সরকারের সহায়ক হিসেবে কাজ করছে ৬৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠান

করোনা মোকাবেলায় সাড়াদানকারী বেসরকারি সংস্থার মধ্যে ৬৮ শতাংশ সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমে সহায়ক অংশীজন হিসেবে কাজ করেছে। এর মধ্যে মধ্যে ৯২ শতাংশ সরকারের করোনাবিষয়ক সচেতনতামূলক কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল।

১৮.৩ শতাংশ সংস্থা সরকার ঘোষিত কার্যক্রম বাস্তবায়নে রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা এবং স্থানীয় প্রভাবশালীদের প্রভাবের শিকার হয়েছে। ২৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান কর্মসূচি বাস্তবায়নে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অসহযোগিতার মতো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণায় এসব কথা বলা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ‘করোনা মোকাবেলায় সাড়াদানকারী বেসরকারি সংস্থাগুলোর ভূমিকা : চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি ভার্চুয়ালি প্রকাশ করে টিআইবি। প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।

প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট মোহাম্মদ আব্দুল হান্নান সাখিদার। গবেষণাটি তত্ত্বাবধান করেছেন একই বিভাগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো শাহজাদা এম আকরাম। সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের কো-অর্ডিনেটর মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সামনে আসা চ্যালেঞ্জ উত্তরণে ১০ দফা সুপারিশও করেছে সংস্থাটি।

গবেষণার ফলাফলে বলা হয়, গবেষণার আওতায় আনা প্রতিষ্ঠানগুলোর ৬৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠান ত্রাণ বিতরণ এবং ৪৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠান আর্থিক সহায়তামূলক, প্রায় ৩০ শতাংশ করোনাসংক্রান্ত স্বাস্থ্যসেবা এবং ৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠান করোনায় মৃত ব্যক্তিদের সৎকার সংক্রান্ত কার্যক্রমে সরকারের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কাজ করেছে। সরকারঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে প্রান্তিক ও নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো তুলনামূলক বেশি কার্যকর ছিল।

এতে বলা হয়, নিয়মিত আয়ের উৎস না থাকা, দাতা সংস্থা কর্তৃক তহবিল হ্রাস এবং ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়ায় করোনা মোকাবেলায় কর্মসূচি বাস্তবায়নে সংস্থাগুলোর তহবিলসংকট ছিল মূল চ্যালেঞ্জ। করোনা অতিমারির সময়েও ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে উপকারভোগীর তালিকা প্রণয়নে স্থানীয় ক্ষমতাশীলদের নেতিবাচক প্রভাব ছিল। প্রায় ২৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান কর্মসূচি বাস্তবায়নে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অসহযোগিতার মুখোমুখি হয়েছে। ৫৩ শতাংশ সংস্থা উপকারভোগী নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। দুটি প্রতিষ্ঠান জেলা প্রশাসন কর্তৃক উপকারভোগীর তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ করে। ৪১ শতাংশ প্রতিষ্ঠান দুর্গম এলাকায় ত্রাণ পৌঁছানোর ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে।

গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত বেসরকারি সংস্থাগুলোর উপকারভোগীর ১৪ শতাংশ (৮১ জন) সাহায্য পাওয়ার জন্য কোনো না কোনো বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার তালিকাভুক্ত হয়েছিল। এদের মধ্যে ৩২.২ শতাংশ তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে অনিয়ম এবং ২০ শতাংশ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে তদবিরের অভিযোগ করেছে।

টিআইবি বলেছে, করোনাকালীন বিভিন্ন মেয়াদে ক্ষুদ্রঋণের কিস্তি আদায় বন্ধ রাখার নির্দেশনা থাকলেও কিছু সংস্থার বিরুদ্ধে কিস্তি আদায়ে চাপ প্রয়োগের অভিযোগ পাওয়া যায়। করোনাকালীন প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বয়হীনতা দেখা গেলেও পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্যসেবা, ত্রাণ বিতরণসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে সমন্বয়ের উন্নয়ন ঘটলেও বেসরকারি সংস্থা ও তদারকি সংস্থার অভিযোগ নিষপত্তি ব্যবস্থায় ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়।

সংস্থাটির গবেষণায় অংশ নেওয়া বেসরকারি সংস্থাগুলোর ৬৬.২ শতাংশ প্রতিষ্ঠান করোনা পরিস্থিতিতে কোনো না কোনো ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। ৩৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের চলমান প্রকল্পগুলো থেকে করোনার সময়ে দাতা সংস্থাগুলো গড়ে প্রায় ২৫ শতাংশ তহবিল হ্রাস করে। ফলে এর ৮৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের প্রকল্পের ব্যয় সংকোচন করতে হয়। তখন চলমান প্রকল্প স্থগিত করে, কর্মীদের বেতন-ভাতা কমিয়ে অথবা কর্মী ছাঁটাই করে তাঁদের সংকুচিত তহবিলের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করতে হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এই সময়ে আর্থিকসংকটের মধ্যে পড়তে হয়েছে।

করোনা মহামারি মোকাবেলায় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘গবেষণায় আমরা দেখেছি, তহবিলসংকটসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও করোনা মোকাবেলায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো শুদ্ধাচার বজায় রেখে মানুষের জন্য বিভিন্ন মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পেরেছে। তবে করোনাকালে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তা কার্যক্রমের ক্ষেত্রে তহবিলসংকট ছিল মূল চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে দাতা সংস্থার একাংশ কর্তৃক অর্থ সহায়তা সংকোচন করার কারণে অনেক বেসরকারি সংস্থাকেই কর্মসূচি স্থগিত বা বাতিল, কর্মীদের বেতন হ্রাস এমনকি কর্মী ছাঁটাইয়ের মতো পদক্ষেপ নিতে হয়। ভবিষ্যতে মহামারির মতো পরিস্থিতিতে শুদ্ধাচার বজায় রেখে নিজস্ব দক্ষতা কাজে লাগিয়ে যথাযথ ভূমিকা পালনে সংস্থাগুলো যেন পর্যাপ্ত তহবিল পায়, তা নিশ্চিত করতে সরকার ও দাতা সংস্থার উদ্যোগে দুটি পৃথক আপৎকালীন সহায়তা তহবিল গঠন করতে হবে।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ