।

ফিলিপ মরিস ইন্টারন্যাশনাল ২০০৭ সাল থেকে ধীরে ধীরে সিগারেট ব্যবসা থেকে সরে আসছে। সে সময় প্রতিষ্ঠানটি ঘোষণা দিয়েছিল, তারা ধোয়াঁবিহীন তামাকপণ্যের ব্যবসায় মনোযোগ দেবে। কোম্পানিটি আইকিউওএস নামে একটা ভ্যাপিং মেশিন বাজারে ছেড়েছিল। জিনিসটা বিক্রি করা হতো মার্লবোরো হিটস্টিকস নামে। আইকিউওএস উষ্ণতা সৃষ্টি করে ঠিকই কিন্তু তামাক পোড়ায় না। বর্তমানে কোম্পানিটির আয়ের ৩০ শতাংশ আসে অদাহ্য নিকোটিন বিক্রি করে।

ফিলিপ মরিস ইন্টারন্যাশনালের লক্ষ্য চার বছরের মধ্যে এই হার ৫০ শতাংশে ওঠানো।

কলম আকৃতির ভ্যাপিং মেশিন ‘আইকিউওএস’ কিনছেন ক্রেতারা, জাপানের টোকিওর একটি দোকানে | ছবি: এপি

গত বছর প্রথম ভ্যাপিং পণ্য হিসেবে আইকিউওএস আমেরিকার এফডিএ-র (ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) অনুমোদন পায়। তবে এফডিএ স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে, পণ্যটিকে অনুমোদন দেওয়ার মানে এই নয় যে, এটি ক্ষতিকর নয়। এর মানে হলো, এটি অন্যান্য ধূমপান-পণ্যের চেয়ে কম ক্ষতিকর।

বড় তামাক কোম্পানিগুলো সেই ১৯৫০-এর দশক থেকে দাবি করে আসছে, সিগারেট স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি করে না। কিন্তু ২০০৬ সালে আমেরিকার ফেডারেল আদালত রায় দেয়, স্বাস্থ্যের ওপর তামাকের বিরূপ প্রভাব ঢাকার জন্য ‘৫০-বছরব্যাপী ষড়যন্ত্র’ করেছিল মার্কিন তামাক কোম্পানিগুলো।

সে কারণে তামাক কোম্পানিগুলোর ওপর থেকে কারোরই সন্দেহ যাচ্ছে না। ফিলিপ মরিস ইন্টারন্যাশনাল সেই সন্দেহ দূর করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। অন্যান্য তামাক কোম্পানিও বিজ্ঞান গবেষণা মহলের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারেনি।

তবে ফিলিপ মরিস ইন্টারন্যাশনাল চেষ্টা থামায়নি। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটি ‘ফাউন্ডেশন ফর আ স্মোক-ফ্রি ওয়ার্ল্ড’ গঠনের ঘোষণা দেয়। এই অলাভজনক সংগঠনটি ধূমপান ও স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অর্থায়ন করে। কিন্তু গবেষকরা ফাউন্ডেশনটির অর্থসহায়তা নিতে চান না।

তবে ফিলিপ মরিস ইন্টারন্যাশনাল যদি ভেকচুরা কিনে নিতে পারে, তাহলে ফুসফুসের রোগ নিয়ে কাজ করা অনেক ডাক্তার ও বিজ্ঞানীই কঠিন পরীক্ষায় পড়বেন।

ভেকচুরা সিওপিডি ইনহেলার তৈরি করে। আমেরিকায় এই ইনহেলার খুব জনপ্রিয়। প্রতিষ্ঠানটি অ্যাজমা ইনহেলারও বানায়।

এই জনপ্রিয় ইনহেলারগুলো তখন বানাবে একটা তামাক কোম্পানি। ডাক্তাররা এই কোম্পানির ইনহেলার রোগীদের প্রেসক্রাইব করবেন কি না, তা নিয়ে তখন জটিলতা সৃষ্টি হবে।

সিগারেটের ফলে সৃষ্ট রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হবে একটা সিগারেট কোম্পানির উৎপাদিত ওষুধ—এই ব্যাপারটা অধিকাংশ ডাক্তার ও বিজ্ঞানীরই অপছন্দ। তাদের মতে, এটি সিগারেট কোম্পানিগুলোর দুই দিক থেকেই লাভবান হওয়ার পাঁয়তারা। তারা বলছেন, তামাক কোম্পানিগুলো গাছেরও খেতে যাচ্ছে, তলারও কুড়াতে চাচ্ছে।

ভেকচুরা প্রসিদ্ধ ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। কাজেই একে যদি ফিলিপ মরিস ইন্টারন্যাশনালের মতো তামাক কোম্পানি কিনে নেয়, তাহলে কেমন অবস্থান নেবেন বুঝতে পারছেন না ট্যাল-সিঙ্গার।

অসহায় গলায় তিনি বলেন, ‘(তামাক কোম্পানিগুলোর) বিরুদ্ধে আমরা সাধারণত শক্ত অবস্থান নিই। কিন্তু এরা এখন (ওষুধ) কোম্পানি কিনে নিচ্ছে। এখন আমরা কী করব?’

  • সূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট