শিবগঞ্জ হানাদার মুক্ত দিবস আজ  

নিজস্ব প্রতিবেদক, চাঁপাইনবাবগঞ্জ:
আজ ১১ ডিসেম্বর। এ দিনটি শিবগঞ্জ উপজেলাবাসির জন্য একটি স্বরণীয় দিন। কারণ এদিনে পাকহানাদার বাহিনীর কবল থেকে শিবগঞ্জ উপজেলা মুক্ত হয়। ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থানা মুক্ত হয়। শিবগঞ্জ মুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধাদের পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে কোন মুখোমুখী যুদ্ধ করতে হয়নি। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর আজকের দিনে শিবগঞ্জ শত্রু মুক্ত হলে “বিজয় উল্লাস” আর ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়েছিল আকাশ বাতাস।
এ উপজেলা হানাদার মুক্ত করতে অসংখ্য জীবন বলীদান এবং অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রম হানি হয়েছিল। সেই ভয়াবহ দিনে কত কি যে ঘটেছে তার পরিসংখ্যান নেই। ৭১ সালের ২৫ মার্চ ভয়াল কালো রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সারাদেশের ন্যায় এ উপজেলাও ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিকামী মানুষের উপর। সে সময় পাক-হানানার বাহিনীর এদেশীয় দোষর, রাজাকার, আলবদর, পিচ কমিটি, শান্তি কমিটির সদস্য এলাকার অসংখ্য ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে ক্ষতি সাধন করেছিল কোটি কোটি টাকার ধন সম্পদ। এমনকি এ বাহিনীর তা-বে এলাকার মানুষ ভয়ে জঙ্গলে ও গর্তে পালিয়ে থাকত। এ সুযোগ বুঝে বাড়িতে থাকা স্বতী-সাধবী নারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত রাজাকার ও আলবদর বাহিনী।
হানাদারদের অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে দেশ প্রেমিক মুক্তিযোদ্ধারা নিজের জীবন বাজি রেখে স্বাধিকার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এভাবে দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করতে করতে পাক-হানাদার বাহিনী দূর্বল হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধার আগমন ঘটে। শিবগঞ্জ থানা সদর মুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন দল যখন শিবগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন ১০ ডিসেম্বর রাতেই তাদের কাছে স্থানীয় মানুষজন খবর দেন যে, রাজাকার-আলবদর ও থানার পুলিশকে ফেলে রেখে পাকসেনারা এ দিন রাতেই শিবগঞ্জ ছেড়ে চাঁপাইনবাগঞ্জ সদরের দিকে পালিয়ে গেছে। এ খবর নিশ্চিত হওয়ার পর ১১ ডিসেম্বর বেলা আড়াইটার দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন দল একের পর এক শিবগঞ্জ সদরে ঢুকে পড়ে। পরিপূর্ণভাবে মুক্ত হয় শিবগঞ্জ থানা।
স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কুলিয়ে উঠতে না পেরে ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর রাতে পাক-হানাদার বাহিনী পালিয়ে যায়। পরের দিন ১১ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে স্বাধীনতাকামী মানুষ একত্রিত হয়ে শিবগঞ্জে পাক-হানাদার বাহিনীর খোঁজে তল্লাশি চালায়। এ তল্লাশিতে পাক বাহিনীর কোন সদস্যকে না পেয়ে সেদিন মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মুক্তিকামী জনগণ বিজয় উল্লাস করে। প্লাটুন কমান্ডার নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল প্রথমে থানায় ঢুকে এবং অবাঙালি পুলিশকে আত্মসমর্পণ করিয়ে থানা হাজতে আটকে রাখে। এ থানার অস্ত্র দখলে নেয় মুক্তিযোদ্ধারা।
নজরুল ইসলাম বলেন, এসময় স্কুল শিক্ষক জাকারিয়ার নেতৃত্বে সাধারণ মানুষের একটি দল ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে আসে। জাকারিয়া মাষ্টার বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত্র একটি জাতীয় পতাকা আমার হাতে তুলে দেন। আমি থানায় প্রথম মুক্ত শিবগঞ্জে পতাকা উড়ায়। এ ঘটনা নিশ্চিত করেন সতীর্থ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সাবেক কমান্ডার বজলার রশিদ সনু। ওই সময়ের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র, ১১ ডিসেম্বর শিবগঞ্জ মুক্ত হওয়ার দিনের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন বলে জানান।
তিনি বলেন, শিবগঞ্জ মুক্ত হওয়ার সময়টিতে ব্যাপক মানুষের ঢল না নামলেও অনেক মানুষ সেদিন রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাগত জানায়। সাধারণ মানুষের মনে তখনও ভয়ভীতি কাজ করছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের এ বিজয় স্থায়ী হবে কিনা এনিয়ে তাদের মনে তাৎক্ষণিকভাবে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছিল। ভাবছিল উচ্ছ্বাস দেখাতে গিয়ে পাছে পাকিস্তানী চরদের নজরে পড়ে না জানি কোন নির্যাতনের মুখে পড়তে হয়।
শিবগঞ্জ মুক্ত হওয়া নিয়ে কথা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের কোম্পানী কমান্ডার ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা অধ্যাপক শাহজাহান মিঞা ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সাবেক কমান্ডার বজলার রশিদ সনুসহ অনেকের সঙ্গে। ১১ ডিসেম্বরকে শিবগঞ্জ হানাদার মুক্ত দিবস ঘোষণা করা হয়। যার ধারাবাহিকতা আজও অব্যাহত রয়েছে।
পরদিন ১২ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সদরের দিকে এগুতে থাকে এবং মহানন্দা নদীর তীরে বারোঘরিয়া নামক স্থানে পাক বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর শহীদ হলে তাঁকে সোনামসজিদ প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়।