সময়টা যত লম্বা হচ্ছে, আমাদের ভোগান্তি তত বাড়ছে’

করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিস্তার ঠেকাতে ঢাকার যে এলাকাকে প্রথম রেড জোন হিসাবে চিহ্নিত করে পরীক্ষামূলক লকডাউন করা হয়, সেই পূর্ব রাজাবাজার এলাকায় ১৪দিন পুরো হলো সোমবার।

কর্তৃপক্ষ বলেছে, এখন পূর্ব রাজাবাজারে আরও সাত দিন লকডাউন থাকবে এবং তারপর সেখানকার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এর সময় বাড়ানো না বাড়ানোর প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

এদিকে, পূর্ব রাজাবাজারকে মডেল হিসাবে নিয়ে দেশে ১০টি জেলা যেমন, মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ, বগুড়া, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মৌলভীবাজার, চুয়াডাঙ্গা, যশোর ও চট্টগ্রামের কিছু এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করে সেখানে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।

এরপর সোমবার রাতে আরও পাঁচটি জেলার কিছু এলাকাকে রেড জোন হিসাবে চিহ্নিত করে সাধারণ ছুটি দেয়া হয়েছে। এই জেলাগুরো হচ্ছে, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী এবং কুষ্টিয়া।

বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলেছেন, দেশে এখন সংক্রমণের উচ্চ হার রয়েছে, এমন সব এলাকাকে একসাথে কার্যকরভাবে লকডাউন করা হলে এখনও ইতিবাচক ফল পাওয়া সম্ভব। কিন্তু সেটা কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের বিষয়ে তাদের সন্দেহ রয়েছে।

প্রায় ৫০,০০০ মানুষের বসবাসের পূর্ব রাজাবাজার এলাকাকে দুই সপ্তাহ আগে যখন লকডাউন করা হয়, তখন সেখানে শনাক্ত হওয়া কভিড-১৯ রোগী ছিল ২৯ জন।

এলাকাটিতে লকডাউনের ১৪দিনে আরও ৩৪ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে।

এই নতুন রোগী শনাক্ত করার বিষয়কে সাফল্য হিসাবে তুলে ধরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, এখন সেখানে সংক্রমণের বিস্তার ঠেকানো সম্ভব হবে।

এলাকাটিতে ওয়ার্ড কাউন্সিলের নেতৃত্বে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী এবং সেচ্ছাসেবকরা দোকানসহ সব কিছু বন্ধ রাখা এবং মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছেন।

এলাকার ভিতরে ভ্যানে করে চাল ডাল সবজি বা মাছ মাংস বিক্রির ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।

তবে এভাবে সেখানে কতটা লাভ হচ্ছে, তা নিয়ে এলাকাটির বাসিন্দাদের অনেকের প্রশ্ন রয়েছে। তারা লম্বা সময় লকডাউনে থাকার ভোগান্তি নিয়েও অভিযোগ করেছেন।

পূর্ব রাজাবাজারের একজন বাসিন্দা ফিরোজা আকতার বলেছেন, “শুরুর দিকে দেখেছি ভলান্টিয়াররা মাইকিং করছে বা আমাদের বিভিন্ন তথ্য জানাচ্ছে। প্রথম দুই তিন দিন আমরা সেটা ফিল করেছি। কিন্তু এরপর ১০ বা ১২দিন ধরে তাদের উপস্থিতি আমরা টের পাচ্ছি না।

“টিভিতে অনেক সময় দেখাচ্ছে, যে জায়গায় ভলান্টিয়ার বা পুলিশ বসে আছে, এখানকার আশেপাশের লোকজন হয়তো সাপোর্ট পাচ্ছে। কিন্তু আমরা যারা একটু ভিতরের দিকে আছি, আমরা সে রকম সাপোর্ট পাচ্ছি না।”

“আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, ভলান্টিয়াররা প্রথমদিকে যখন এসে মাছ,মাংস ওনারা নিয়ে এসেছে, সেগুলোর দাম ছিল অনেক বেশি। আমাদের অনেকের বেশি তা কেনা সম্ভব ছিল। এখন সময়টা যত লম্বা হচ্ছে, আমাদের সাফারিংস তত বাড়ছে।”

সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সংক্রমণের উচ্চহার বিবেচনা করে ছোট ছোট এলাকাকে রেড জোন হিসাবে চিহ্নিত করে কার্যকরভাবে লকডাউন করার কথা বলা হচ্ছে কয়েক সপ্তাহ ধরে।

শেষ পর্যন্ত ঢাকার বাইরে ১৫টি জেলায় ছোট ছোট এলাকাকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

তবে এই জেলাগুলোর চিহ্নিত এলাকাগুলোর বেশিরভাগই ইতিমধ্যে স্থানীয়ভাবে লকডাউন করা হয়েছে। এখন তা অব্যাহত থাকবে।

এসব জেলার মধ্যে যশোরে অভয়নগর উপজেলায় এ পর্যন্ত ১০৮ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। সেখানে সংক্রমণের হার বেশি হওয়ায় কয়েকটি ইউনিয়নে এবং পৌর এলাকাতেও লকডাউন চলছে তিনদিন ধরে।

অভয়নগর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান মিনারা পারভিন বলেছেন, এখন সরকারের নির্দেশের পর কঠোরভাবে লকডাউন করার চেষ্টা তারা করছেন।

“আমাদের অভয়নগর পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডেই লকডাউন চলছে। কোন লোকজন যাতায়াত করতে পারতেছে না। পুলিশ সেনাবাহিনী নিরাপত্তা বজায় রেখে টহল দিচ্ছে।”

তিনি আরও বলেছেন, “প্রত্যেকটা ওয়ার্ডের কমিশনারকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সে অনুযায়ী তারা বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে এবং যারা একটু অসুস্থ আছে তাদের নমুনা সংগ্রহ করে টেস্টের জন্য পাঠাচ্ছে।”

সরকারের জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে এলাকাভিত্তিক লকডাউন এখন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে এবং তা সংক্রমণ ঠেকাতে ভাল ফল দেবে বলে সরকার মনে করছে।

“আমাদের কারিগরি বিশেষজ্ঞ কমিটিতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ যারা আছেন, তাদের মতামত নিয়েই এটা করা হচ্ছে। তাদের ধারণা, আমরা যদি ছোট ছোট এলাকা নিয়ে লকডাউন করি, তাহলে সংক্রমণ কমানো সম্ভব হবে। এটি অবশ্যই কাজ করবে।”

বিশেষজ্ঞদের বড় অংশই অবশ্য এখন এলাকাভিত্তিক লকডাউনের পক্ষে বলছেন।

তারা বলেছেন, সংক্রমণের বিস্তার ঠেকানোর জন্য এখন মানুষের সামনে কোন ব্যবস্থাই রাখা হয়নি। সেখানে কোন ব্যবস্থা না থাকার চাইতে কিছু একটা হওয়া উচিত।

তাদের বক্তব্য হচ্ছে, হটস্পটগুলো চিহ্নিত করে একসাথে কার্যকরভাবে লকডাউন করা না হলে লাভ হবে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক একজন পরিচালক ডা: বে-নজীর আহমেদ বলেছেন, “আমরা যদি বলি, আমাদের ৫০০ উপজেলা। তাহলে প্রত্যেক উপজেলায় দু’টো করে জায়গা চিহ্নিত করা হলে মোট ১০০০টি জায়গা হবে। আর ঢাকায় যদি ৩০০ বা ৪০০ জায়গায় করা হয় এবং চট্টগ্রামে ২০০ জায়গা চিহ্নিত করা হলে দেড় হাজারের মতো জায়গা হবে। এটা করা কঠিন কোন বিষয় নয়।”

তিনি আরও বলেছেন, “আমরা পরিকল্পনাটা যদি ভালভাবে করি। এবং এটা একসাথে করতে হবে। তাহলে ১৪দিন, ২৮ বা ৪২ দিনের মদ্যে আমরা এর একটা ইমপ্যাক্ট দেখতে শুরু করবো।”

কিন্তু সেটা কতটা কার্যকরভাবে করা সম্ভব হবে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের অনেকের সন্দেহ রয়েছে।

কর্মকর্তারা বলেছেন, এলাকাভিত্তিক লকডাউন কঠোরভাবেই করা হচ্ছে। কিন্তু অনেক এলাকা একসাথে করার ক্ষেত্রে লোকবল এবং ব্যবস্থাপনা নিয়ে সমস্যা হতে পারে। পর্যায়ক্রমে দেশের সব হটস্পট লকডাউন করার চেষ্টা তাদের রয়েছে। সূত্র: বিবিসি বাংলা