সারি সারি সমাধি আর কারুকার্যময় মকবরা

সেহরি খেয়ে ফজর নামাজ আদায় করে ভাতঘুম। সেই ভাতঘুমের স্থায়িত্ব ছিল সকাল ৯টা পর্যন্ত। কেননা আরও বেশি ঘুমোলে ইরানে অবস্থানকালীন সরকারি খরচে দৃষ্টিনন্দন স্থান আর দেখা হবে না। সাথে তাদের ঋদ্ধ সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ স্বাদ ও রস আস্বাদন থেকেও বঞ্চিত হব। তাই ঘুমকাতুরে স্বভাবকে পরাজিত করে বিজয়ী হলাম। কিন্তু গোসলের সিরিয়াল না পাওয়ায় পরাজিত বদন হয়ে গেলাম। তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানোর মতো হাত-মুখ ধুয়ে, পিঠে ব্যাকপাক চাপিয়ে চললাম বাসের দিকে। সেখানে ক্যামেরা হাতে বিদেশি বন্ধুদের উচ্ছ্বসিত অবয়ব দর্শনে স্মিত হাসলাম। কেননা আমার ক্লিক ক্লিক ঝলকের ছবি ধারণের ক্যামেরা নেই; যা আছে তা নেভি-ব্লু রঙের বাংলাদেশ থেকে বয়ে নেয়া দাঁড়িটানা দিনলিপি। সেখানে নীল কালিতে অ্যালবাম গোছাচ্ছি খাপছাড়াভাবে। শিক্ষার আজকের অংশের বিষয় হচ্ছে কাজবিনের শিয়ায়ী আকর্ষণের মধ্যমণি ইমামযাদেহর মাজার, আমিনিয়্যা হুসাইনিয়্যা আর প্রাচীন ইরানের ইতিহাসের অন্যতম লেখক হামদাল্লাহ মুস্তাফাভির সমাধি।

বাসের চালক যে স্থানটির সামনে তাদের বাসকে দাঁড় করালেন সেটি দেখেই বুকটা হাহাকার করে উঠল। হায়রে সাদ্দাম হোসেন! কত লোক তুমি মেরেছো! শুধু ইরানে নয়, তোমার নিজ দেশেও কিন্তু মরেছে লক্ষাধিক মানবসন্তান। সদ্যোজাত শিশুর ন্যায় ইসলামি বিপ্লবের পর নাজুক অবস্থার দেশটি প্রায় পুরুষশূন্য হচ্ছিল। শিশু যোদ্ধারা ফ্রন্ট লাইনে গিয়ে প্রাণ দিচ্ছিল। আর সারা দেশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে যুবক-শিশু যাচ্ছিল স্বপ্রণোদিত হয়ে। দীর্ঘ নয় বছরব্যাপী সেই ইরাক-ইরান যুদ্ধের হাজারো শহীদের সমাধি সৌধ এখানে। প্রায় সব শহীদদের ছবিসহ মকবরা তৈরি করা হয়েছে। দু’য়েকজন বাদে সবার ছবি সুন্দর করে বাঁধিয়ে দিয়েছে শিয়রে। এরা এদের শহীদদের অনেক মর্যাদার আসনে আসীন করেছেন। দশ কিংবা বারো বছরের একটি চমৎকার চেহারার ছেলের ছবি দেখে হতভম্ব হয়ে গেলাম। কী প্রাণ দীপ্ত! অথচ কৈশোরত্বের মায়াভরা গাল ও চিবুক! মাথায় কালিমা খঁচিত সবুজ কাপড়ের পট্টি বাধা। ডান কাঁধে রাইফেল। চোখ দিয়ে স্ফুরিত হচ্ছে দেশপ্রেমের দ্যুতি। কালো বোরকা পরিহিতা বেশ কয়েকজন নারী এসেছেন জিয়ারতে। মোজাইক করা কবরের উপরে ফারসিতে বড় অক্ষরে লেখা শহীদদের নাম, জন্ম তারিখ ও শাহাদাত বরণের বিবরণ। সেখানটাতে গোলাপজল ছিটিয়ে, ঝুঁকে পড়াবস্থায় আঙুল ঠেকিয়ে বিরবির করে দুয়া পাঠ করছেন। আর লাল গাল বেয়ে উষ্ণ জল ঝরে পড়ে মিশে যাচ্ছে এপিটাফসিক্ত গোলাপজলে। যেগুলো তার হৃদয়ের গোলাপজল। সেরকমই দেখছি স্যুট-কোট পরা ক্লিনশেভের বেশ কয়েকজন পারস্য পুরুষকেও। একটি যুদ্ধবিমানকে পোলের উপর স্থাপন করা হয়েছে সাহসিকতার প্রতীক অংশ হিসেবে যেটি সে যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল। সবুজ, সাদা আর লাল রঙের সাথে কালিমা লেখা ইরানের কয়েকটি পতাকা উড়ছে পতপত করে।

বারো ইমাম মেনে চলা শিয়াদের অন্যতম ইমামযাদেহ বা ইমামপুত্র যার মাজার কাজবিনের পূর্বদিকে আর তার অপর ভাই অষ্টম ইমামযাদেহ হোসেইনি যিনি বাদশাহ হারুনের আমলে এখানে এসেছিলেন তার মাজার কাজবিনের ভেতরে শহরের মাঝখানে।

আমরা এখন সেখানেই আছি। মাজার প্রাঙ্গণটি বেশ প্রশস্ত। উপরে বর্ণিত ইরাক যুদ্ধের শহীদদের সারি সারি সজ্জিত কবর প্রথমদিকে। উত্তরদিকে কারবালার প্রান্তরের প্রতীকী মঞ্চায়ন আছে। অনেক মনোরম এ জায়গা। ‘বিষাদসিন্ধু’ চোখের সামনে ভেসে  উঠল। আসলে ইরানের অনেকেই আমাকে জিগ্যেস করেছিল যে, ‘অয়া শুমা কারবালা রাফতে বুদিদ?’ অর্থাৎ, আপনি কি কারবালা গ্যাছিলেন? আমরা যেমন অনেককেই জিগ্যেস করি আপনি হজ করেছেন কিনা? বিষয়টি এমনই। তারা কারবালার মাটি ছোট্ট কাপড়ে বেধে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে করে বাসাবাড়িতে বা নিজের সাথেও রাখেন। প্রসস্থ ও জাঁকজমক মাজার দেখলে মনের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে এজন্য যে, মাজারের থেকে আদর্শ ততোটা আঁকড়ে ধরি না। যা ভালোবাসা আর আবেগ তা ঐ পর্যন্ত। মাজারে শায়িত মহাত্মার কাজ বেমালুম উপেক্ষিত থাকে। আমার চোখ জুড়িয়ে গেল। চুমকি, জরিসহ নানা চমকানো জিনিস দিয়ে এটি তৈরি। কী নকশাদার কার্পেট আর পর্দা! নীল-ক্রিম রঙের টাইলস! আমি কাজবিনের পূর্বে ইমামযাদেহর যে মাজার দেখেছি এটি তার থেকে অনেক বড়। চতুর্পাশে ঘেরা। কবরটি তুমান বা ইরানি টাকা দ্বারা প্রায় ঢেকে গেছে। সাফাভি বংশের বাদশাহ তাহমস্প-১ ষষ্ঠদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ধর্মীয় পবিত্র স্থান হিশেবে এটি নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে সাফাভি রাজত্বের অনেক ব্যক্তিসহ অন্যান্যদের এখানে সমাহিত করা হয়। ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দে তাহমাস্প-১ এর কন্যা জয়নাব বেগম এটিকে সম্প্রসারণ করে জাঁকজমক করে তোলেন। এখানে ‘মসজিদে জামে আতিক’ নামে বিশাল একটি জামে মসজিদ আছে। প্রবেশ দিকে ছয়টি মিনার আর মাঝখানে নীল-হলুদ টাইলসের চোখধাঁধানো গম্বুজ। মূল ফটকের সরাসরি পেছনের অংশে অষ্ট কোণাকৃতির একটি প্যাভিলিয়ন আছে যাকে ঝরনার বাড়ি মনে হবে। মাজার ভবনের আঙ্গিনায় প্রবেশ করলে অন্তত পাঁচ মিনিটের জন্য আপনার চোখকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে বিমোহিত করে রাখবে হাঁটু সমান উচ্চতার একটি গুলিস্তান। নীল, সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল, শাদা রঙের গুল বা ফুলে ছেয়ে থাকা অনিন্দ্য সুন্দর গুলিস্তানটি স্টিলের খুঁটিতে জিঞ্জিরের বেড়া দিয়ে ঘেরা। মনের অজান্তেই রুচির তারিফ করবেন।
এ মাজারটির চমৎকার দিক হলো জুতোর সংরক্ষণ পদ্ধতি। মাজারে প্রবেশকালে কর্তৃপক্ষ একটি ব্যবস্থা রেখেছেন তা হল সেখানে অনেকগুলো ব্যাগের ব্যবস্থা আছে। এবং মাজার দর্শনার্থীরা সেখান থেকে একটি করে ব্যাগ নিয়ে নিজের জুতো সাথে করে নিয়ে যেতে পারেন। তাতে জুতো হারানো বা খুঁজে না পাওয়ার ঝক্কিঝামেলা থাকে না।
কুরআনের আয়াত খচিত কালো কাপড়ে ঢাকা একজনের লাশ খাটলিতে করে বয়ে নিচ্ছেন শববাহীরা। উচ্চস্বরে তাকবীর দিচ্ছে বয়ে নেয়া লোকজনসহ শেষ শয্যায় অংশগ্রহণকারীরা। সাথে দেখি কালো বোরকায় মোড়ানো, কালো জিন্স পরিহিতা কয়েকজন নারী অশ্রু মুছছেন আর বিলাপ করছেন। সম্ভবত এখানে জানাজা হয়েছে। আশপাশে কোথাও দাফন হবে। এখানে সমাহিত হওয়া মানে বিশেষ মর্যাদা লাভ করা। তাই একটি সাড়ে তিন হাত কবরের টিকিটের জন্য বোধহয় অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়।

মাজারের পাশে বসে কেউ কেউ দুয়া করছেন; কেউবা আবার নামাজ পড়ছেন; আবার হাত তুলে মুনাজাতে হু হু করে কাঁদছেন। শিয়াগণ নামাজ পড়েন সেজদার জায়গায় একটি চকলা রেখে। তারা বিশ্বাস করেন যে আল্লাহর তৈরি জিনিশে সিজদা করতে হবে। মানব তৈরি কৃত্রিম কোনো জিনিশে সিজদা করা যাবে না। তাকবিরে তাহরিমা দেয়ার পর বুকে হাত বাঁধে না। হাত ছেড়ে দেয়। রুকু ও সিজদা প্রায় আমাদের মতোই। তবে সালাম ফিরায় না। তারা তাশাহুদ, দরুদ আর দুয়ায়ে মাছুরা পাঠ শেষে হাত দু’টি তিনবার উত্তোলন করে উরুর উপর বারি মেরে আল্লাহু আকবার বলে নামাজ শেষ করেন।
অতঃপর আমিনিয়্যা হোসাইনিয়্যা নামক একটি ভবনে আসলাম। ব্যবসায়িক শৌখিন মানুষ হাজী মোহাম্মদ রেজা আমিনি এটি ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করেন। পূর্ব থেকে পশ্চিমমুখী করে পরস্পর সংযুক্ত তিনটি কক্ষের এ চমৎকার ধর্মীয় ঐতিহাসিক স্থাপনাটি কার্পেট ও গদিদ্বারা সুসজ্জিত। ইরানি স্থাপত্য কলার ঐতিহ্যগত নীল-হলুদ, লাল, কমলা মিশ্রণের টায়েলসের তৈরি দেয়াল-ছাদ আর কাঠের উপর বিভিন্ন নকশার কারুকার্য আমিসহ অভ্যাগত সকলের স্মৃতিতে স্থায়ী আসন করে নিল। আগে এখানে ব্যবহৃত কাসার তৈরি কিছু তৈজষপত্র সংরক্ষিত আছে।

এখানে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি বিশেষ করে ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের ঘটনা করুণ সুরে বর্ণনা করেন একজন অভিজ্ঞ বর্ণনাকারী। সে বর্ণনার আবেদন এমন যে, হলভর্তি মানুষ চোখের পানিতে ভিজে আর কান্নার রোল পড়ে যায়। আমরা যেমন মুসল্লিদের খাওয়ানোর জন্য নানা উদ্দেশ্যে মানত করি, তেমনই অনেকে মানত করে এখানে সমাগত লোকজনের শ্রান্তি লাঘবের জন্য চা, নাস্তা ইত্যাদি ব্যবস্থা করেন।

রাশিয়ান চিকন শরীরের এ্যালেক্স ঠাস করে বসে পড়ে। আর সাথে করে বয়ে আনা হুক্কাতে টান মারতে থাকে। ভেনিজুয়েলা থেকে আগত বান্ধবীরা দেখি পথের মধ্যে কথার তোড়ে গাঢ় করে লিপিস্টিকে রাঙানো ঠোঁটের ফ্যাকাশে অবস্থা দূর করার জন্য নতুন করে লাল লিপিস্টিক আর লিপগ্লোজে রাঙিয়ে ছবি তোলায় মশগুল। আমাদের সাথে যাওয়া গাইড মহিলাটি ফারসিতে বর্ণনা করে যাচ্ছেন এ দর্শনীয় স্থানের নানা খুঁটিনাটি। বলছেন, ‘বাচ্চে হ…’

এতদিনের ইরান সফরের অন্যতম ভালোলাগার বিষয় হচ্ছে নুজহাতুল কুলুব নামে ঐতিহাসিক গ্রন্থের গ্রন্থকার হামদাল্লাহ মুস্তাভাফি’র মাজার দর্শন। আমিনিয়্যা ভবন দর্শনের পর আমরা এখন সেই মাজারে। লেখকের মূল নাম হামদাল্লাহ। তার মূল নামের ব্যাপারে মতানৈক্য থাকলেও উপাধির বিষয়ে সামসময়িক লেখক ও গবেষকগণ একমত। মুস্তাভাফি অর্থ উচ্চপদস্থ অর্থনৈতিক কর্মকর্তা। তিনি ইলখানি রাজবংশের দরবারে চাকরি করতেন। কবিতা লেখার পাশাপাশি ইতিহাসগ্রন্থ প্রণেতা এবং সুখ্যাত ভূগোলবিদ মুস্তাফাভির জন্ম ১২৮১ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ১৩৩৯-৪০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। প্রখ্যাত উজির ও ইতিহাসবিদ রাশিদ আল-দিন হামদানি তার নিকটাত্মীীয়। তারই উৎসাহে লেখক লেখালিখি আরম্ভ করেন। কাজবিনের অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের ন্যায় আকর্ষণীয় নয় মকবরাটি। চারদিকে খয়েরি রঙের ইটদ্বারা ঘেরা একখণ্ড জমি। দেয়াল ঘেঁষে ঝরাপাতার ঠকঠকে গাছের সারি। জৌলুশ বলতে গম্বুজের অগ্রভাগ নীল পাথরে চিকমিক। সাদা পাথর দিয়ে তৈরি লেখকের একটি মুখাবয়ব গম্বুজের বাইরে। লম্বা লম্বা দাড়ি ও পাগড়ি। ডাগর চোখ ও উঁচু নাসিকা। খুবই সাধাসিধে একটি গম্বুজ আকৃতির নিচে তার কবর। কবরটি বর্তমানে গম্বুজের মাটি থেকে অনেক নিচে। সেখানে যাওয়ার রাস্তা ও কবরের ঘরটি খুবই সংকীর্ণ। তাই উপর থেকে একটি সিঁড়ি করেছে কর্তৃপক্ষ। সিঁড়ির মুখে লোহার গ্রিলের দরজা দিয়ে তালা লাগানো।
গম্বুজে প্রবেশের দরজার কাছে সেই ছোট্ট কবরের ঘরের সিঁড়ির মুখ, গম্বুজের ভিতরে তার রচিত পুস্তক ও গ্রন্থগুলো সেলফের মধ্যে সাজানো আছে। যেমন-
১. জাফর নামে/শাহ নামে;
২. তারিখে গুজিদে;
৩. নুজহাতুল কুলুব।

নুজহাতুল কুলুব বা হৃদয়ের সুখ নামক গ্রন্থটি প্রথম ফারসি বিশ্বকোষ। জাফরনামে বা শাহনামে গ্রন্থটি শাহনামার স্টাইলে লেখা একটি বিখ্যাত মহাকাব্য। তারিখে গুজিদেহ সেইসময় থেকে প্রাচীন ইরানের সামগ্রিক ইতিহাস।
নিচু কবর থেকে বাইরে বের হয়ে দেখলাম যে সূর্যিমামার তেজ কমে গেছে। সেইসাথে আমাদের শারীরিক শক্তিও। সূর্যাস্ত আইন মান্য করে বাসে উঠে হলের উদ্দেশে রওনা হলাম। কেননা ইফতারের আয়োজন যে সেখানেই।

লেখক: গবেষক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

সূত্রঃ যুগান্তর