শহরে ছিনতাই, গ্রামেও মাদকের ছড়াছড়ি

নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজশাহী শহরজুড়ে বেপরোয়া ছিনতাইকারীদের লাগাম টানতেই পারছে না পুলিশ। রাত-দিন সমানে চলছে ছিনতাই। ছিনাতাইকারীদের একটি বড় অংশই রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। আবার উঠতি যুবকরাও ছিনতাইকারীদের তালিকায়। এই দুই গ্রুপের সদস্যরাই শহরজুড়ে কখনো মোটরসাইকেল হাঁকিয়ে আবার কখনো পথরোধ করে ছিনতাই করে চলেছে।

গত শুক্রবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ফিরোজ আনামকে উপর্যুপরি কুপিয়ে ও পিটিয়ে আহত করে ছিনতাইকারীরা। এসময় তাঁর নিকট থেকে ছিনতাইয়ের চেষ্টা করা হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে ব্যাপক আন্দোলনে নামেন রাবি শিক্ষার্থীরা। এছাড়াও নগরীর পথে পথে প্রতিনিয়তই ঘটে চলেছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। এগুলোর বেশিরভাগই থাকছে লোকচোক্ষুর আড়ালে। এমনকি উল্টো হয়রানির ভয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগও করতে যেতে চাইছেন না ভুক্তভোগীরা।

অন্যদিকে শহর পেরিয়ে রাজশাহীর গ্রামে গ্রামে বসছে মাদকের হাট। উঠতি বয়সী কিশোর থেকে যুবকরা জড়িয়ে পড়ছে মাদকে। জেলার প্রতিটি উপজেলাতেই হাত বাড়ালেই মিলছে যেন ইয়াবা আর গাঁজা। এসবে মাদকে আশক্ত হয়ে বিপথগামী হচ্ছে কিশোর ও যুবকরা।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মাদকের ছড়াছড়ি রাজশাহী শহরেও রয়েছে। কিন্তু আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে। গ্রামে একসময়ে যে কিশোর-যুবকরা ফুটবল, হাডুডুসহ নানা খেলায় মেতে উঠে সময় পার করত, এখন সেখানে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়াসহ আড্ডা, খোস-গল্প আর মোবাইলে মেতে উঠছে। আর এসব থেকেই একপর্যায়ে গিয়ে মাদকের জড়িয়ে পড়ছে কিশোর ও যুবকরা। আরো ভয়ানক বিষয় হলো, প্রায় প্রতিটি গ্রামেই রয়েছে একেকটি কিশোর গ্যাং। যাদের কাজই হলো, স্কুল-কলেজগামী মেয়েদের ইভটিজিং থেকে শুরু করে, চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে এই গ্যাংরা। গত ১০ অক্টোবর পুঠিয়ায় কিশোর গ্যাংয়ের ৪ সদস্যসহ এক নারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) সাজ্জাদ হোসেন জানান, পুঠিয়া থানায় কিশোর অপরাধ চক্রের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা হয়েছে। সেই মামলায় এক নারীসহ মোট ৫জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত অন্য চারজনই হলো কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য।

এর আগে গত ৫ অক্টোবর পুঠিয়া পৌর এলাকার কৃষ্ণপুর মহল্লায় অবস্থিত একটি পরিত্যক্ত ভবনে এক কিশোরকে আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতনের অভিযোগে কিশোর গ্যাংয়ের কিশোর গ্যাংয়ের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেওয়া তথ্য মতে, রাজশাহীর উপজেলা পর্যায়ে এখন মাদকের ভয়াবহতা সবচেয়ে বেশি। এর একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। মূলত কিশোর গ্যাংরা জড়িত মাদক সরবরাহ ও সেবনের কাজে। আর মাদকের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত উপজেলা পর্যায়ের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এদের মাধ্যমেই গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে ইয়াবা ও গাঁজার বিস্তার।

অন্যদিকে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে এখনো হেরোইন কারবারিরা সক্রিয় হয়ে আছে। সোহেল রানা, নয়ন ডাক্তার, রোমেন বিশ্বাস, রবিউল ইসলাম বাবু, আবুল কালাম আজাদ, বারইপাড়ার নজরুল ইসলাম, চর কোদালকাটি এলাকার মাহাবুব হোসেন, মাদারপুর এলাকার ইয়াসিনের ছেলে হেলাল উদ্দিন, দাঙ্গাপাড়া এলাকার সিরাজুলের ছেলে রাকিব, বারইপাড়া এলাকার কালুমিয়ার ছেলে সাইদুর রহামন ওরফে খড়ি সাইদুর, মহিষালবাড়ি এলাকার আহাদ মণ্ডলের ছেলে জমির হোসেন, মাদারপুর এলাকার গোলাম মোস্তফার ছেলে আওলাদ হোসেন, হোসেন আলীর ছেলে শাহাদৎ হোসেন, মাহবুবুর রহমানের ছেলে মেহেদী হাসান, বারইপাড়া এলাকার সোহরাবের ছেলে লতিফুর রহমান, হাজরাপুকুর এলাকার মান্নান নাজিরের ছেলে আনারুল ইসলাম, মাটিকাটা ভাটা এলাকার ইসমাইলের ছেলে শফিক ওরফে দিয়াড়া শফিক, তার ভাই রেলবাজার এলাকার একরাম হোসেন, একরামের ছেলে শাহিন হোসেন, বারইপাড়া এলাকার লাল মোহাম্মদের ছেলে আমিনুল ইসলাম, মাদারপুর এলাকার নজরুল ইসলামের ছেলে নয়নসহ আরো ২০-৩০ জনের দল এখনো গোদাগাড়ীর মাদকের নিয়ন্ত্রণ করছে আড়ালে-অবডালে। এর মধ্যে সোহেল বিদেশে পালিয়ে গেছে। অন্যরাও গাঢাকা দিয়ে আছে। তবে কেউ কেউ কেউ এখনো এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রকাশে। তবে আন্তজার্তিক মাদক কারবারি শীষ মোহাম্মদ কালের কণ্ঠে সংবাদ প্রকাশের পর গ্রেপ্তার হওয়ায় অন্য শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। তবে এর মধ্যেও মাদকের কারবার চলছে অনেকটা কৌশলে ও গোপনে।

জানতে চাইলে গোদাগাড়ী থানার ওসি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘গোদাগাড়ীর শীর্ষ মাদক কারবারিরা এখন এলাকায় নাই। তবে মাদক যে প্রতিরোধ করা গেছে তা নয়। কারণ গোদাগাড়ীর কে মাদক ব্যবসায়ী আর কে ভালো, সেটা বুঝে এটা মুশকিল। তারপরেও আমরা মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছি।’

এদিকে নগরীর ছিনাতাই এখন মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সাধারণ মানুষের মাঝে। ছিনতাইকারী চক্রের একাধিক সদস্য কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত। সম্প্রতি নগরীর লক্ষীপুরে রাফিজা নামের এক নারীর নিকট থেকে ভ্যানেটি ব্যাগ ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। তিনজন কিশোর একটি মোটরসাইকেলযোগে রিকশা আরোহী ওই নারীর নিকট থেকে ভ্যানেটি ব্যাগটি ছিনিয়ে নেয়।

এ নিয়ে রাজপাড়া থানায় একটি মৌখিক অভিযোগও করেছেন ওই নারীর স্বামী রাব্বি হোসেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। এর আগেও ছিনতাইকারীরা আমেরিকা প্রবাসী এক দম্পতির ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। সর্বশেষ শুক্রবার রাতে রাবিতে ঘটে যাওয়া ছিনতাই চেষ্টার ঘটনাটি বেশ আলোচনার জন্ম দেয়।

জানতে চাইলে মহানগর পুলিশের মূখপাত্র গোলাম রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘আমরা ছিনতাই প্রতিরোধে নগরীর মোড়ে চেকপোস্ট বসিয়েছি। তারপরেও দুই-একটি ঘটনা ঘটছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণে আরো জোরদার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এদিকে ছিনাতাইয়ের পাশাপাশি শহরে মাদকও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে মাঝে-মধ্যেই খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মাদকে আশঙ্ক হয়ে সম্প্রতি নগরীর দরিখরবোনা এলাকায় জাহাঙ্গীর নামের এক যুবক আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছে। এছাড়াও শহরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মাঝে মাঝে খারাপের দিকে নিয়ে বালু কারাবরিদের দৌরাত্মের কারণে। নগরীর তালাইমারীতে সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল আলম বেন্টু একটি বালুমহাল জোর করে দখলে রেখেছে। এ নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা এখনো আছে। এই বেন্টুর দৌরাত্মে নগরীর শ্যামপুর এলাকায় গত বছর বালুমহাল দখল নিয়ে গুলাগুলির ঘটনাও ঘটে। কিন্তু এখনো এই বেন্টুর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।

এদিকে বালুমহালকে কেন্দ্র করে গত ১১ অক্টোবর নগরীর তালাইমারি এলাকায় আওয়ামী লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের আবদুস সাত্তার ও জনি গ্রুপের মধ্যে গুলাগুলির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় অন্তত ৫ জন আহত হয়।

বালুমহাল নিয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা প্রশাসক হামিদুল হক বলেন, ‘বালুমহাল নিয়ে একজন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে বেশকিছু অভিযোগ আছে আমাদের কাছে। এসব তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়া হবে মন্ত্রণালয়ে।’