সাক্ষী সুরক্ষা আইনের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত: খসড়া ঝুলে আছে ৮ বছর

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

চলতি বছরের ১৩ জুন নাটোরে গুরুদাসপুর উপজেলায় জালাল উদ্দিনকে কুপিয়ে হত্যা করে একদল দুর্বৃত্ত। তিনি উপজেলার বিয়াঘাট ইউনিয়নের সাবগাড়ী এলাকায় সফুরা বেগম হত্যা মামলার প্রধান সাক্ষী।

আর ১৭ আগস্ট চুয়াডাঙ্গায় আলমডাঙ্গা উপজেলায় মারামারি ঘটনার মামলার সাক্ষীকে মারধরের পর তার (সাক্ষী) মেয়েকে ধর্ষণ করে আসামি লাল্টু ও তার সহযোগীরা। নির্যাতিতার বাবা বাদী হয়ে আলমডাঙ্গা থানায় একটি ধর্ষণ মামলা করেন।

বিভিন্ন মামলার সাক্ষীর ওপর হামলার ঘটনা শুধু গুরুদাসপুর বা আলমডাঙ্গায় নয়, বছরের পর বছর ধরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘটছে এমন ঘটনা।

তাই বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করেই ২০১১ সালে ‘সাক্ষী সুরক্ষা’ শিরোনামে একটি নতুন আইন করার উদ্যোগ নেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় অদ্যাবধি সেটি আলোর মুখ দেখেনি। আদৌ সেটি প্রণয়ন হবে কিনা- তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন আইন বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টরা।

তাদের মতে, সাড়ে আট বছর আগে প্রস্তাবিত এই আইনের খসড়া তৈরি করা হয়। শুধু তাই নয়, এটি প্রণয়নে রয়েছে হাইকোর্টেরও নির্দেশনা। এই দীর্ঘ সময়ে আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পন্ন করেছে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষাও। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, সম্প্রতি এটি নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন ভাবনা।

এ ব্যাপারে আলাদা আইন না করে ‘সাক্ষ্য আইন’ (এভিডেন্স অ্যাক্ট) সংশোধন করে সাক্ষী সুরক্ষার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা যায় কিনা- সে বিষয়ে নেয়া হয়েছে আরেকটি নতুন উদ্যোগ। এ নিয়ে আবার শুরু হচ্ছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। সব মিলিয়ে এই আইনের ভবিষ্যৎ এক রকম অনিশ্চিত বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

সংশ্লিষ্টদের আরও অভিমত, নতুন আইন প্রণয়ন অথবা বিদ্যমান কোনো আইন সংশোধন অর্থাৎ যেভাবেই হোক না কেন, সাক্ষীদের সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া খুবই জরুরি। কারণ সাক্ষীর প্রতি হুমকির ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। এ কারণে বিভিন্ন মামলায় সাক্ষীরা প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে প্রায়ই অনীহা প্রকাশ করেন।

সাক্ষ্য দেয়ার কারণে আসামিপক্ষ থেকে সাক্ষীকে ভয়ভীতি দেখানোসহ জীবননাশের হুমকিও দেয়া হয়। এমনকি সাক্ষ্য দেয়ায় সাক্ষীর জীবননাশের ঘটনাও ঘটেছে।

অন্যদিকে সাক্ষীদের অনুপস্থিতিতে অনেক ফৌজদারি মামলায় অভিযোগ প্রমাণ করা যায় না। এতে কোনো কোনো সময় মামলার প্রকৃত আসামিরা খালাস পেয়ে যায়। পাশাপাশি বিলম্বিত হয় বিচার কার্যক্রমও।

জানতে চাইলে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম সারোয়ার বলেন, সাক্ষী সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে মন্ত্রণালয়। বর্তমানে ‘সাক্ষ্য আইন’ (এভিডেন্স অ্যাক্ট) সংশোধন নিয়ে একটি কমিটি কাজ শুরু করেছে। চলতি মাসে স্টেকহোল্ডাররা মতামত দেবেন। সেখানে সাক্ষী সুরক্ষার বিষয়টি আসতে পারে। সাক্ষী সুরক্ষার জন্য কি আলাদা আইন দরকার, নাকি সেখানে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা যায়- সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করবে এই কমিটি।

গত সাড়ে আট বছরেও সাক্ষী সুরক্ষা আইন না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত। তিনি শুক্রবার বলেন, বর্তমান এবং সাবেক আইনমন্ত্রী এতদিন বলে এসেছেন, এ বিষয়ে একটি বিশেষ আইন প্রণয়ন করবেন। আইন কমিশন থেকেও সুপারিশ পাঠায়। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য আইনটি এখনও হয়নি।

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সাক্ষ্য আইন (এভিডেন্স অ্যাক্ট) একটি ভিন্ন বিষয়। এখানে সাক্ষী সুরক্ষার বিষয়টি আসা ঠিক হবে না। এর জন্য একটি বিশেষ আইন করা জরুরি। যদি সাক্ষ্য আইনে সাক্ষী সুরক্ষার বিষয়টি আনা হয়, তাহলে আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি আর আলোর মুখ দেখবে না। অনিশ্চিত হয়ে পড়বে সাক্ষী সুরক্ষার বিষয়টি।

প্রসঙ্গত, আইন কমিশন ২০১১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি উল্লিখিত আইনটি প্রণয়নের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে একটি খসড়া প্রেরণ করে। কমিশন তাদের সুপারিশমালায় সুরক্ষার অধিকার, সুরক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে তথ্য জানার অধিকার, সুরক্ষা বিষয়ে জাতীয় নীতিমালা কর্মসূচি ও বাস্তবায়ন সংস্থা, সুরক্ষা প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্তির আবেদন, আবেদনের শর্তাবলি, সুরক্ষাপ্রাপ্ত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি (ভিকটিম) বা সাক্ষীর অধিকার, সাক্ষীদের অধিকার ভোগ নিশ্চিত করা, সাক্ষীর অঙ্গীকার, সাক্ষীর নিরাপত্তাসহ ১৯টি সুপারিশমালা প্রেরণ করে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সম্প্রতি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, আইনটি চূড়ান্তকরণে সংশ্লিষ্ট বিভাগ কাজ করছে।

আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খাইরুল হক বলেন, সাক্ষী সুরক্ষা আইনটি হওয়া জরুরি। এ বিষয়ে প্রধান ভূমিকা নিতে হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে।

তিনি বলেন, আমি ২০১৩ সালে আইন কমিশনে যোগদান করি। সে সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাক্ষীদের নিরাপত্তার বিষয়ে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি ওঠে। এ বিষয়ে আমাদের তরফ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এছাড়া সাক্ষী সুরক্ষা আইন নিয়ে খোঁজখবর নেব, কিভাবে আইনটি করা যায়।

‘সাক্ষী সুরক্ষা’ আইন প্রণয়নে কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, সাক্ষীদের নিরাপত্তার জন্য ‘সাক্ষী সুরক্ষা’ আইন প্রণয়ন করা অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। এটা নিশ্চিত যে, রাষ্ট্র সাক্ষীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলে অপরাধীরা সাক্ষ্যের অভাবে খালাস পেতে থাকবে, যা দেশের আইন, বিচার ব্যবস্থা ও আইনশৃঙ্খলার জন্য মারাত্মক হুমকি হবে।

‘সাক্ষী সুরক্ষা’ আইন প্রণয়ন ও মামলার সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য পৃথক স্থায়ী তদন্ত সংস্থা গঠনে সরকারকে জোর সুপারিশ করে আইন কমিশন। কমিশন মনে করে, এ ধরনের আইন করা হলে সাক্ষীরা নির্ভয়ে আদালতে ফৌজদারি মামলায় সাক্ষ্য দিতে আসবেন।

জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘সাক্ষী সুরক্ষা’ আইন প্রণয়ন করা অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। আমেরিকাতে এক স্টেটের সাক্ষী অন্য স্টেটে রাখা হয়। এভাবে সাক্ষী সুরক্ষা দিতে পারলে ভালো।

তিনি বলেন, আইন কমিশন ২০১১ সালে উল্লিখিত আইনটি প্রণয়নের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে একটি সুপারিশমালা প্রেরণ করে। পরে আইন মন্ত্রণালয় এর খসড়া তৈরি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। এখন আইনটি করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নিতে হবে।

বর্তমানে ‘সাক্ষ্য আইন’ (এভিডেন্স অ্যাক্ট) সংশোধন নিয়ে মন্ত্রণালয় কাজ শুরু করেছে। সেখানে সাক্ষী সুরক্ষার বিষয়টি রাখা যায় কিনা তা নিয়ে ভাবছে সংশ্লিষ্ট কমিটি। এ বিষয়ে সাবেক এই আইনমন্ত্রী বলেন, সাক্ষী সুরক্ষার বিষয়টি যদি সেখানে যথাযথ আসে তাহলে এতে কোনো অসুবিধা আছে বলে আমি মনে করি না।

আদালতের নির্দেশনা : গত জুলাই মাসে একটি ধর্ষণ মামলার রায়ের অভিমতে হাইকোর্ট বলেছেন, ধর্ষণ মামলার আসামিরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেপরোয়া ও দুর্দান্ত প্রকৃতির। এরা ভিকটিম ও তার পরিবারের ওপর চাপ-প্রভাব বিস্তার করে। আদালতে সাক্ষ্য প্রদানে ভয়ভীতি, প্রলোভনসহ বিভিন্ন ধরনের কূটকৌশল অবলম্বন করে। তাই অবিলম্বে সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন। হাইকোর্ট প্রত্যাশা করে দ্রুততম সময়ে ওই বিষয়ে সরকার আইন প্রণয়ন করবে।

এর আগে ২০১৫ সালের ৭ ডিসেম্বর সাক্ষী সুরক্ষা আইন করার উদ্যোগ নিতে স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ফৌজদারি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য এবং নির্ধারিত তারিখে সাক্ষীর উপস্থিতি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই আইন করার নির্দেশ দেয়া হয়।

একটি হত্যা মামলার আসামির জামিন শুনানির সময় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি আমীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন। স্বরাষ্ট্র সচিব ও আইন সচিবকে এই আদেশ পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

বিভিন্ন স্থানে সাক্ষীর ওপর হামলা : ২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন কেশবপুরের নওশের আলী খান হত্যা মামলার প্রধান সাক্ষী নেপাল চন্দ্র হোড়ের (৭৩) ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত একই গ্রামের শহিদুল ইসলাম সরদারকে আটক করে পুলিশ।

২০১৬ সালের ১ জুন লক্ষ্মীপুর জেলা জজ আদালত চত্বরে মামলার বাদী ও সাক্ষীসহ তিনজনকে মারধরের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় দু’জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

২০১১ সালের ২৭ জানুয়ারি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার বেতমোর ইউনিয়নের নিজামিয়া বাজারে ধর্ষণ মামলার প্রধান সাক্ষী মো. হালিম শরীফকে এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও ধর্ষণ মামলার আসামিরা মারধর করে।

পুরান ঢাকার বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী রিকশাচালক রিপন সরদার। ২০১৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্য দিতে শরীয়তপুর থেকে সে ঢাকায় আসে। সদরঘাটে পৌঁছার পর তাকে পুলিশের এক সদস্য মারধর করে।

মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম ওরফে সিরু বাঙ্গালী।

সিরু বাঙ্গালী ট্রাইব্যুনালে জানিয়েছিলেন, সাক্ষ্য না দেয়ার জন্য তাকে ১ কোটি টাকা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। এটা অগ্রাহ্য করে সাক্ষ্য দেয়ায় তাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। এ নিয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরিও করেছিলেন তিনি।