শিক্ষাদানে শিশুদের সঙ্গে কোমল ব্যবহার

শিশু শিক্ষার্থীদের সৃষ্টিশীল মেধা বিকাশে শিক্ষকদের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের অভিভাবকসুলভ যত্নশীল আচার-আচরণ শিশুর স্বচ্ছ মেধা-মনন, সুস্থ বিবেক-বুদ্ধি ও  মানসিক চিন্তা-চেতনায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। গণমাধ্যমে প্রায়ই প্রাথমিক শিক্ষার সব শিক্ষাব্যবস্থায় শিশু শিক্ষার্থীদের নির্মম প্রহারের খবর পাওয়া যায়, যা কাম্য নয়। এ ব্যাপারে নিজ নিজ শিক্ষা বোর্ডের নীতিনির্ধারকদের কঠোর হওয়া উচিত।

সবার সঙ্গে কোমল ব্যবহার : শিশুরা শরিয়তের দায়ভার থেকে মুক্ত। কোনো বিষয়ে জবাবদিহি করতে তারা বাধ্য নয়। তাই শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল এই শিশুদের প্রতি আমাদের আচরণ হওয়া উচিত নম্র ও কোমল। যে নম্রতা ও কোমলতার আচরণ করতেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক রাসুল (সা.)। ছোট-বড় সবার সঙ্গে নম্র ও কোমল ব্যবহার করতেন তিনি। আম্মাজান আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসের শেষ অংশে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা আমাকে হঠকারী ও কঠোরতাকারীরূপে প্রেরণ করেননি; বরং সহজ-কোমল আচরণকারী শিক্ষকরূপে প্রেরণ করেছেন।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৪৭৮)

কোমলতা আল্লাহর পছন্দ : শিশুদের শিক্ষাদান পদ্ধতি ও পাঠে মনোযোগিতার কৌশল গ্রহণে চিন্তাশীল হতে হয়। তাদের ভুলত্রুটি শিশুতোষ মধুর শাসনে সংশোধন করতে হয়। কোনোভাবেই মাত্রাতিরিক্ত ভয়ভীতি ও প্রহার করা উচিত নয়। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত অন্য একটি হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা কোমল আচরণকারী, তিনি সর্বক্ষেত্রে কোমলতাকে ভালোবাসেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৬০২৪)

শিক্ষাদানে রাসুল (সা.)-এর আদর্শ : মুআবিয়া ইবনে হাকাম (রা.) বর্ণনা করেন, একদিন আমি রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে নামাজরত ছিলাম। হঠাৎ এক ব্যক্তি (নামাজের মধ্যে) হাঁচি দিল। প্রত্যুত্তরে আমি ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বললাম। লোকজন তখন আমার দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছে। আমি বলে উঠলাম, আপনাদের কী হয়েছে? আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছেন কেন? লোকজন তাদের ঊরুতে হাত চাপড়িয়ে আমাকে শান্ত ও চুপ হতে ইঙ্গিত করল। আমি চুপ হয়ে গেলাম। রাসুল (সা.) সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করলেন। আমার মা-বাবা তাঁর প্রতি উৎসর্গিত হোন, তাঁর মতো এত উত্তম ও সুন্দর শিক্ষাদানকারী কোনো শিক্ষক তাঁর আগেও কাউকে দেখিনি এবং তাঁর পরেও দেখিনি। আল্লাহর কসম! তিনি আমাকে না প্রহার করলেন, না তিরস্কার করলেন, না ধমক দিলেন; তিনি বলেন, আমাদের এই নামাজ মানুষের কথাবার্তার উপযোগী নয়। (অর্থাৎ নামাজে এ ধরনের কথা বলা যায় না।) বরং নামাজ হলো তাসবিহ, তাকবির ও তিলাওয়াতে কোরআন।’ (মুসলিম, হাদিস : ৫৩৭)

শিক্ষাদানে কোমল আচরণ : আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা শিক্ষাদান করো, সহজ ও কোমল আচরণ করো; কঠোর আচরণ কোরো না। যখন তুমি রাগান্বিত হবে তখন চুপ থাকো। যখন তুমি রাগান্বিত হবে তখন চুপ থাকো। যখন তুমি রাগান্বিত হবে তখন চুপ থাকো (এ কথা তিনবার বলেন)। (মুসনাদে আহমদ,  হাদিস : ২৫৫৬)

অন্য একটি হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা শিক্ষাদান করো এবং সহজ-কোমল আচরণ করো।’ (আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ১৩২০)

ক্রোধ অনিষ্টের মূল : অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকদের রাগী মনোভাবের কারণে শিক্ষার্থীরা নির্মম প্রহারের শিকার হয়। এটা অন্যায় ও জুলুম। এই রাগই অনিষ্টতা ও বিপদ ডেকে আনে। জনৈক সাহাবি থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে কিছু উপদেশ দিন। তিনি বলেন, তুমি রাগ কোরো না। লোকটি বলল, রাসুল (সা.) যা বলেছেন তা বলার পর আমি চিন্তা করে দেখলাম, ক্রোধই হলো সব অনিষ্টের মূল। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২৩১৭১)

অন্যায়ভাবে প্রহার করা অপরাধ : শিশুদের বা অন্য কাউকে অন্যায়ভাবে প্রহার করা সম্পর্কে আল্লাহর রাসুল (সা.) কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি কাউকে অন্যায়ভাবে প্রহার করবে কিয়ামতের দিন তার থেকে এর প্রতিশোধ গ্রহণ করা হবে।’ (আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ১৮৬)

মুফতি মুহাম্মাদ শফি (রহ.) বলেছেন, শিশুদের প্রহার করা খুবই ভয়াবহ। অন্য গুনাহ তো তাওবার মাধ্যমে মাফ হতে পারে, কিন্তু শিশুদের ওপর জুলুম করা হলে এর ক্ষমা পাওয়া খুবই জটিল। কেননা এটা হচ্ছে বান্দার হক। আর বান্দার হক শুধু তাওবার দ্বারা মাফ হয় না। যে পর্যন্ত না যার হক নষ্ট করা হয়েছে সে মাফ করে। এদিকে যার ওপর জুলুম করা হয়েছে, সে হচ্ছে নাবালক। নাবালকের ক্ষমা শরিয়তের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। এ জন্য এ অপরাধের মাফ পাওয়া খুবই জটিল। আর তাই শিশুদের প্রহার করা এবং তাদের সঙ্গে মন্দ ব্যবহার করার বিষয়ে সাবধান হওয়া উচিত। (ইসলাহি মাজালিস, মুফতি তাকি উসমানি)

রাসুল (সা.)-এর সুমহান হাদিস থেকে শিক্ষা নিয়ে শিক্ষকরা তাঁদের শাসনপদ্ধতি সহনীয় ও মধুর করে তুলুক, একজন শিক্ষক হিসেবে এই প্রত্যাশাই করছি।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ