সমৃদ্ধির সৌধের নিচে চাপা পড়ছে কারা?

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

এত এত দালান। ইট ও সুরকির এত দারুণ সব কারুকাজ। এসব কারুকাজের মধ্য দিয়েই চলে ব্যস্ত মানুষের চলাচল। দাঁড়ানোর সময় নেই কারও। এদিক-ওদিক তাকালেই নজরে আসে, ‘সাবধান, ঊর্ধ্বমুখী নির্মাণকাজ চলিতেছে’। অর্থাৎ দালানগুলো আরও বড় হচ্ছে। পুষ্টি পাচ্ছে তারা। দালানের ছায়া দালানকেই গিলে খাবে একদিন। নিরাপদ দূরত্ব বলেও হয়তো কিছু থাকবে না আর। শুধু দালান কেন, উঠছে ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ইত্যাদি এবং ইত্যাদি। উঁচু উঁচু এসব স্থাপনার মতো মানুষগুলো উঁচু হয়ে উঠতে পারছে কি? মানুষ ধারণাটি উঁচু হতে পারছে কি?

অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে নগরেও এল বসন্ত। নিয়ম মেনে সবাই মাখল বাসন্তী রং। ঋতুর উৎসব কিছুটা স্বস্তি দিয়ে গেল। তারপরই এল বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। তরুণ রঙে হাসল পৃথিবী। দূর-অদূরের হত্যা ও মৃত্যুর ইতিহাস, আর প্রশ্নময় বর্তমানকে ক্ষণিকের জন্য পাশ কাটিয়ে সবাই নিল ভালোবাসার পাঠ। হাতবদল হওয়া ফুলের সঙ্গে সঙ্গে মনও বদল হলো নিশ্চয় অনেক। অথচ এই সব ভালোবাসা, এসব ফাল্গুন ও উন্নয়নের ফাঁকে খিলগাঁও ফ্লাইওভারের নিচে নিঃসঙ্গ মরে পড়ে থাকতে হলো এক বৃদ্ধাকে। তাঁর জন্য ওই সব দালানে কোনো আশ্রয় ছিল না। ছিল না ফাল্গুন, ছিল না ভালোবাসা।

এই বৃদ্ধার সঙ্গে প্রায়ই দেখা হতো আসা-যাওয়ার পথে। নাম জানা হয়নি কখনো। থাকতেন খিলগাঁও ফ্লাইওভারের কোটরে। একেবারে উন্নয়নের ছায়ায়। একটি চৌকি রয়েছে সেখানে। তার পাশেই উন্মুক্ত শৌচাগার। তাঁর আগে এখানেই দেখা মিলত আরেক বৃদ্ধের। তাঁকে অনেক দিন দেখি না। হয়তো তিনিও মারা গেছেন। নাম জানা নেই তাঁরও। দুজনের সঙ্গেই চলতি পথে চোখাচোখি, দু-একটি কথা ও হাসি বিনিময় ছাড়া আর কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়নি। হয়ও না সাধারণত। পথেই মরে পড়ে থাকা বৃদ্ধাকে দেখে মাথায় প্রশ্ন এল, মাথাপিছু আয় যেন কত?

গত সেপ্টেম্বরেই তো খবর বের হলো, বাংলাদেশের মানুষের এখন বার্ষিক মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৭৫১ ডলার। বর্তমান বিনিময় মূল্য ধরলে মাসে জনপ্রতি আয় অন্তত ১২ হাজার টাকা হওয়ার কথা। ৭ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধির গল্প তো অতিপ্রচারে ক্লিশেই হয়ে গেছে। একটা বড় দম নিই। তারপর মনে হয়, ‘এই পথে মরে থাকা বৃদ্ধারও তবে মাসে ১২ হাজার টাকাই আয় ছিল!’

না, মাথাপিছু আয় ব্যক্তির আয় নয়। এটি একটি দেশের মোট আয়কে জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে বের করা হয়, যাকে দেখানো হয় উন্নয়নের চিহ্নবাহী একটি সংখ্যা হিসেবে। সরকারি বক্তব্য বিভিন্ন মাধ্যমে ভেসে ভেসে এই উন্নয়নের প্রতীককে প্রচার করে। আর মানুষ দম নেয়; ভাবে, ‘আমরাও একদিন।’ এই আশ্বাস একদিন দীর্ঘশ্বাস হয়ে যায়।

‘বৈষম্য’ শব্দটিকে এড়িয়ে সসংকোচে হেঁটে হেঁটে চলার পথেই দেখা মিলল আরেক নারীর সঙ্গে। জীবিত। প্রায় বসনহীন বসে পথের ওপর। পাশেই বিজিএমইএ ভবন। তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের সংগঠনের ক্ষমতার চিহ্নবাহী ভবনটির পাশেই এই নারীর উপস্থিতি কি তির্যক প্রশ্ন নয়? ভাবনায় ছেদ পড়ে শিশুর হাসিতে। ওই নারীর সামনেই একটি শিশু। তাদের মাঝখানে নানা ছেঁড়া-খোঁড়া কাগজ, যার দু-একটিতে আবার গার্মেন্টস শ্রমিকদের দাবিসংবলিত স্লোগান দেখা গেল। নিশ্চয় পোস্টার বা ফেস্টুন ছিল একসময়। একই স্লোগান হয়তো আবার উঠে আসবে অন্য কোনো ফেস্টুন বা পোস্টারে। এখানে তো প্রায়ই জটলা করতে হয় শ্রমিকদের। দিতে হয় স্লোগান, যার প্রয়োজন কখনো ফুরায় না।

‘আমাদের নগরগুলো যত দৃষ্টিনন্দন হয়, ততই গ্রামাঞ্চল বিরান হতে থাকে। বাড়ে অনাবাদি জমির পরিমাণ। নাগরিক হয় ভিখারি কিংবা ডাকাত। আর ওদের জীবনের ইতি হয় ফাঁসির মঞ্চে অথবা আবর্জনা স্তূপে। এভাবে রাষ্ট্র একদিকে ফুলেফেঁপে ধনী হয়, অন্যদিকে হয় জনশূন্য বিরান। প্রবল প্রতাপ, সাম্রাজ্য—এভাবে অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে তোলে সমৃদ্ধির সৌধ, আর ডেকে আনে জনজীবনে অবলুপ্তি।’ আড়াই শ বছর আগে ফরাসি দার্শনিক জ্যঁ জ্যাক রুশো কথাগুলো বলেছিলেন ‘ডিসকোর্স অন দ্য অরিজিন অব ইনইকুয়ালিটি’ বইয়ে। রুশোর এই কথা কী দারুণভাবে সত্য। আবর্জনা স্তূপে মরে পড়ে থাকা ওই বৃদ্ধা, আর বিজিএমইএ ভবনের সামনের ওই প্রায় বসনহীন নারী কী অস্বস্তিকরভাবে এই সত্যকে মনে করিয়ে দিয়ে গেলেন।

নগরগুলো একটু একটু করে বাড়ছে। নানা সেবা বিস্তৃত হচ্ছে। বড় বড় প্রকল্প হচ্ছে। নিম্নমধ্যম থেকে মধ্যম, মধ্যম থেকে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হতে বাংলাদেশ ছুটছে দুর্বার গতিতে! সরকারি হিসাবে দারিদ্র্য জাদুঘরের দিকে ছুটছে রুদ্ধশ্বাসে। চমৎকার। পথের ধারে তবে মরছে কারা? বিজিএমইএর দাম্ভিক ভবনের পাশের ফুটপাতে এলোচুলে পা ছড়িয়ে বসনহীন বসে থেকে রাষ্ট্রকে তবে উলঙ্গ করছে কারা?

কিছুদিন আগে প্রকাশিত ওয়েলথ এক্সের জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশে অতিধনী ও ধনীর সংখ্যা বাড়ছে। এই বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। গর্বের কথা। এই গর্বের মূর্তিতে ছাই মাখিয়ে দিচ্ছে তবে কারা?

এসব অস্বস্তিকর প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র বলতেই পারে, ‘আয় বৈষম্য বৃদ্ধির কথা তো অস্বীকার করা হচ্ছে না। কিন্তু একেবারে নিম্ন স্তরে থাকা মানুষেরও জীবনমান উন্নয়নের তথ্যটিও তো মিথ্যে নয়।’ না মিথ্যে নয়। বৈষম্যের বিষয়টিও স্বীকার করা হচ্ছে, এও সত্য। কিন্তু এও তো সত্য, শুধু ‘বৈষম্য’ শব্দটি দিয়েই এখানে ‘প্রকৃত বৈষম্য’কে আড়াল করা হচ্ছে। অন্য অনেক কিছুর মতোই ‘বৈষম্য’ শব্দটিরও এক ধরনের বিমূর্তায়ন ঘটে গেছে, যা দিয়ে আর কোনো সত্যাসত্য হিসাব সাধারণ মানুষের সামনে আসছে না। ঠিক যেভাবে অর্থনীতির অসংখ্য ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফ ও সংখ্যা ঢেকে দিচ্ছে লাখো মানুষের মুখকে। এত এত দালানের ভিড় তাদের গিলে খাচ্ছে; আশ্রয় দিচ্ছে না। এই মুখগুলো আর কিছুই বলছে না, বলতে পারছে না…। রাষ্ট্র ঘোষিত অসংখ্য উন্নয়ন সমীকরণেও আর তারা থাকছে না। রাষ্ট্রনির্মিত সমৃদ্ধির সৌধের তলায় এসে জড়ো হচ্ছে সবহারা হাজারো মানুষ। রাজধানীর যেকোনো পথে চোখ খুলে হাঁটলেই তাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে, যায়। এসব বেশুমার মানুষের জন্য কোনো ফাল্গুন থাকে না, থাকে না কোনো ভালোবাসা।