সাপাহারকে শত্রুমুক্ত করতে ২১ মুক্তিযোদ্ধা দিয়েছিল প্রাণ

প্রদীপ সাহা,সাপাহার:

নওগাঁর সাপাহার উপজেলার স্বাধীনতাকামী মানুষদের কাঁদাতে ও ১৯৭১ এর ১৩ সেপ্টেম্বরের সেই বিভৎস রূপ স্মরণ করে দিতে স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৫ বছর পর আবারো ফিরে এলো সেই ১৩ সেপ্টেম্বর।

১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধার একটি সস্বস্ত্র দল সাপাহার উপজেলা বাসীকে শত্রু মুক্ত করতে গিয়ে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হন এবং সে যুদ্ধে ২১জন বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসিমুখে তাদের তাজা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন, আহত হয়েছিলেন অনেকেই। তাই ১৩’সেপ্টম্বর সাপাহারবাসীর জন্য ইতিহাসে ভয়াল দিন হিসেবে আজও পরিচিত। প্রতিবছর ১৩’সেপ্টম্বর এই দিনটি স্মরন করে অনেক সন্তান হারা মা’ ভাই হারা বোন ও তাদের আত্নীয় স্বজনরা অঝোর ধারায় তাদের চোখের পানি ফেলেন।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সে দিনের যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এস, এম জাহিদুল ইসলাম, মনছুর আলী, আব্দুর রাজ্জাক আলী মাষ্টার সহ একাধীক মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকার কিছু প্রবীণ ব্যক্তিদের নিকট থেকে সিল্কসিটি নিউজের অনুসন্ধান করে জানা গেছে, দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে পাকহানাদার বাহিনী ও তার দোসররা সাপাহার সদরের পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন পূর্বদিকে একটি পুকুর পাড়ে শক্তিশালী ক্যাম্প স্থাপন করে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।

এখান থেকেই তারা এলাকার বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে অসহায় মা বোনদের সম্ভ্রমহানি নিরীহ লোকদের ব্রাশফায়ার ও বাড়ী ঘরে অগ্নি সংযোগ করে থাকত। দেশের এই প্রতিকূল অবস্থায় বর্বর হানাদার বাহিনীর কবল থেকে সাপাহারবাসীকে মুক্ত করার জন্য সাপাহার ও মহাদেবপুর এলাকার ৮০জন মুক্তিযোদ্ধা দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে তৎকালীন পাকহানাদার বাহিনীর লেঃ শওকত আলীর অধীনে সাপাহারে ওই শক্তিশালী ক্যাম্পটিকে উৎখাত করার জন্য ১৩ সেপ্টম্বর রাতে আক্রমন চালানের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন।

সিদ্ধান্ত মোতাবেক ওই দিন রাতে মুক্তিযোদ্ধা মেজর রাজবীর সিং এর আদেশ ক্রমে ও ইপিআর হাবিলদার আহম্মদ উল্লাহর নেতেৃত্বে ৮০জন মুক্তিযোদ্ধার সংঘটিত দলটিকে ৩টি উপদলে বিভক্ত করে একটি দলকে সাপাহার-পত্নীতলা রাস্তার মধইল ব্রিজে মাইন বসানোর কাজে নিয়োজিত করা হয়, যাতে পত্নীতলা হতে শত্রুসেনারা সাপাহারে প্রবেশ করতে না পারে। অন্য একটি দলকে নিয়োজিত করা হয়  সার্বক্ষনিক টহল কাজে। আর মূল দলটি  অবস্থান নেয় শত্রু শিবিরের একেবারে কাছাকাছি একটি ধানক্ষেতে। কিন্তু হাজারো সতর্কতা ও নিশ্ছদ্রতার জাল ভেদ করে মোনাফেক রাজাকার আলবদর মারফত মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমনের খবর পৌঁছে যায় শত্রু শিবিরে।

তাৎক্ষনিক ভাবে পাক সেনারাও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। চলতে থাকে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধের নানা পরিকল্পনা। অবশেষে শেষ রাতের দিকে ধানক্ষেতে অবস্থান নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র গর্জে ওঠার সাথে সাথে বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা। শুরু হয় উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুুল লড়াই। লড়ায়ের এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধার দলটি যখন শত্রু সেনাদের প্রায় কোন ঠাসা করে ফেলেছিল ঠিক এমনি অবস্থায় ভোরের আভাস পেয়ে ব্রীজে মাইন বসানোর দলটি সেখান থেকে সরে পড়লে তার কিছুক্ষন পরই পত্নীতলা হতে অসংখ্য শত্রু সেনা আরো ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সাপাহারে প্রবেশ করে।

এর পর শত্রু পক্ষের অত্যাধুনিক ভারী অস্ত্রের মুখে হিমশিম খেয়ে এক সময় বাধ্য হয়ে পিছু হটতে হয় মুক্তি যোদ্ধাদের। এ সময় শত্রু পক্ষের গুলির আঘাতে বীর মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান, আইয়ুব আলী, আব্দুল হামিদ সহ ১৫জন ঘটনা স্থলেই শাহাদাত বরন করেন। আহত হন মনছুর আলী, এস,এম জাহিদুল ইসলাম, দলনেতা আহমদ উল্লাহ, সোহরাব আলী, নুরুল ইসলাম সহ অনেকে।
এছাড়া শত্রুদের হাতে জীবিত ধরা পড়েন ৮জন মুক্তিযোদ্ধা। শত্রুরা আটক ৮জনের ৪জনকে পত্নীতলার মধইল স্কুলের ছাদে তুলে কুপিয়ে হত্যা করে লাশ গুলি লাথি মেরে নিচে ফেলে দেয়। ২জনকে ধরে এনে মহাদেবপুরের একটি কূপে ফেলে দিয়ে জীবন্ত কবর দেয় এবং সাপাহারের তিলনা গ্রামের আবু ওয়াহেদ গেটের ও মহাদেবপুর উপজেলার জোয়ানপুর গ্রামের মৃত এস, এম আবেদ আলীর পুত্র টকবগে যুবক এস,এম জাহিদুল ইসলামকে ধরে এনে নাটোরের রাজবাড়ীতে তৈরীকৃত জেল খানায় বন্দি করে রাখে।

শত্রুসেনার বন্দিদশা ও সেই ভয়াল ১৩ সেপ্টম্বর এর বর্ণনা দিতে গিয়ে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া জেল ফেরত যুদ্ধাহত জাহিদুল ইসলাম হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন এবং অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন, মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন আস্তানা গোপন তথ্য ও অস্ত্র ভান্ডারের খবর জানার জন্য প্রতিদিন সকালে তাদের দু’জনকে হানাদার বাহিনীর এক উর্ধতন কর্মকর্তার নিকট উপস্থিত করা হত। তথ্য আদায়ে ব্যার্থ হলে কর্মকর্তার সামনেই ধারালো অস্ত্র (চাকু) দিয়ে  শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কেটে লবন মাখিয়ে দেয়া হতো। অসহ্য যন্ত্রনায় অসহায় মুক্তিযোদ্ধারা যখন ছটফট করতো শত্রু বাহিনীর সকলেই তখন আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠত। এমনি হাজারো দুঃখ কষ্টের মাঝে থেকে সুযোগ বুঝে একদিন তারা জেলের প্রাচীর টপকে পালিয়ে এসে প্রাণে বাঁচেন।

স/অ