সরকারের লাগামহীন দুর্নীতির খেসারত দিচ্ছে সাধারণ জনগণ: মির্জা ফখরুল


সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক:

সরকারের লাগামহীন দুর্নীতির খেসারত দিচ্ছে সাধারণ জনগণ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকারের লাগামহীন দুর্নীতি আর হরিলুটের কারণে এই খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি।  দলটির দাবি, সরকারের বিশেষ আইনে স্থাপিত রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল ১৯টি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর দু-তিন বছর পর বন্ধ হওয়ার কথা। কিন্তু প্রয়োজন ছাড়াই তা এখনো চালু আছে। বেশকিছু রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদন না করেও ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ বিপুল অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ ছাড়াই সরকারকে এ পর্যন্ত ৯০ হাজার কোটি টাকা গচ্চা দিতে হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব ব্যবসায়ীদের পকেটেই গেছে ৬০ হাজার কোটি টাকা।

শনিবার দুপুরে গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চিত্র তুলে ধরে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এসব কথা বলেন।

তিনি দাবি করেন, ১২টি কোম্পানি কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টের মাধ্যমে অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। এটি কুইক রেন্টালের নামে কুইক লুটপাট। যথাসময়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সব দুর্নীতির তদন্ত করে অবশ্যই দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হবে। বিএনপির মহাসচিব বলেন, আগামীতে ক্ষমতায় গেলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবারহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কোম্পানির চুক্তি বাতিলসহ ১২ দফা পদক্ষেপ তুলে ধরেন। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বর্তমান অবস্থার জন্য সরকারের সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, আত্মঘাতী চুক্তি ও অপরিনামদর্শী পরিকল্পনাকে দায়ী করেন তিনি।

 

ব্যর্থতার জন্য সরকারের পদত্যাগের দাবি পুনর্ব্যক্ত করে মির্জা ফখরুল বলেন, বিদ্যুৎ খাতের এ বিপর্যয়, রিজার্ভের সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনৈতিক নৈরাজ্য ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনগণের নাভিশ্বাসের দায় নিয়ে বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকারকে অনতিবিলম্বে পদত্যাগের দাবি জানাচ্ছি। তা না হলে দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণই এই সরকারকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করবে।

মির্জা ফখরুল বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে যে ২০২২ সালে এসে ক্যাপাসিটিসহ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে এবং সর্বোচ্চ উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। ১০ জুলাই সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ১১ হাজার ৭৬০ মেগাওয়াট। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার উচ্ছ্বাস উদ্যাপন করা হলো ঘটা করে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এত নজিরবিহীন অর্থ ব্যয় করেও কেন পুনরায় দেশের জনগণকে লোডশেডিংই বরণ করতে হচ্ছে। এর উত্তর একটাই, এ খাতে সরকারের লাগামহীন দুর্নীতি আর হরিলুট।

ক্যাপাসিটি চার্জ জনস্বার্থবিরোধী এবং নীতিমতো অপরাধ উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, বিদ্যুতের চাহিদা সঠিকভাবে নির্ধারণ না করে চাহিদার অনেক বেশি পাওয়ার প্ল্যান্টের সঙ্গে চুক্তি করে দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবসায়ীদের অর্থ লুট করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। এই সরকারের নীতি একটাই, তা হচ্ছে জনগণের সম্পদ লুট করে নিজের সম্পদ বৃদ্ধি করা এবং বিদেশে সেই সম্পদ পাচার করা।

তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে মোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাত্র ৪৩ শতাংশ ব্যবহার করা হয়। অবশিষ্ট ৫৭ শতাংশ অলস বিদ্যুৎ বসিয়ে রেখে কেন্দ্রের ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যুৎ না কিনে গত অর্থবছরে বিল পরিশোধ করা হয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা, তার আগের বছর করা হয়েছে ১৪ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে এ খাতে ব্যয় হয়েছে ২১ হাজার ৬শ কোটি টাকা। ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ বেড়ে হয়েছে ১৮ শতাংশ। ক্রমেই ক্যাপাসিটি চার্জের বিল বেড়েই যাচ্ছে।

বিএনপির মহাসচিব বলেন, এখানেই শেষ নয়। বর্তমানে বাড়তি উৎপাদন ক্ষমতার মধ্যে আরও বিদ্যুৎকেন্দ্র আসছে। এতে অলস খরচ আরও বাড়বে। বর্তমানে ১৩ হাজার ৩৮৭ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩৫টি কেন্দ্র নির্মাণাধীন। ২০২৬ সালের মধ্যে এসব কেন্দ্র উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। ডিসেম্বরে ৩ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক উৎপাদনে আসতে পারে। নির্মাণাধীন কেন্দ্রগুলোর মধ্যে বেসরকারি খাতে রয়েছে ৯ হাজার মেগাওয়াট। এই কেন্দ্রগুলোর উল্লেখযোগ্য গ্যাসভিত্তিক। এখনই গ্যাস সংকটে প্রায় ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। আগামী ৪ বছরে আরও ১৩ হাজার মেগাওয়াটের কেন্দ্র উৎপাদনে এলে বসে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়বে। সব মিলে বিদ্যুৎ না কিনেও অতিরিক্ত টাকা পরিশোধের অঙ্ক অনেকগুণ বেড়ে যাবে।

আদানি গ্রুপের ১ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির সমালোচনা করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, চুক্তির ২৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে ওই গ্রুপকে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি পরিশোধ করতে হবে; যা দিয়ে ৩টি পদ্মা সেতু, ৯টি কর্ণফুলী টানেল কিংবা ২টি মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য যথেষ্ট।

তিনি অভিযোগ করেন, ভোক্তাদের টাকায় গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য গঠন করা গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ) থেকে এলএনজি আমদানিতে ২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে সরকার। এই টাকাটা আসলে ঋণের নামে নিয়ে নেওয়া হলো। ভোক্তারা এটিকে বৈধ মনে করে না।

পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, কোন বিদ্যুৎ না দিলেও এ পর্যন্ত ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে চীনা ঋণে বাস্তবায়নাধীন পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি পরিশোধ করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, সঞ্চালন লাইনের কাজটি সম্পন্ন করা হলো না কেন? বিদ্যুৎ না কিনেও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে ৫ হাজার কোটি টাকা কেন পরিশোধ করা হলো? অনেকেই মনে করেন ইচ্ছাকৃতভাবে বিদ্যুৎ না কিনেও যোগসাজশে অর্থ লুটের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।

ক্ষমতায় গেলে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বাতিলসহ ১২টি পদক্ষেপের কথাও তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা বিদ্যুতের এ সমস্যার সমাধান করব। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবারহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনসহ সব কালাকানুন বাতিল করব। স্বচ্ছ প্রতিযোগিতামূলত আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও অন্যান্য কাজ সম্পাদন করা হবে। চাহিদা অনুযায়ী পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। উৎপাদনের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন অতি দ্রুত স্থাপন করা হবে। বাপক্সে ও অন্যান্য সরকারি সংস্থার মাধ্যমে দেশীয় খনিজ ও গ্যাস উত্তোলনের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহন করা হবে। একই সঙ্গে দেশীয় প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ করে তুলতে উপযুক্ত উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

এছাড়া বঙ্গোপসাগরে সম্ভাবনাময় গ্যাস-পেট্রোলিয়াম ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ উত্তোলনে দ্রুত কাযর্করী ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সব দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি, জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভরতা কমিয়ে ক্রমান্বয়ে মোট উৎপাদনের ৫০ শতাংশ নবায়নযোগ্য শক্তি নির্ভর জ্বালানি নীতি গ্রহণ, বেইস লোড পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের মাধ্যমে স্বল্প ব্যয়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন গড়ে তোলা, বৃহৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর সংস্কার এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ঘোষিত ভিশন-২০৩০ তে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়নের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার কথা তুলে ধরেন বিএনপির মহাসচিব। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন-সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিহউল্লাহ।

সূত্র: যুগান্তর