শব্দদূষণের নগরী রাজশাহী: বেপরোয়া হাইড্রোলিকং হর্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক:

শব্দদূষণের নগরীতে পরিণত হয়েছে রাজশাহী। একদিকে হাজার হাজার অটোরিকশার হর্ণের শব্দ অন্যদিকে রাত-দিন শহরের ভিতর দিয়ে দাঁপিয়ে বেড়ানো বাস-ট্রাকের হাইড্রোলিক হর্ণের শব্দ অপরদিকে নানা প্রচারণার মাইকের তিনে মিলে অতিষ্ঠ করে তুলেছে নগরজীবনকে। হাইড্রোলিক হর্ণ বাজানো নিশিদ্ধ হলেও খোদ নগরীর ভিতরেও এ হর্ণ বাচ্ছে যাচ্ছে-তাই ভাবে। এ নিয়ে প্রশাসনেরও কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। ফলে গাড়ী চালকরা এখনো বেপরোয়াভাবে এসব হর্ণ বাজাচ্ছে। এমনকি কোনো বখাটে মোটরসাইকেল চালকদের মোটরসাইকেলও হাইড্রোলিক হর্ণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে এখনো।

নগরীর সচেতন মহল ও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গ্রীণসিটি হিসেবে রাজশাহী দুই দুইবার পুরস্কৃত হয়েছে। কিন্তু এখন ক্রমেই শব্দদূষণের সিটিতে পরিণত হচ্ছে। এখান থেকে দ্রুত আমাদের মুক্তি না মিললে ভবিশ্যতে এই অবস্থা আরো মারাত্মক আকারে রুপ নিবে। যার ফল মানবদেহে গিয়ে ভয়ানকভাবে ছড়িয়ে পড়বে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজশাহী নগর সংস্থার বার বার বেধে দেওয়া সময়ের মধ্যেও নিয়ন্ত্রণহীন অটোরিকশার চলাচল বাগে আনা যায়নি। এখনো শহরের রাস্তায় দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে অন্তত ৫০ হাজার অটোরিকশা। রাসিক ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণে বড়গুলো ১০ হাজার এবং ছোটগুলো ৫ হাজার নিবন্ধন দিয়ে শহরের চলার অনুমতির ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যে ১৫ হাজারেরও বেশি আবেদন জমাই পড়েছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই এখনো চলছে।

এরই মধ্যে অনেককেই নিবন্ধন দেওয়ায় হয়েছে। কিন্তু প্রথমে গত ৩১ অক্টোবর পরবর্তিতে ৩০ নভেম্বর এবং পরবর্তিতে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে অবৈধ অটোরিকশা চলাচল বন্ধের সময়সীমা বেধে দেওয়া হয়। কিন্তু বার বার সময় বেধে দেওয়া হলেও পরবর্তিতে সেখান থেকে পিছু হঠতে বাধ্য হয় নগর সংস্থা। অটোরিকশাগুলো কোনোমতেই নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারাই শেষে আগামী ৩১ জানুয়ারি সর্বশেষ সময় বেধে দেওয়া হয়েছে। এরপর থেকে নগরীর নিবন্ধহীন অটোরিকশার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে শুধুমাত্র বৈধ ১৫ হাজার অটোরিকশা চালানোর অনুমতি দেওয়া হবে।

নগরীর দরিখরবোনা এলাকার বাসিন্দা আকবর আলী জানান, রাজশাহী শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে শুরু করে অলি-গলিতে ছুটে চলা হাজার হাজার অটোরিকশার হর্ণ রাতদিন শহরের বাতাসকে যেন ভারি করে তুলেছে। হাইড্রোলিক হর্ণ বাজিয়ে দিনের বেলাতেও শহরের মধ্যে দিয়েই ছুটে চলছে বাস-ট্রাক। এমনকি মোটরসাইকেলেও উচ্চমাত্রার হাইড্রোলিক হর্ণ বাজাতে দেখা যায়। রাত-দিন সমানে এসব যানবাহণ চলাচল করায় এবং হাইড্রোলিক হর্ণের কারণে নগরীর পথচারীসহ রাস্তার পাশের ব্যবসায়ী, বাসিন্দা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পড়ছেন মারাত্মক শব্দদূষণের কবলে।

নগরীর কাদিরগঞ্জ এলাকার ফার্নিচার ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান বলেন, ‘ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের অন্তত নব্বই ভাগ যানবাহন চলাচল করছে শহরের ভিতর দিয়ে দিনের বেলাতেও। এতে করে এসব দ্রুতগতির যানবাহণ এবং সেগুলোর হাইড্রোলিক হর্ণের শব্দে দোকানে কানপাতাই দায় হয়ে পড়েছে। মারাত্মক শব্দের কারণে ক্রেতাদের কথাই ঠিকমতো শোনা যায় না। এর ওপর শত শত অটোরিকশার হর্ণ তো বেজেই চলেছে।’

রাজশাহী জেলা সচেতন নাগরিক কমিটি সনাকের সভাপতি আহমেদ শফিউদ্দিন বলেন, ‘রাজশাহীতে শব্দদূষণ এখন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। হাজার হাজার অটোরিকশার হর্ণের শব্দে রাস্তায় নামায় দায় হয়ে পড়েছে। এর ওপর শহরের ভিতর দিয়ে আন্তঃজেলা বাস এবং মালবাহী ট্রাকগুলোও ছুটে চলে হাইড্রোলিক হর্ণ বাজিয়ে। এতে করে শব্দদূষণের নগরীতে পরিণত হয়েছে রাজশাহী। সাধারণ নাগরিকরাও অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।’

নগরীর সাহেব বাজার এলাকার ব্যবসায়ী এমরান আলী ভুইয়া বলেন, ‘যানবাহণের শব্দ তো রাতদিন আছেই পাশাপাশি বিভিন্ন প্রচারণা মাইকও সমানে বিকট শব্দ করে নানা ধরনের প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব মাইকও কেউ নিয়ন্ত্রণ করার নাই। বছরের শুরতেই এখন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির প্রচারণা মাইক, কোচিং সেন্টারের মাইক, বিভিন্ন পণ্য বিক্রির মাইক, বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন কর্মসূচির মাইক আবার জিরোপয়েন্টকেন্দ্রীক বিভিন্ন সংগঠনের বিভিন্ন কর্মসূচির মাইকের শব্দেও দোকানে বসে থাকা যায় না। এগুলো নিয়ন্ত্রণ জরুরী।’

দিনের বেলায় নগরীর ভিতর দিয়ে চলাচলকারী বাস-ট্রাকের হাইড্রোলিক হর্ণ সম্পর্কে জানতে চাইলে নগর পুলিশের মুখপাত্র গোলাম রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘যানবাহণের হাইড্রোলিক হর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু তারপরেও যদি সেগুলো বাজানো হয় তাহলে সেসব চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তিনি আরো বলেন, যেসব অটোরিকশার হর্ণে উচ্চমাত্রার শব্দ আছে, সেগুলোও আমরা নষ্ট করে দেয়। এরপরেও প্রয়োজনে আরো অভিযান চালানো হবে।’

অন্যদিকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নাক, কান ও গলা বিভাগের চিকিৎসক সুব্রত কুমার ঘোষ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ক্রমাগত শব্দদূষণের ফলে কানের টিস্যুগুলো আস্তে আস্তে বিকল হয়ে পড়ে। তখন সে আর স্বাভাবিক শব্দ কানে শুনতে পায় না। শব্দদূষণের কারণে শ্রবণশক্তি হ্রাসের পাশাপাশি মানুষের স্বাস্থ্য এবং আচার-আচরণ – উভয় ক্ষেত্রেই সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। অতিরিক্ত শব্দের কারণে মানুষের শারীরিক ও মানসিক কার্যকলাপ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। পাশাপাশি দুশ্চিন্তা, উচ্চ রক্তচাপনানা ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে মানবদেহে।’

স/আর