সাত খুন মাফ হয়নি

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

বাংলাদেশের স্মরণকালের সবচেয়ে আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর ঘটনা নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার রায় হলো আজ। নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন আজ সকালে নূর হোসেন ও তিন র‌্যাব কর্মকর্তাসহ ২৬ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং বাকি নয়জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজার আদেশ দেন। রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে বাদীপক্ষ।

 

রায় ঘোষণার সময় মামলার ৩৫ আসামির মধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকা ২৩ জন আদালতে উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ১৭ জন র‌্যাবের সদস্য। মামলার শুরু থেকেই র‌্যাবের সাবেক আট সদস্যসহ ১২ আসামি পলাতক।

 

দেশের বিচারিক প্রক্রিয়া চিন্তা করলে এত বড় ঘটনার রায় তিন বছরের মধ্যেই হলো—এটা যেমন আশাবাদের পথ দেখায়, তেমনি দ্রুততম সময়ে আপিল বিভাগের কার্যক্রম নিষ্পত্তি শেষে রায় কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত সর্বাঙ্গীণ সন্তুষ্টির কোনো জায়গা নেই। কারণ, যে ঘটনায় কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের সঙ্গে শুধু অর্থনৈতিক লাভের জন্য রাষ্ট্রীয় এজেন্সির কর্তাব্যক্তিরা জড়িয়ে যায়, তার বিচারে দৃষ্টান্তমূলক সাজা কার্যকর না হলে জাতি হিসেবে আমাদের মুখ দেখানোর আর জায়গা থাকে না।

 

সাত খুন মামলার রায়ের আগের দিন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের যেমনটা বলেছিলেন, ‘দেশের আপামর জনসাধারণ এ মামলার আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায়। এটি ছিল পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁদের কাজ ছিল মানুষের স্বাধীনতাকে সেফগার্ড করা। তাঁরাই যদি অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়ে যান, সে অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য।’

 

অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে আমরা সহমতে থেকেই বলব, অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য—এমন প্রশ্নই থাকা উচিত নয়; বরং সমস্বরে আমাদের সবার উচ্চারণ করা উচিত, দৃষ্টান্তমূলক সাজা কার্যকরটাই হতে পারে এই রাষ্ট্র ও এখানকার মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া অভিশাপের কলঙ্ক থেকে নির্বাণ লাভের একমাত্র ও অবশ্যম্ভাবী উপায়।

 

আমরা দীর্ঘদিন ধরেই গণমাধ্যমে এমনতর সংবাদ শিরোনাম দেখে আসছি যে বাংলাদেশে গুম-খুনের বিচার নেই, ঢাকায় ৪৪ শিশু খুনের বিচার আটকে আছে, এক বছরেও শুরু হয়নি যুবলীগ নেতাসহ জোড়া খুনের বিচার; ২১ জন ব্লগার, সাংবাদিক ও শিক্ষক হত্যার বিচার অসমাপ্ত; বছরের পর বছর পেরোয় অথচ বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর খোঁজ মেলে না; চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলা তদন্তে গা-ছাড়া ভাব; রাজধানীতে ছয় মাসে পুলিশ কর্মকর্তাসহ ১৪ খুন, জড়িতরা শনাক্ত হয়নি; তনু বা মিতু হত্যার মামলা তদন্তে অগ্রগতি নেই ইত্যাদি। এমন পরিস্থিতিতে চাঞ্চল্যকর সাত খুনের মামলার আশানুরূপ রায় পাওয়াটা স্বস্তিদায়ক হলেও তা অব্যাহত নৈরাশ্যের নিদান নয় কিছুতেই!

 

দেশে অনাচারিক কিছু ঘটলেই কোনোরকম তদন্ত ছাড়াই ক্ষমতাসীনরা দায় চাপান বিরোধীদলের ওপর। এটা এখানকার এক ধরনের কুৎসিত প্রবণতা। কিন্তু দেশে বর্তমান সময়ে যেকোনো কিছু ঘটিয়ে ফেলার সক্ষমতা যে বিরোধীদলের নেই, তা সরকার সমর্থকদের চেয়ে আর কারো ভালো জানার কথা নয়। কারণ, বিরোধীদলকে শক্তিহীন করে দেওয়ার দায়ভারের বহুলাংশ তাদেরই। দেশে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকে না, রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিও থাকে না। এর ফলে চাপমুক্তভাবে যা খুশি তা করে ফেলা যায়। দুর্বল গণতন্ত্রের এটা হলো বাজে কুফল। সেই কুফলের ভুক্তভোগী হতে হয় সাধারণ জনগণকে। এর সর্বশেষ বড় উদাহরণ নারায়ণগঞ্জের নির্মম সাত খুন।

 

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও তাঁর আইনজীবী চন্দন সরকারসহ অপর পাঁচজন। পরদিন নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেনসহ ছয়জনকে আসামি করে ফতুল্লা থানায় অপহরণের মামলা করেন, যেটি পরে হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়।

 

৩০ এপ্রিল বিকেলে শীতলক্ষ্যা নদীর বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া শান্তির নগর এলাকা থেকে নজরুল, তাঁর বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন ও তাঁর গাড়িচালক ইব্রাহিমের হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করা হয়। পরদিন একই জায়গায় মেলে নজরুলের আরেক বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটনের লাশ। সব লাশের পেটে ছিল আঘাতের চিহ্ন। প্রতিটি মরদেহ ইটভর্তি দুটি করে বস্তায় বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এ খবরে উত্তেজিত জনতা ১ মে সকালে কাউন্সিলর নূর হোসেনের শিমরাইলের কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। বীভৎস এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দেশব্যাপী শোরগোল ওঠে। বিদেশেও মারাত্মক ভাবমূর্তি সংকটে পড়ে সরকার।

 

৪ মে নজরুলের শ্বশুর অভিযোগ করেন, র‌্যাবের তিন কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এম এম রানা ও মেজর আরিফ হোসেন ছয় কোটি টাকার বিনিময়ে এ সাতজনকে অপহরণের পর খুন করেন। সেনা কর্মকর্তা তারেক সাঈদ র‌্যাব-১১-এর অধিনায়ক ছিলেন। নৌবাহিনীর কর্মকর্তা রানা ও সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা আরিফও র‌্যাব-১১-এর কর্মকর্তা ছিলেন।

 

পরে পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর অনুযায়ী মিলিটারি পুলিশের সহায়তায় ঢাকা সেনানিবাস থেকে র‌্যাবের ওই তিন কর্মকর্তাকে প্রেপ্তার করা হয়।

 

এরই মধ্যে অপরাধ সংঘটিত হওয়া এলাকার সরকারদলীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ও সন্ত্রাসী নূর হোসেনের টেলিফোন কথোপকথন মিডিয়ায় প্রকাশ হয়ে পড়ে এবং জানা যায়, এ ঘটনার মূল নায়ক নূর হোসেন, যাকে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন স্বয়ং ওই সংসদ সদস্য। অভিযোগের তীর থেকে বাদ যান না র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসানও। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও সাত খুনের ঘটনা প্রসঙ্গে বেশ কয়েকবার এই কর্মকর্তার নাম উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু পুলিশি তদন্তে এঁদের নাম ছিল না।

 

নূর হোসেনকে ওই বছরের ১৪ জুন গভীর রাতে কলকাতার দমদম বিমানবন্দরসংলগ্ন বাগুইআটি থানা পুলিশ আটক করে। ২০১৫ সালের ১৩ নভেম্বর বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে তাঁকে বাংলাদেশের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

 

হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ৩৫ জনকে আসামি করে ২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি অভিযোগ গঠন করে পুলিশ। এঁদের মধ্যে ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়, যাঁর ১৭ জনই র‌্যাব সদস্য। পলাতক ১২ জনের মধ্যেও র‌্যাবের আটজন রয়েছেন। গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের ২১ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। মামলায় ১২৭ জনকে সাক্ষী করা হলেও আদালত ১০৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করে। অভিযোগপত্র নেওয়ার পর জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেনের আদালতে ৩৮টি শুনানির শেষে আজ ১৬ জানুয়ারি রায় ঘোষণার দিন ধার্য করা হয়। এবং বিজ্ঞ আদালত আজ সকালে ২৬ জনের ফাঁসি ও বাকি নয়জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজার আদেশ দিলেন।

 

রায়ের আগে আমরা দেখেছি, সাত খুন মামলার মূল আসামি নূর হোসেনকে রিমান্ডে নেওয়ার ব্যাপারে গড়িমসি করা হয়েছে। তারেক সাঈদ হত্যা মামলা থেকে তাঁর নাম বাতিল চেয়ে আবেদন করলে আদালত শুনানিতে বিব্রত হয়েছেন। কিন্তু এত বড় ঘটনা তদন্তে কোনো পক্ষকেই এতটুকু ছাড় দেওয়ার সুযোগ ছিল কি? হোন না তিনি প্রভাবশালী সংসদ সদস্য বা সরকারি ফোর্সের বড় আধিকারিক!

 

দেশে এখনকার ক্ষমতাসীন আর ২০০১ সালের অক্টোবর-পরবর্তী ক্ষমতাসীনদের মধ্যে স্বার্থদ্বন্দ্ব আর বিরুদ্ধ মত দমনে বেশ সাযুজ্য আছে। সে সময়ও এখনকার মতোই সরকারি দলের ক্যাডাররা সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও বিরোধী মতের ওপর নিপীড়নটাকে রুটিন ওয়ার্কে পরিণত করেছিল। তা সামলাতে রীতিমতো ব্যর্থ হচ্ছিল পুলিশ বা অপরাপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একপর্যায়ে তৎকালীন সরকারপ্রধান নিতান্ত বাধ্য হয়ে এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র‌্যাব গঠন করেন। সন্ত্রাস দমনে আশানুরূপ ফলও মেলে সে সময়। যদিও সে সময়ের বিরোধীদল আওয়ামী লীগের দাবি, তাদের দমনপীড়নের জন্যই র‌্যাব গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সরকারের সময়ে র‌্যাবের হাতে বিরোধীপক্ষের যত লোকের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তা অতীত রেকর্ড ভঙ্গ করেছে বলেই রাজনৈতিক ও প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা মনে করেন। এর চেয়েও বড় মর্মান্তিক ঘটনা হলো, র‌্যাব হয়ে উঠেছিল সন্ত্রাসী আর অবৈধ সম্পদের সেফগার্ড, যার জ্বলন্ত উদাহরণ নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা। সাতজন মানুষের প্রাণহরণ করে হলেও নূর হোসেনের মতো সন্ত্রাসী দানবকে রক্ষাকারীর ভূমিকায় নেমেছিল রাষ্ট্রীয় অভিজাত সংস্থা। ক্ষমতাকেন্দ্রিক অসুস্থ রাজনীতি তার নোংরা নখর এভাবেই উন্মুক্ত করে দেয়। সাধারণের প্রাণহীন দেহখানি শীতলক্ষ্যায় ডুবিয়ে দেওয়া সেই অসুস্থতারই অনিবার্য পরিণতি। অথচ র‌্যাবকে জনগণের পয়সায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল এ জন্য যে, নিজের জীবন বিপন্ন করে হলেও তারা হবে আমজনতার অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষা এবং সর্বোপরি নিরাপত্তা বিধানের উৎসর্গীকৃত ও নিরপেক্ষ রক্ষাকবচ।

 

সন্ত্রাসী নূর হোসেন তাঁর ‘পিতা’র নাম উল্লেখ করলেও সেই পিতাটির গায়েও কোনো স্পর্শ পড়ল না। এসবই ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা। বিরোধীদলের প্রতিবাদ আর দ্রোহের মিছিল যেখানে আগুন জ্বালায় না, সেখানে এমন বিবেকবর্জিত লজ্জাহীনতা হয়তো আরো দেখে যেতে হবে!

 

তবু আজকের রায় আমাদের এই শিক্ষা দিয়ে গেল যে, সব অপরাধী পার পেয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। নির্দেশক না হোক, বাস্তবায়নকারীদের সাজা নিশ্চিত করা গেল। দেশে যদি শক্তিশালী বিরোধীদল থাকত, প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ থাকত আর রাজনীতি ক্ষমতাকেন্দ্রিক না হয়ে সত্যিকারের সেবার ব্রত হয়ে উঠত, তবে নিশ্চিতার্থেই আমরা পর্দার আড়ালে থাকা অপরাধ-সম্রাটদেরও বিচারের আওতায় আনতে পারতাম।

 

আজকের এই যুগান্তকারী রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ নিহত অপর পাঁচজন মানুষের বিদেহী আত্মা শান্তি পাক। আর তাঁদের পরিবারের স্বজনরা শোক বইবার শক্তি যেন ফিরে পান। সব অশুভ শক্তি দূর হয়ে মানুষের অধিকার সমুন্নত থাকুক। আইনের শাসনে সুরক্ষিত থাকুক বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।

লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।

সূত্র: এনটিভি