সঞ্চয়পত্রে মুনাফা অর্ধেক : বিশেষজ্ঞরা বলছেন সংবিধানবিরোধী

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

শেয়ারবাজারের অবস্থা বেশ আগে থেকেই বিনিয়োগের জন্য অনুপযোগী। ব্যাংকে আমানত রাখলেও মুনাফা কমতে কমতে ছয় শতাংশে নেমেছে। দেশে হুট করে অল্প পুঁজিতে ব্যবসা শুরু করারও কোনো পরিবেশ নেই। সে তুলনায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ অনেকটা নিরাপদ।

সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে এতদিন ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা পেতেন গ্রাহক। তাই অনেক অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবীর আয়ের একমাত্র উৎস এই সঞ্চয়পত্র। এই টাকায়ই তাদের সংসার চলে। কিন্তু ডাকঘর সঞ্চয়পত্রের মুনাফাও এক লাফে কমিয়ে অর্ধেক করে দিয়েছে সরকার।

মুনাফা কমায় সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরশীল সীমিত আয়ের মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে হতাশা। আর সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্তকে সংবিধানবিরোধী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ডাকঘর সঞ্চয়পত্রে সর্বোচ্চ মুনাফা ৬ শতাংশ করে বৃহস্পতিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব স্বাক্ষরিত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এদিন থেকেই এটি কার্যকর হবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। এতদিন তিন বছর মেয়াদে ডাকঘর সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে গ্রাহক সুদ পেতেন ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। নতুন প্রজ্ঞাপন হওয়ার পর এখন পাবেন ৬ শতাংশ

সুদহার কমানোর বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণায়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় তাদের পাওয়া যায়নি।

তবে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকিং খাতের ঋণে আগামী ১ এপ্রিল থেকে ৯ শতাংশ সুদহার বাস্তবায়ন করতে চায় সরকার। এ জন্য চলতি মাসের ১ তারিখ থেকে ব্যাংকগুলো আমানতে সুদহার ৬ শতাংশে নামিয়েছে। সঞ্চয়পত্রে যদি সুদহার ১১ শতাংশের বেশি হয়, তাহলে আমানতকারীরা ব্যাংকে আমানত না রেখে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করবে।

এতে করে ব্যাংকিং খাতে আমানতে সংকট দেখা দেবে। তাই আমানতকারীদের ব্যাংকমুখী করতে সঞ্চয়পত্রে সুদহার কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়া সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়ায় এ খাতে সুদবাবদ অনেক বেশি ব্যয় করতে হতো সরকারকে। তাই চলতি অর্থবছরের শুরুতে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের আয়ের ওপর উৎসে কর ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়।

এছাড়াও ব্যাংকিং খাতে আমানতের তুলনায় সঞ্চয়পত্রে সুদহার বেশি হওয়ায় সঞ্চয়পত্রে কালো টাকার বিনিয়োগ হয়েছে। তাই সঞ্চয়পত্রে অবৈধ বিনিয়োগ ঠেকাতে গত ১ জুলাই থেকে বেশ কিছু কড়াকড়ি আরোপ করে সরকার।

হঠাৎ করে ডাকঘর সঞ্চয়পত্রে মুনাফা অর্ধেকে নামিয়ে আনার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ  বলেন, ‘আমি মনে করি এটা বাংলাদেশের সংবিধানবিরোধী। একইসঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বর্ণিত যে অর্থনীতি তার সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।’

তার এ বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, ‘কারণ আমাদের সংবিধানে রয়েছে মানুষের মধ্যে যে সম্পদবৈষম্য এবং সামাজিকবৈষম্য রয়েছে তা কমিয়ে আনতে হবে। এছাড়া অঞ্চলে অঞ্চলে যে উন্নয়ন বৈষম্য রয়েছে সেটাও কমিয়ে আনতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে অনেক বক্তব্যে স্পষ্ট বলেছেন যে, মানুষের মধ্যে আয়বৈষম্য ও অঞ্চলে অঞ্চলে উন্নয়নবৈষম্য থাকবে না। এগুলোই ছিল বাংলাদেশের বাধ্যবাধকতা এবং মুক্তিযুদ্ধের ফসল।’

বর্তমানে অনেকগুলো সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাংলাদেশের মূল নীতিকে নষ্ট করা হয়েছে বলে মনে এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, ‘যেমন এর আগে চলতি অর্থবছর থেকেই সব ধরনের সঞ্চয়পত্রে উৎসে কর ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘তারপর বছরে মাত্র আড়াই লাখ টাকা আয় হলে আয়কর দিতে হয়। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ৫ লাখ রুপি অর্থাৎ ৬ লাখ টাকা হলে আয়কর দিতে হবে। এখানেও দেখা যায় যে ভারত যতটুকু সমাজবাদী অর্থনীতি গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ ঠিক তার বিপরীত। একইসঙ্গে এটা বঙ্গবন্ধুর নীতির পরিপন্থী।’

‘মুজিববর্ষে এসে বঙ্গবন্ধুকে এভাবে অপমান না করলেই ভালো হয়’ বলেও জানান ইব্রাহিম খালেদ।

এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে দেশে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ। সঞ্চয়পত্রে মুনাফা ৬ শতাংশ হলে মূল্যস্ফীতি ও ট্যাক্স বাদ দিলে তো কোনো লাভই পাবে না বিনিয়োগকরী। এ অবস্থায় সঞ্চয়পত্রে সুদহার ৬ শতাংশ কতটুকু যৌক্তিক তা ভাবার বিষয়।

নতুন প্রজ্ঞাপনে তিন বছর মেয়াদে ডাকঘর সঞ্চয়পত্রে সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ শতাংশ। আগে যা ছিল ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। দুই বছর মেয়াদের সঞ্চয়পত্রে সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে সাড়ে ৫ শতাংশ। আগে যা ছিল ১০ দশমিক ৭০ শতাংশ। এছাড়া এক বছর মেয়াদে সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ শতাংশ। আগে যা ছিল ১ দশমিক ২০ শতাংশ।

এছাড়া আমানতকারী ইচ্ছা করলে প্রতি ৬ মাস অন্তর মুনাফা উত্তোলন করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে প্রথম বছরে ৪ শতাংশ, দ্বিতীয় বছরে সাড়ে ৪ শতাংশ এবং তৃতীয় বছরে ৫ শতাংশ হারে মুনাফা পাবেন। আগে যা ছিল যথাক্রমে প্রথম বছরে ৯ শতাংশ, দ্বিতীয় বছরে সাড়ে ৯ শতাংশ এবং তৃতীয় বছরে ১০ শতাংশ।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ডাকঘর সঞ্চয়পত্রও সরকারের এক ধরনের সঞ্চয়পত্র। ডাকঘরের মাধ্যমে বিক্রি হয়ে থাকলেও এর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতর। সকল শ্রেণি-পেশার বাংলাদেশি নাগরিক এ সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন। নাবালকের পক্ষেও এ সঞ্চয়পত্র কেনা যায়। এক্ষেত্রে বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা হচ্ছে- একক হিসেবে ৩০ লাখ টাকা এবং যুগ্ম হিসেবে ৬০ লাখ টাকা।

অধিদফতরের তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ডাকঘর সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ ছিল প্রায় আট হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে তিন বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রে সাত হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছে গ্রাহক।

সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগ নিরুৎসাহ করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এ বছর গত বছরের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর উৎসে আয়কর কর্তনের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। অবশ্য ব্যাংকগুলোর স্থায়ী আমানতের ক্ষেত্রেও সুদের ওপর উৎসে করের হার ১০ শতাংশ এবং যাদের টিআইএন নেই, এ হার তাদের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ।

পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর উৎসে কর ৫ শতাংশের পরিবর্তে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে উৎসে কর বাড়ালেও এখনও ডাকঘর সঞ্চয়পত্র ছাড়া অন্যান্য সঞ্চয়পত্রে সুদহার কমায়নি সরকার।

এসব শর্তে সরকারের সঞ্চয়পত্রের বিক্রির পরিমাণ কমেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে এক-তৃতীয়াংশের কিছু কম। সঞ্চয়পত্র নিট বিক্রি হয়েছে ৩২০ কোটি ৬২ লাখ টাকার। আগের বছর একই মাসে বিক্রি হয় তিন হাজার ৮৩৩ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র।