সরকারি ওষুধ চুরি-পাচারের মচ্ছব

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) গেল শুক্রবার আসামের ধুবরা এলাকা থেকে ১০ হাজার স্বল্পমাত্রার গর্ভনিরোধক বড়িসহ দুই নারীকে আটক করেছে। সুখী নামের ওই বড়ি চোরাই পথে পাচার হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। সুখী বড়ি বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব ব্র্যান্ডের জন্মনিরোধক, যা এ দেশের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের আওতায় কেবল দেশের বিবাহিত নারীদের মধ্যে বিনা মূল্যে বিতরণের জন্য সংরক্ষিত।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর বছরে প্রায় ১১ কোটি সাইকেল বা ৩০৮ কোটি সুখী বড়ি কিনে থাকে দেশের একাধিক ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। এ বছরও প্রায় ১১০ কোটি টাকার সুখী বড়ি কিনছে সরকার।

শুধু এবারই নয়, মাঝেমধ্যেই সুখী বড়ি ধরা পড়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। রাজ্যটির সীমান্তবর্তী এলাকার ওষুধের দোকানেও বাংলাদেশ সরকারের সুখী বড়ি বেচাকেনা হয় বলে জানা যায় পশ্চিমবঙ্গের একাধিক সূত্র থেকে। এমনকি বেশ কয়েকবার মিয়ানমারে পাচারের সময় সীমান্তে এ বড়ি ধরা পড়েছে।

কেবল পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরেরই নয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতায় বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের রোগীদের জন্য সরবরাহকৃত সরকারি ওষুধও চুরি হয়ে বেরিয়ে যায় হাসপাতালের বাইরে। বিনা মূল্যে বিতরণের এসব ওষুধ বেচাকেনা হয় দেশের ভেতরের বিভিন্ন ওষুধের দোকানে।

র‌্যাব ও পুলিশের সূত্রগুলো জানায়, সব ক্ষেত্রেই সরকারি ওষুধ হাসপাতালের বাইরে কিংবা দেশের বাইরে পাচারে জড়িত থাকে হাসপাতাল বা মাঠপর্যায়ের সরকারি কর্মীরা। যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা দাবি করেন, তাঁরা এসব বিষয়ে কিছুই জানেন না।

জানতে চাইলে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (এফএসডি) ডা. মো. সরোয়ার বারী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নিয়ম অনুসারে আমাদের এ ওষুধ দেশের বাইরে তো দূরের কথা দেশের ভেতরেও নির্দিষ্ট মানুষের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। তাই আদৌ আমাদের পিল চুরি বা পাচার হচ্ছে কি না সেটা দেখতে হবে। যদি হয়ে থাকে তবে সে অনুসারে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ডা. সরোয়ার জানান, সারা দেশে বছরে প্রায় ১১০ মিলিয়ন সাইকেল সুখী বড়ির চাহিদা রয়েছে। প্রতি সাইকেলে ২৮টি করে বড়ি থাকে। অধিদপ্তরের ক্রয় শাখার মাধ্যমে প্রতিবছর ওই বড়ি কেনা হয় দেশের দুটি বেসরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। এবারও প্রায় ১১০ কোটি টাকার সুখী বড়ি কেনার প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সাবেক এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশের জন্মনিরোধক বড়ি সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে বা মিয়ানমারে পাচার হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। এই খবর যে অধিদপ্তর জানে না সেটাও ঠিক নয়। বরং তারা জেনেও না জানার ভান করে থাকে। মাঠপর্যায়ের এক শ্রেণির অসাধু কর্মী ও স্টোরের লোকজন জড়িত থাকার অভিযোগও অনেক পুরনো। এটা হচ্ছে কেন্দ্রীয় দপ্তরের পর্যাপ্ত নজরদারির অভাবে। দেশে বছরে ১১০ মিলিয়ন সুখী বড়ি লাগার কথা নয়। এসব ওষুধ নিয়ে জোরালো কোনো অনুসন্ধানও হয় না।

ওই অধিদপ্তরের আরেক সূত্র জানায়, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি এলাকার ডিপোতে জন্মনিরোধক বড়ি পৌঁছে দেয়। সেখান থেকে তা মাঠপর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয় পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে। আর সবশেষে নির্দিষ্ট হিসাব অনুসারে তা যায় কর্মীদের হাতে। এই পুরো প্রক্রিয়ার কোনো না কোনো পর্যায়েই ওষুধগুলো চুরি হয় এবং পাচার হয়। কর্মীরা কাগজ-কলমের হিসাব ঠিকঠাক মতো দেখালেও বাস্তবে নানা ধরনের নয়ছয় আছে বলেই দেশের বাইরে মাঝেমধ্যেই এ বড়ি ধরা পড়ার খবর আসছে। সরকার ১১ টাকা দরে সুখী বড়ি কিনলেও ভারতে এ জেনেরিকের বড়ির দাম প্রায় দ্বিগুণ। চোরাকারবারি চক্র এই সরকারি বড়ি চুরি করে ভারতে একেকটি ১৫-১৬ রুপিতে বিক্রি করে বলে জানা যায়।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মোহাম্মদপুরে র্যাব-২-এর বিশেষ দল ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের সমন্বিত অভিযানে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনের একটি ভবন থেকে বিপুল পরিমাণ সরকারি ওষুধ আটক করা হয়। এক দিন পরে হাজারীবাগ এলাকার আরেকটি ওষুধের দোকানে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা হয় বেশ কিছু সরকারি ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম। উভয় ঘটনায়ই একাধিক ব্যক্তিকে আটক, সাজা ও জরিমানা করা হয়। সর্বশেষ গত রবিবার বগুড়ায় একটি বেসরকারি গুদাম থেকে পুলিশ সরকারি হাসপাতালের বিপুল পরিমাণ ওষুধ ও সরঞ্জাম উদ্ধার করে।

জানতে চাইলে র্যাব সদর দপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম বলেন, ‘বিভিন্ন স্থানে চোরাই সরকারি ওষুধ উদ্ধারের সময় আটককৃতদের কাছ থেকে আমরা তথ্য পেয়েছি। যেসব হাসপাতাল থেকে ওই ওষুধ বাইরে এসেছে সেই হাসপাতালেরই কিছু কর্মচারী, কিছু নার্স ও কর্মকর্তা এবং বাইরে একটি অসাধু ব্যবসায়ীচক্র এর সঙ্গে জড়িত। আমরা এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগকেও অবহিত করে থাকি।’

মোহাম্মদপুরে অভিযানের পর র‌্যাব সূত্র জানায়, উদ্ধার হওয়া ওষুধগুলো চুরি হয়েছে জাতীয় অর্থপেডিক্স হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র (নিটর), সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, হৃদরোগ হাসপাতালসহ আশপাশের আরো একাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে।

জানতে চাইলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, ‘স্টোর থেকে ওষুধ চুরির কোনো সুযোগ নেই। মাঝেমধ্যে ওয়ার্ড থেকে কিছু ওষুধ চুরি ঘটনা আগে জেনেছিলাম। এমনকি একপর্যায়ে তিনজন নার্সের ব্যাপারে গোপন তদন্ত করে প্রমাণ পাওয়ায় তাদের ইনচার্জের দায়িত্বে থেকে সরিয়ে দিয়েছি। এই হাসপাতাল থেকে এখন আর কোনো ওষুধ চুরি হয় বলে মনে করি না।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি সব কিছু ডিজিটাল সিস্টেমে নিয়ে আসার। তা না হলে এ ধরনের চুরি রোধ করা কঠিন।’

সরকারি হাসপাতালের ওষুধ চুরির বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক-হাসপাতাল ডা. সত্যকাম চক্রবর্তী বলেন, এ ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি ওষুধ চুরির ঘটনা ধরা পড়েছে। এ ঘটনায় যে হাসপাতালের কেউ না কেউ জড়িত থাকে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এখন থেকে তদন্তে সুনির্দিষ্টভাবে যারা দায়ী হবে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।