সরকারী অনুদানে স্কুলের একাডেমিক ভবন, নামকরণ হলো এমপি বাদশার বাবার নামে

নিজস্ব প্রতিবেদক :
স্কুলের একাডেমিক ভবন নির্মাণ করেছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। ছয় তলা এই ভবন নির্মাণে খরচ হয়েছে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা। অথচ সরকারী টাকার এই ভবনের নামকরণ করা হয়েছে এমপির বাবার নামে। এমপিকে খুশি করতেই এমন কাণ্ড ঘটানো হয়েছে রাজশাহী কোর্ট একাডেমিতে। এ ঘটনায় রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করেছেন শিক্ষা কর্মকর্তা। তবে তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখে আইনী ব্যবস্থা নেয়া কবে বলেও জানিয়েছেন।

রাজশাহী মহানগরীর কোর্ট এলাকায় একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য জমি দিয়েছিলেন স্থানীয় কয়েকজন শিক্ষানুরাগী। তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিজের নামে স্কুলটির নামকরণ করেন- মিউনিসিপ্যাল সোবহান এইচ.ই স্কুল। ১৯৫৩ সালের ৩১অক্টোবর স্কুলটি উদ্বোধন করেছিলেন সে সময়ের বিভাগীয় কমিশনার রহমতউল্লাহ। সেই উদ্বোধনীটি ফলকটি এখনো আছে স্কুলে। তবে ব্যক্তির নাম থাকায় স্কুলের জন্য সরকারী অনুদান পেতে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। পরে ম্যাজিস্ট্রেট সোবহানের নাম বাদ দিয়ে শুধু মিউনিসিপ্যাল রাখা হয়। আরো পরে মিউনিসিপ্যাল শব্দটিও ফেলে নতুন নাম হয় রাজশাহী কোর্ট একাডেমি।

২০১১সালের ৯ এপ্রিল রাজশাহী কোর্ট একাডেমির একতলা একাডেমিক ভবনের উদ্বোধন করেন সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। এরপর ২০১৯সালের ৭এপ্রিল ওই ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন রাজশাহী সদর আসনের এমপি ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা ফজলে হোসেন বাদশা। এই ভবনটিও হয়েছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের বাস্তবায়নে। ২০২০সালে নির্বাচিত বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় রাজশাহী কোর্ট একাডেমির ছয় তলা ভবন নির্মাণ করা হয়। ২০২২সালের ২৮মার্চ ভবনের উদ্বোধন করেন ফজলে হোসেন বাদশা এমপি। এই ভবন নির্মাণে খরচ হয় প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা। এটিও বাস্তবায়স করে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। সরকারি টাকায় নির্মিত এই ভবনের নাম রাখা হয়েছে এমপি বাদশার বাবা অ্যাডভোকেট খন্দকার আশরাফ হোসেনের নামে।

রাজশাহী কোর্ট একাডেমির প্রধান শিক্ষক সফিকুল ইসলাম বাবু বলেন, ‘এমপি সাহেব বলেন নি। ম্যানেজিং কমিটি সিদ্ধান্তে তাঁর বাবার নামে নামকরণ করা হয়েছে। স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি রফিকুজ্জামান বেল্টু সভায় অ্যাডভোকেট খন্দকার আশরাফ হোসেনের নামে ভবনটির নামকরণের প্রস্তাব করেন। সভায় তা অনুমোদিত হয়েছে। ওই সভায় কণ্ঠশিল্পী অ্যান্ড্রু কিশোরের নামেও স্কুলের তিন তলা পুরাতন ভবনের নামকরণের সিদ্ধান্ত হয়। অ্যান্ড্রু কিশোর এই স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন। অ্যাডভোকেট খন্দকার আশরাফ হোসেন স্কুল প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে তিনি স্কুলের জন্য জমিদাতা বা মোটা অংকের কোনো টাকাও অনুদান দেন নি বলে জানান প্রধান শিক্ষক। তাহলে কেন অ্যাডভোকেট খন্দকার আশরাফ হোসেনের নামে এই ভবনের নাম হলো জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘এটি জানা নেই। নামকরণের পর ভবনে ২৫ হাজার টাকা খরচে নামের সাইনবোর্ড লাগানো হয়। পরে আমরা বিষয়টি এমপি মহোদয়কে জানিয়েছি। তবে এতে তিনি কোনো আপত্তি করেন নি বা আমাদের নিরুৎসাহিতও করেন নি’।

এমপির বাবার নামে ভবনের নাম রাখার কথা স্বীকার করলেও এর দায় নিতে চান না স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি রফিকুজ্জামান বেল্টু। তিনি বলেন, আমি অল্প কিছু দিন হলো সভাপতির দায়িত্ব পেয়েছি। অ্যাডভোকেট খন্দকার আশরাফ হোসেনের নামে কীভাবে নামকরণ হলো তা জানি না। তবে হয়েছে। যেভাবেই হোক হয়েছে। অ্যাডভোকেট খন্দকার আশরাফ হোসেন এক সময় এই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ছিলেন। সে কারণেও হতে পারে। আমি তা বলতে পারবো না’।

ওই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির বিদ্যোৎসাহী সদস্য সিটি কর্পোরেশনের ১নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর রজব আলী। সরকারী টাকায় নির্মিত ভবন কীভাবে এমপির বাবার নামে হলো- তাও তার কাছে পরিস্কার নয়। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ‘স্কুলের ছয় তলা ভবন খন্দকার আশরাফ হোসেনের নামে কীভাবে হলো জানি না। ওখানকার হেড মাস্টার বাবু আমার বন্ধু। আমি স্কুলের তেমন খোঁজ-খবরও রাখি না। কখনো মিটিংয়ে গেলে স্বাক্ষর করে চলে আসি। কাজেই আমি বলতে পারবো। আমি এখনো দেখিই নি’।

স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির আগের মেয়াদের সভাপতি ও স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর কামরুজ্জামান কামরু বলেন, এমপির বাবার হওয়ার কারণে খন্দকার আশরাফ সাহেবে নামে নামকরণ হতে থাকতে পারে। তবে এটি হয়েছে আমার মেয়াদের পরে। অতি উৎসাহীরা এমপিকে খুশি করতে এই কাজ করেছে’।

তবে রাজশাহী জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ডিইও) মোহা. নাসির উদ্দিন জানিয়েছেন, সরাসরি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোনো ব্যক্তির নামে করতে চাইলে ১০লাখ টাকা জমা দিতে হবে। এটি সরকারী নিয়ম। সরকারের প্রজ্ঞাপনও রয়েছে। তবে জাতীয় নেতা ও সাত বীর শ্রেষ্ঠদের ক্ষেত্রে তাদের পরিবার বা ট্রাস্টের অনুমোদন লাগবে। কিন্তু একটি স্কুলের একাডেমিক ভবনের নাম কীভাবে তারা স্থানীয় ব্যক্তির নামে করলেন তা জানা নেই। সরকারী টাকায় নির্মিত একাডেমিক ভবন কোনো ব্যক্তির নামে করার সুযোগ নেই। এ বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে’।

বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের রাজশাহী শাখার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, খন্দকার আশরাফ ভাসানীর ন্যাপ করতেন। আইনজীবী ছিলেন। কিন্তু এমন কোনো বড় ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। রাজশাহীর বহু প্রখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন। তাঁদের নামে কোনো কিছু নেই। এগুলো গত ১৫-২০ বছরের ক্ষমতার অপসংস্কৃতি।

তবে দেশের বাইরে চিকিৎসাধীন থাকায় ফজলে হোসেন বাদশা এমপির বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয় নি।