সমালোচকদের দৃষ্টিতে সর্বকালের অন্যতম সেরা কয়েকটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম

সিল্কসিটিনি্উজ বিনোদন ডেস্ক:

একটি ডকুমেন্টারি ফিল্মকে কখন আপনি ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বলবেন? ডকুমেন্টারিটি দেখার পর তার কথা অন্যদের সামনেও বলতে বাধ্য হবেন, দীর্ঘদিন তার কথা মনে থাকবে আর পরবর্তীতেও দেখার ইচ্ছা জাগবে- এমন ডকুমেন্টারিকেই তো ভালো বলা যায়। দিনের পর দিন বিশাল বাজেটের কাল্পনিক সব মুভি দেখতে দেখতে হাঁপিয়ে ওঠা দর্শকের জন্য এক ঝলক স্বস্তির হাওয়া নিয়ে আসে ডকুমেন্টারি। বাস্তব জীবনের, ঠিক করে বলতে গেলে আমাদের চারপাশের সমস্যাগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেখার দায়িত্ব নেয়া ডকুমেন্টারিগুলোর দৈর্ঘ্য কম হলেও তা প্রভাব ফেলে বিস্তর। অনেকের কাছে ডকুমেন্টারি খুব কাঠখোট্টা মনে হতে পারে, কিন্তু আমাদের জীবনটাই কী খুব বেশি পুষ্পশয্যা জাতীয়? হালকা ঘরানার সিনেমা দেখে সাময়িকভাবে নিজেকে বিনোদনের হাতে সঁপে দেয়া যায় ঠিকই, কিন্তু তাই বলে দিনশেষে কঠিন বাস্তবতার চপেটাঘাত কি আমাদের সহ্য করতে হয় না? যুদ্ধ, ভালোবাসা, মৃত্যু প্রতিটি বিষয় কিন্তু ডকুমেন্টারিগুলোতেও উঠে আসে, তবে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে। চলুন তবে দেখা নেয়া যাক সমালোচকদের দৃষ্টিতে সর্বকালের অন্যতম সেরা কয়েকটি ডকুমেন্টারি ফিল্মের কথা।

১. আই অ্যাম নট ইওর নিগ্রো (২০১৬)

নিগ্রো- দুই অক্ষরের ছোট্ট শব্দটি হরহামেশা হাসিঠাট্টার ছলে একে অপরকে বলে বসি আমরা। আমাদের কাছে যেটি নিছকই মজার বিষয়, কৃষ্ণাঙ্গদের কাছে তা কী নিদারুণ অভিশাপ, মাত্র ৯৩ মিনিটের একটি ডকুমেন্টারিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন রাউয়াল প্যাক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বর্ণবাদ কতটা ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলেছিল, অভিনেতা স্যামুয়েল এল জ্যাকসনের জবানীতে তা স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক। জেমস বাল্ডউইনের অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি ‘রিমেম্বার দ্য হাউজ’ অনুসরণে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ম্যালকম এক্স, মার্টিন লুথার কিং এবং মেডগার এভারসের মতো নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করা নেতাদের কথা এখানে উঠে এসেছে। ডকুমেন্টারিটি দেখার পর ‘নিগ্রো’ শব্দটিকে আর কৌতুক বলে মনে হবে না।

২. ম্যান অন ওয়্যার (২০০৮)

জেমস মার্শ পরিচালিত ৯৪ মিনিটের একটি ব্রিটিশ-আমেরিকান আত্মজীবনীমূলক ডকুমেন্টারি ফিল্ম ‘ম্যান অন ওয়্যার’। দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া দড়াবাজ ফিলিপ পেটিটের দুঃসাহসিক, আইনের চোখে অনৈতিক পারফরম্যান্সের উপর ভিত্তি করে বানানো হয়েছে এটি। ১৯৭৪ সালে নিউ ইয়র্ক শহরের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের বিখ্যাত টুইন টাওয়ারের মাঝখান দিয়ে দড়ি টাঙিয়ে হেঁটে যান ফিলিপ। এই ঘটনাটিকে ‘শতাব্দীর সেরা শৈল্পিক অপরাধ’ বলে অভিহিত করা হয়। প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী চলা এই পারফরম্যান্সকে কেন্দ্র করে পুলিশ ফিলিপকে গ্রেপ্তারও করে। সে ঘটনার কিছু বিরল ফুটেজ, স্থিরচিত্র, উপস্থিত জনতার সাক্ষাৎকার নিয়ে তৈরি করা এই ডকুমেন্টারিটি বাফটা পুরষ্কার পেয়েছে।

৩. ২০ ফিট ফ্রম স্টারডম (২০১৩)

পাদপ্রদীপের আলোর ঠিক পেছনেই তাদের অবস্থান। বিখ্যাত ব্যান্ড বা সঙ্গীত তারকাদের সুরের সাথে সুর মেলাতে গিয়ে হারিয়ে যায় তাদের নিজেদের সুর। আমরা তাদের নামও জানি না, চিনিও না, কণ্ঠটার সাথে পর্যন্ত পরিচিত না। আস্ত একটা জীবন ব্যাকস্টেজে কাটিয়ে দেয়া ব্যাকআপ সঙ্গীতশিল্পীদের নিয়ে ২০১৩ সালে ডকুমেন্টারি ফিল্ম ‘২০ ফিট ফ্রম স্টারডম’ নির্মাণ করেন মরগান নেভিল। ডকুমেন্টারিটি প্রযোজনা করেন গিল ফ্রিজেন, মূলত তার উদ্যোগ ও আগ্রহেই ব্যাকগ্রাউন্ড সঙ্গীতশিল্পীদের জীবন নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনাটি বাস্তব রূপ পায়। ব্যাকআপ সঙ্গীতশিল্পী ডেরিয়েন লাভ, জুডিথ হিল, মেরি ক্লেটন, লিসা ফিশার, টাটা ভেগা, জো লরিসহ আরও কয়েকজনের অজানা গল্প নিয়ে নির্মিত ডকুমেন্টারিটি ২০১৪ সালে অস্কার জিতেছে।

৪. ইনসাইড জব (২০১০)

২০০৮ সালের আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক মন্দার কথা হয়তো অনেকেরই মনে আছে। ২০১০ সালে সেই মন্দার উপর গবেষণা করে একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম নির্মাণ করেন চার্লস ফার্গুসন। ২০০০ সালের শেষের দিকটা থেকে সময় খুব একটা ভালো যায়নি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। এর পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে ‘নিয়মমাফিক দুর্নীতি’কে দুষেছেন ফার্গুসন। ডকুমেন্টারিটির পাঁচ ভাগে নীতি নির্ধারণের পরিবেশ থেকে শুরু করে ব্যাংকিং খাতের কোন কোন সমস্যার জন্য অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়, তা বিস্তারিতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। ‘ইনসাইড জব’ গবেষণা, জটিল বিষয়ের সহজ ব্যাখ্যাসহ তারা স্টাইলের কারণে মন ছুঁয়ে গেছে সমালোচকদের। অস্কারজয়ী এই ডকুমেন্টারিটি ২০১০ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবেও প্রদর্শিত হয়।

৫. ট্যাক্সি টু দ্য ডার্ক সাইড (২০০৭)

আফগান যুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভয়ঙ্কর ও বর্ণনাতীত শারীরিক, মানসিক অত্যাচার চালিয়েছিল সে কথা সবাই জানে। জানা কথাগুলো অনেক সময় আমরা মুখ ফুটে বলতে পারি না। তাতে প্রশ্রয় পায় অপরাধী, বাড়তে থাকতে অপরাধ। ২০০৭ সালে অ্যালেক্স গিবনী তার ‘ট্যাক্সি টু দ্য ডার্ক সাইড’ নামক আমেরিকান ডকুমেন্টারি ফিল্মটিতে ২০০২ সালের ডিসেম্বর মাসে নিহত ট্যাক্সি ড্রাইভার দেলোয়ারের ঘটনাটি তুলে ধরেছেন। বিচার বহির্ভূতভাবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে আটক করা হয়, পরবর্তীতে আমেরিকান সৈন্যদের অমানবিক অত্যাচারে তিনি মারা যান। ‘হোয়াই ডেমোক্রেসি?’ সিরিজের একটি পার্ট ‘ট্যাক্সি টু দ্য ডার্ক সাইড’। ২০০৭ সালে এটি সেরা ডকুমেন্টারির বিভাগে অস্কার জয় করে।

৬. টাওয়ার (২০১৬)

১৯৬৬ সালের ১ আগস্ট। অস্টিনের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লক টাওয়ার থেকে এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু করে এক বন্দুকধারী। সে ঘটনায় মারা যায় ১৬ জন, আহত হয় প্রায় ৩৬ জন, আর আঁতকে ওঠে গোটা জাতি। পুরো ক্যাম্পাসে তাণ্ডব রচনা করা সে অস্ত্রধারী ৯৬ মিনিটব্যাপী তার ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। রোটোস্কপিক অ্যানিমেশনের সাহায্যে আর্কাইভ থেকে উদ্ধার করা ফুটেজ দিয়ে সাজানো এই ডকুমেন্টারিটিতে উঠে এসেছে সৌভাগ্যবশত বেঁচে ফেরা নাগরিকদের না বলা গল্প, প্রত্যক্ষদর্শীদের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। ২০১৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মুক্তি পায় কিনো লোরবার পরিচালিত ‘টাওয়ার’ ডকুমেন্টারিটি।

৭. ব্ল্যাকফিশ (২০১৩)

তিলিকুম, খুনে তিমি নামে পরিচিত বেশ বিতর্কিত প্রজাতির এক তিমি মাছ। বিশাল বড় বড় দাঁতের এই তিমিগুলোকে আটকে ফেলা হচ্ছে বিশাল সব জলাশয়ে। তার কাছ কেড়ে নেয়া হচ্ছে বন্য পরিবেশ, বাবা-মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে আনা হচ্ছে বাচ্চা তিমিদের। মানুষের উপর তার বদলা নিতে নরখাদক হয়ে উঠেছে সন্তানহারা তিমিরা। কেবল তিনজন মানুষই নয়, স্বজাতির উপর আক্রমণ চালিয়েও যেন ক্ষোভ মিটছে না তাদের। ১৯৮৩ সালে আইসল্যান্ডে অবৈধভাবে তিমি মাছ আটকে রাখার এ প্রক্রিয়ার ফলেই প্রশান্ত মহাসাগরের তিমিরা আগ্রাসী হয়ে উঠেছে, তা প্রকাশ করতে ২০১৩ সালে ‘ব্ল্যাকফিশ’ নামক ডকুমেন্টারিটি তৈরি করেছেন গ্যাব্রিয়েলা কাওপার্থওয়েট।

৮. মার্ডারবল (২০০৫)

হুইলচেয়ার রাগবি খেলায় অংশ নেয়া শারীরিক প্রতিবন্ধী অ্যাথলেটদের নিয়ে নির্মিত হয়েছে ‘মার্ডারবল’ ডকুমেন্টারিটি। ২০০৪ সালের প্যারাঅলিম্পিক গেমসের প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দল কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার জমজমাট যুদ্ধ নিয়ে ডকুমেন্টারিটি নির্মাণ করেছেন হেনরি অ্যালেক্স রুবিন এবং ডানা অ্যাডাম শাপিরো। কোয়াড্রিপ্লেজিক্স, হুইলচেয়ারে বসে যিনি পূর্ণ-চুক্তিতে রাগবি খেলেন, গ্রিসের প্যারাঅলিম্পিকে অংশগ্রহণের জন্য তার অকল্পনীয় ত্যাগ স্বীকারের ঘটনা চমকে দেবে যে কাউকে। ‘মার্ডারবল’ সেরা ডকুমেন্টারি হিসেবে অস্কারে মনোনীত হয়েছিল।

৯. কেডি (২০১৬)

ইস্তানবুল শহরের পথেঘাটে ঘুরে বেড়ায় হাজারো বেওয়ারিশ, দলছুট বেড়াল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তারা এভাবেই ঘুরছে। সহজাত হিংস্রতার কারণে কেউ কেউ মানুষের লাথি-ঝাঁটা খেয়ে টিকে আছে, আবার নমনীয় ও আদুরে স্বভাবের কারণে এদের অনেকের ঠাঁই হয়েছে মানুষের কোলে। ‘কেডি’ আমাদেরকে সেই বেড়ালগুলোর গল্প বলে। তাদের সংস্পর্শে আসা বেশ কিছু মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়ে ডকুমেন্টারিটি সাজিয়েছেন তুর্কী পরিচালক সৈদা তরুণ। প্রাচীন শহর ইস্তানবুলের নতুন একটি প্রোফাইল যেন তিনি তৈরি করেছেন, যার পুরোটাই ধারণ করা হয়েছে বেড়ালের চোখে। ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের তালিকাকৃত সেরা ২০টি ডকুমেন্টারিতে স্থান করে নিয়েছে ‘কেডি’।

১০. ডেলিভার আস ফ্রম ইভিল (২০০৬)

এ ডকুমেন্টারির প্রধান চরিত্র ফাদার অলিভার ও’গ্রেডি, একজন ক্যাথলিক পাদ্রী। পাদ্রীর কথা শুনে মনে ভক্তি জেগে উঠছে? একটু থামুন, আর দশজন ধর্মযাজকের ন্যায় ধর্মের চর্চা না করে অধর্মের বাণী ছড়িয়ে বেড়ানোই অলিভারের প্রধান কাজ। ১৯৭০ এর দশকের গোটা যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে হাঙ্গামা সৃষ্টি করা এই পাদ্রী ধর্ষণ করেছে ডজনখানেক শিশুকে। ১৯৭০-৯০ এর শুরুর দিক পর্যন্ত আইরিশ এই পাদ্রী যাবতীয় অপকর্ম চালিয়েছে উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ায়। এমন ঘৃণ্য এক অপরাধীর মুখোশ উন্মোচন করতে ‘ডেলিভার আস ফ্রম ইভিল’ ডকুমেন্টারিটি নির্মাণ করেছেন এমি জে বার্জ।