সিকিউরিটি যথাযথ হলে খেলাপি ঋণ কমবে

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

প্রতিদিনের খবর ভালো করে পড়লে বোঝা যায় ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। ভালো ভালো ব্যাংকও এ রোগে ভুগছে। খারাপগুলো তো আছেই। খেলাপি ঋণ বাড়ছে বুঝলাম, কিন্তু কারণগুলো তো পাচ্ছি না। খেলাপি ঋণ বাড়ছে কি ব্যবসায়িক মন্দার কারণে, না ব্যবসায়ীর কারসাজির কারণে, না রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে? কিছুদিন আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ১০০ শীর্ষ ঋণখেলাপির নাম সংসদে উখাপন করেছেন।

এর দ্বারা কী বুঝব? এতে যেসব নাম আছে তাদের অনেকেই অজ্ঞাতনামা, আবার যাদের নাম মানুষ চিন্তা করে তারা সেখানে নেই। সবচেয়ে বড় কথা, যেটা জানা দরকার তা তো পাওয়া যাচ্ছে না। কেন ব্যবসায়ীরা ঋণখেলাপি হচ্ছে? কারণ কী? কারণ জানলে, সঠিক কারণ জানলে চিকিৎসা করা যায়। নতুবা হয় আলোচনা। আলোচনা করে খেলাপি সমস্যার সমাধান করা যাবে না। এর জন্যই আমি সব সময় কারণটা খুঁজি। সচরাচর তা পাই না।

কারণের একটা সূত্র ওইদিন দৈনিকগুলোতে পেলাম। অর্থমন্ত্রী ঋণখেলাপিদের ‘নির্লজ্জ’ বলে গাল দিয়েছেন (২৮.০৯.১৮)। তিনি এরপর একটি অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। অনেক আগে তিনি একজন ঋণখেলাপিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি ঋণ পরিশোধ করছেন না কেন? জবাব এলো- ঋণ পেতে তার অনেক জুতা ক্ষয় হয়েছে। তাই তিনি পরিশোধ করবেন না। এর দ্বারা কী বোঝা গেল? বোঝা গেল ভদ্রলোকের ঋণ পেতে কষ্ট হয়েছে। বহু ঘোরাঘুরি করতে হয়েছে। তদবির করতে হয়েছে। হয়তো বহু খরচও করতে হয়েছে। তাই তিনি ঋণের টাকা ফেরত দেবেন না। এটা যদি ব্যক্তির কাছ থেকে ধার নেয়ার কথা হতো, তাহলে কি ঋণী ব্যক্তি এ ধরনের কথা বলতে পারতেন? মনে হয় না।

এদিকটি ছাড়াও যে কথাটি ওই ঋণী ব্যক্তি অর্থমন্ত্রীকে বলেননি সে সম্পর্কে একটা অনুমান করা যায়। ব্যাংকের টাকা ফেরত না দিলেও হবে। ওই টাকা ফেরত না দিলে তার কিছু আসবে যাবে না। এ ধরনের একটা ধারণা ঋণগ্রহীতার মধ্যে চালু হয়েছে। এর কারণও আছে। ভদ্রলোক যেমন জুতা ক্ষয় করে ঋণ নিয়েছেন, তেমনি ঋণের টাকা যাতে ফেরত না দিতে হয় তার ব্যবস্থাও করে রেখেছেন। এ কথা অনুমান করি। কীভাবে?

‘সিকিউরিটি’ বা জামানত কম দিয়ে অথবা ‘ডিফেকটিভ সিকিউরিটি’ দিয়ে তিনি ব্যাংকের যোগসাজশে ঋণ নিয়েছেন। এতে হবে কী? ব্যাংক মামলা করে জীবনে টাকা আদায় করতে পারবে না। মামলা হবে। মামলায় ব্যাংক জিতবে। টেন্ডার হবে ঋণগ্রহীতার সম্পত্তি বিক্রির। দরদাতা পাওয়া যাবে না। সম্পত্তি নেই, সম্পত্তি ত্রুটিপূর্ণ, দরদাতা আসবে কেন? ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের সমস্যা দিন দিন বাড়ছে এ কারণে। এটি আমার বহুদিনের মত।

আমার মতের সমর্থনে একটা খবরের শিরোনাম এখানে উদ্ধৃত করছি। গত ২৩ সেপ্টেম্বরের খবর। খবরটি ছাপা হয়েছে একটি দৈনিকে। এর শিরোনাম : ‘বন্ধকি সম্পত্তির মূল্য তিন কোটি, খেলাপি ৫০ কোটি টাকা’। খবরটিতে যে ঋণগ্রহীতার কথা বলা হয়েছে তিনি চট্টগ্রামের।

কী বোঝা যাচ্ছে এর দ্বারা। বোঝা যাচ্ছে গ্রাহকের ঋণের পরিমাণ ৫০ কোটি, অথচ তার বন্ধকি সম্পত্তির মূল্য তিন কোটি। এটা কী করে সম্ভব? অথচ দেখা যাচ্ছে ব্যাংকগুলো এটা সম্ভব করছে। শুধু এই একটি মাত্র খবরই নয়, ব্যাংকিং খাতের সিংহভাগ ঋণের এই অবস্থা। আমরা জানি ঋণ পেতে হলে ‘প্রাইমারি সিকিউরিটি’ লাগে।

অধিকন্তু লাগে কোলেটারেল বা বন্ধকি সম্পত্তি, অর্থাৎ দালানকোঠা, বাড়িঘর, জমিজমা ইত্যাদি যা মর্টগেজ হয়। এটা করা হয় যাতে ব্যাংকের টাকা আদায় সহজতর হয়। দীর্ঘদিনের ব্যাংকিংয়ের পর আজ ব্যাংকিং খাতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে এই বন্ধকি সম্পত্তি বা সিকিউরিটিতেই গণ্ডগোল। কাস্টমারের সিকিউরিটি যদি ঠিক থাকত, ওই সম্পত্তি দ্রুত বিক্রি করে যদি ব্যাংক টাকা আদায় করতে পারত, সম্পত্তিটির মূল্যায়ন যদি ঠিক থাকত, সর্বোপরি সম্পত্তিটি যদি সত্যি সত্যি বিরাজ করত, তাহলে আমার ধারণা অধিকাংশ গ্রাহক ব্যাংকের টাকা এভাবে নয়-ছয় করতে পারত না।

দেখা যাচ্ছে প্রথমত, ঋণের ক্ষেত্রে প্রথম সুবিধা- এটি দিতে ব্যর্থ হলে তা হয় ‘সিভিল অপরাধ’। জেলে নেয়ার ব্যবস্থা নেই। দেওয়ানি মামলা হবে। এটা খেলাপির পক্ষে একটা বড় সুবিধা। আর যা হয়, বিপুলসংখ্যক গ্রাহকের সিকিউরিটি দেয়ার মতো ক্ষমতা নেই। ২০ কোটি টাকার ঋণ নিতে হলে কমপক্ষে ৩০ কোটি টাকার জমিজমা, সম্পত্তি বন্ধক (মর্টগেজ) দিতে হবে। কতজনের এই পরিমাণ মর্টগেজ দেয়ার ক্ষমতা আছে। অতএব, বিপুলসংখ্যক কাস্টমার ব্যাংকের কর্মকর্তা, ব্যাংকের উকিল, ব্যাংকের পরিচালকদের যোগসাজশে ‘সিকিউরিটির’ অতিমূল্যায়ন করে।

এটা একটা প্রক্রিয়া। আমি শুনেছি, ঢাকা ও চট্টগ্রামে একটা চক্র আছে যাদের কাজই হচ্ছে জাল দলিল তৈরি করা। অর্থাৎ সম্পত্তি নেই, কাগজে সম্পত্তি তৈরি করা। আবার সেই সম্পত্তি, অথবা অন্য সম্পত্তির মূল্য ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে ব্যাংকে দেখানো। ‘সিকিউরিটির’ জমি জলের তলে, দেখানো হচ্ছে ভালো জায়গায়, যাতে এর দাম অতিমূল্যায়িত করা যায়। ‘থার্ড পার্টি’ সম্পত্তি জাল-জালিয়াতি করে মর্টগেজ দেয়া হয়।

কাস্টমারের অনেক সম্পত্তি হয়তো আছে। মর্টগেজ দেয়ার সময় সে দেবে তার বাজে সম্পত্তিকে, যার ‘টাইটেল’ ‘নিষ্কণ্টক’ নয়। অর্থাৎ ‘সিকিউরিটিতেই থাকে গলদ। কাস্টমার জানে এই সম্পত্তি মর্টগেজ রেখে ঋণ নিলে কোনো ঝুঁকি নেই। মামলা-মোকদ্দমা হলে প্রথমে সে উচ্চতর আদালতে গিয়ে তা ঠেকা দেবে। রিট করবে। এভাবে যাবে অনেক দিন। তারপর অর্থঋণ আদালতে বিচার শেষে যখন রায় ব্যাংকের পক্ষে যাবে তখন আছে অন্য ওষুধ। ব্যাংক খবরের কাগজে টেন্ডার দেবে জমি বিক্রির। দেখা যাবে দরদাতা নেই। ব্যাংকে খবর নিয়ে মিডিয়ার লোকজন জানার চেষ্টা করতে পারে।

দেখা যাবে দিনের পর দিন টেন্ডার হচ্ছে। দরদাতা নেই। দরদাতা পাওয়া গেল, দেখা যাবে দর নেই। কারণ সম্পত্তির ‘টাইটেল’ (মালিকানা) কণ্টকাকীর্ণ। অথবা জমি আছে জলের তলে। তার দাম নেই। এ কারণে দেখা যাচ্ছে ব্যাংকিং খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান মামলা করে ব্যাংকের টাকা আদায় করতে পারছে না।

‘হলমার্ক’ সম্পর্কে সবাই জানে। তাদের বন্ধকি সম্পত্তি কোথায়? তাদের বিরুদ্ধে সব মামলা কি রুজু করা হয়েছে? মামলার ফলাফল কী? ইতিমধ্যে তো ঋণগ্রহীতা জেল খাটছেন। মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি ৭ বছরের জেল। হলমার্কের মালিকের জেল খাটা তো প্রায় ৬-৭ বছর হয়েই যাচ্ছে।

শুধু ‘হলমার্ক’ নয়, এ রকম উদাহরণ শত শত। সিকিউরিটিবিহীন ঋণ, অপর্যাপ্ত সিকিউরিটিযুক্ত ঋণ, জাল দলিলের বিপরীতে ঋণ, অতি মূল্যায়িত মর্টগেজ প্রপার্টির বিপরীতে ঋণ। অনেক ঋণের কোনো সিকিউরিটি নেই বিধায় করা হয়েছে আরেক ব্যবস্থা।

এর নাম ‘কর্পোরেট গ্যারান্টি’, ‘পার্সোনেল গ্যারান্টি’। ঋণগ্রহীতাকে ঋণ দিতে হবে। অথচ তার পর্যাপ্ত সিকিউরিটি নেই। কী করা যায়? উদ্ভাবনীমূলক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় উপরোক্ত দু’ধরনের ব্যবস্থার সৃষ্টি করা হল। যার সিকিউরিটি নেই তাকেও ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করা হল।

ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে খেলাপি মার্কা ঋণগ্রহীতারা জানে ব্যাংক মামলা করে টাকা আদায় করতে পারবে না। মজার ঘটনা, ব্যাংক সুদ মওকুফ করে। কার সুদ, কোন্ ব্যবসায়ীর সুদ? যেসব ব্যবসায়ীর সিকিউরিটি নেই বা সিকিউরিটি অপর্যাপ্ত, তাদের সুদ মওকুফ করে। অর্থাৎ দুর্বল ঋণের সুদ মওকুফ করে। ভালো সিকিউরিটি থাকলে ব্যাংক সুদ মওকুফ করতে চায় না।

আমি যে কথাটি বলতে চাইছি তা হচ্ছে, ‘সিকিউরিটি’ যদি যথাযথ হতো অর্থাৎ সিকিউরিটি যদি নিষ্কণ্টক হতো, যথাযথভাবে মূল্যায়িত হতো, বাস্তবে বিরাজমান থাকত, তাহলে ঋণগ্রহীতারা ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে এত গড়িমসি করত না।

ব্যাংকের টাকা অপরিশোধিত রেখে যদি গ্রাহক সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়ায় ব্যবসা করতে না পারত, ঋণখেলাপি হলে যদি কৃষকের মতো কাস্টমারের কোমরে দড়ি পরানো হতো, তাহলে সহজে কেউ খেলাপি হতো না। যদি দেখা যেত খেলাপি হলে ব্যাংক অতি অল্প সময়ে গ্রাহকের সব বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রি করে দিতে পারছে এবং গ্রাহক নিশ্চিত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাহলে গ্রাহক ঋণখেলাপি হতো না।

অতএব, সিকিউরিটিভিত্তিক লেন্ডিং সম্পর্কে ভাবুন সবাই। সিকিউরিটির অত্যাবশ্যকীয়তায় এর বারোটা সবাই বাজিয়েছে। সিকিউরিটি অর্থহীন হয়েছে। বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা আদায়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়েছে। ইতিমধ্যে সারা দেশ ‘বন্ধকি সম্পত্তি’তে পরিণত হয় হয় অবস্থা। অন্তত কাগজে। এর থেকে পরিত্রাণ কী? পরিত্রাণের পথ খোঁজা দরকার। কারণ অভিজ্ঞতা এও বলে- মর্টগেজের নিয়মনীতি যদি শতভাগ মান্য করা হতো, তাহলে এত শিল্পায়ন সম্ভব হতো না।

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

rmdebnath@yahoo.com