শতবর্ষের সব নেতাকে ছাপিয়ে

হাসান আজিজুল হক:


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কি শুধুই একটি নাম? তিনি কি শুধুই একজন রাজনৈতিক নেতা? কিংবা আন্দোলন-সংগ্রামের পাহাড়সম প্রতীক? নিশ্চয় নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইতিহাস; বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসের অক্ষয় অধ্যায়। সবকিছু ছাপিয়ে তিনি ব্যক্তি থেকে পরিণত হয়েছিলেন একটি প্রতিষ্ঠানে। ‘রাজনীতির কবি’খ্যাত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; রাজনীতির পাণ্ডুলিপির অখণ্ড কাব্যপঙ্‌ক্তি। তিলে তিলে নিজেকে গড়েছেন, নির্মাণ করেছেন নিজের জন্য নয়; একটি জাতির জন্য। তারপর জন্ম দিয়েছেন বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের। তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে ইতিহাসে লগ্ন।

তার রাজনৈতিক জীবন-উপাখ্যান অনেক দীর্ঘ। তিনি কেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি- এর ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ অনেক হয়েছে, আরও হবে। এত বিস্তৃত উপাখ্যানের পর্যালোচনা তো এভাবেই হতে থাকবে। বাঙালি জাতি, বাঙালি জাতিরাষ্ট্র, বিশ্বের রাজনৈতিক নেতা, রাজনীতির অধ্যায় ইত্যাদি প্রসঙ্গ যতবার সামনে আসবে ততবারই আলোচনার প্রাসঙ্গিক অংশ হয়ে থাকবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

ভারতবর্ষে জন্ম চিরস্মরণীয় অনেক বাঙালি রাজনৈতিক নেতার নাম উল্লেখ করা যায়। তাদের প্রভাব-দূরদর্শিতা-বিচক্ষণতা অবশ্যই স্মরণযোগ্য। বাঙালির নেতা হয়ে ওঠা চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষ বসু, একে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ নেতার সঙ্গে বাঙালির হৃদয়ের বন্ধন নিবিড়। বাঙালি জাতি তাদের জন্য উপাধিও নির্ধারণ করেছিল। যেমন- ‘দেশবন্ধু’ (চিত্তরঞ্জন দাশ); ‘নেতাজি’ (সুভাষ বসু); ‘শেরে বাংলা’ (একে ফজলুল হক), ‘মজলুম জননেতা’ (মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী)। শেখ মুজিবুর রহমানের ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি লাভের প্রেক্ষাপটও সচেতন মানুষমাত্র অজানা নয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি বাঙালির হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু ও শেখ সাহেব নামে প্রোথিত, তিনি সবাইকে ছাড়িয়ে-ছাপিয়ে গেলেন। একেকটি অধ্যায় তাকে ইতিহাসে একেকভাবে স্থান নির্দিষ্ট করেছে। বায়ান্ন, চুয়ান্ন, বাষট্টি, উনসত্তর, সর্বোপরি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে চিহ্নিত করল বাঙালির ত্রাতা হিসেবে। তার তর্জনী উত্থিত জনসমুদ্রে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর্বের শেষ বক্তৃতা বাঙালি জাতিকে অনুপ্রাণিত করল জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম-যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে; বাঙালির হূৎপিণ্ডে দৃঢ় প্রত্যয় প্রোথিত করল শৃঙ্খলমুক্তির জন্য সংকল্পবদ্ধ প্রত্যয়ী করতে, সেই কালজয়ী ভাষণ তাকে সমগ্র বিশ্বে উপস্থাপন করল অনন্য উচ্চতায়।

একাত্তর পর্বের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সেই ভাষণটি আজ বিশ্ব-দলিল। দুনিয়ার মুক্তিকামী সব মানুষকে কাঁপানো সেই ভাষণ ‘ভায়েরা আমার…’; বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত ভাষণটি কতটা শক্তিসঞ্চারক ছিল, এর জলজ্যান্ত প্রমাণ হলো, ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে রক্তস্নাত বাংলাদেশের অভ্যুদয়। কবি নির্মলেন্দু গুণ তার ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ শিরোনাম যুক্ত কবিতায় লিখেছেন, “…একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্য কী ব্যাকুল প্রতীক্ষা মানুষের।/’কখন আসবে কবি?’ ‘কখন আসবে কবি?’/ শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/ অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।/…’এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’/সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।”

কাব্য পঙ্‌ক্তির মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক ঘটনার কী চমৎকার বর্ণনা! ৭ মার্চের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু তার ‘অমর কাব্য’ শুনিয়ে বাঙালিকে এক অসম্ভব প্রেরণাশক্তি দিয়ে দুর্দমনীয় করে তোলেন। এই তো বঙ্গবন্ধু। বাঙালি জাতির বিশ্বনন্দিত নেতা। এমন একজন তেজস্বী, বীর বাঙালি, একটি জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা সবাইকে ছাপিয়ে উঠবেন; তার জন্য ইতিহাস অনন্য স্থান নির্ধারণ করে দেবে; এটাই তো স্বাভাবিক। তাকে ইতিহাস থেকে নির্বাসিত করে এমন সাধ্য কার! ভারতের ইতিহাসে যেমন মহাত্মা গান্ধী; চীনের ইতিহাসে যেমন মাও সে তুং; ভিয়েতনামের ইতিহাসে যেমন হো চি মিন; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে যেমন জর্জ ওয়াশিংটন; বাঙালি-বাংলাদেশের ইতিহাসে তেমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সর্বশ্রেষ্ঠ এই বীর বাঙালিকে নিয়ে যত কাব্য, মহাকাব্য, প্রবন্ধ, নিবন্ধ কিংবা সমৃদ্ধ গ্রন্থ রচিত হয়েছে; বিভিন্ন ভাষায় আবার সেসবের অনেক কিছু অনূদিতও হয়েছে; বিশ্বের আর কোনো জননেতাকে নিয়ে এতকিছু হয়েছে কি-না আমার জানা নেই। শুধু তা-ই নয়; অনেক গবেষকের গবেষণার বিষয়বস্তুও বঙ্গবন্ধু। তার ব্যাপ্তি, প্রজ্ঞা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, রাজনৈতিক কৌশল, দেশপ্রেম, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, নেতৃত্বমোহন শক্তি; আরও কত কিছু তো রয়েছে; এভাবে সারিবদ্ধভাবে বলে যাওয়া যায়। নানা ব্যঞ্জনা, স্তরে স্তরে নানা উপাখ্যান সৃষ্টির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেকে এক পর্বের মধ্য দিয়ে নিজেই ছাপিয়ে উত্তরণ ঘটিয়েছেন আরেক পর্বে।

রক্তস্নাত স্বপ্নের বাংলাদেশের নকশা তার মানসপটে তিনি এক দিনে অঙ্কন করেননি। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে তিনি মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন। পাকিস্তানি শাসকরা সাহস পেল না, অথচ স্বজাতিদ্রোহীরা তাকে সপরিবারে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট হত্যা করল। স্বল্প সময়েই দেশনায়ক-রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু যা কিছু করে গেছেন, অর্থাৎ আরেকটি নবপর্বের সূচনা করেছিলেন এবং সেই সিঁড়ি বেয়েই বাংলাদেশ আজ স্বল্পোন্নত দেশের গণ্ডি পেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। আমাদের ওই যে লক্ষ্য, উন্নত রাষ্ট্রের কাতারভুক্ত হওয়া, তাও হয়তো খুব দূরে নয়; আশা করি দুরূহও নয় সেই লক্ষ্যকেন্দ্রে পৌঁছা, যদি অনিয়ম-দুর্নীতি-বৈষম্যের শিকড় উপড়ে ফেলে মানবাধিকার, সুশাসন, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি প্রত্যয়ী-ব্রতী হয়ে দেশপ্রেমবোধ আরও পুষ্ট করে করণীয়গুলো নিশ্চিত করতে পারে। এসব ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শই আমাদের প্রেরণা।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুনের ঘরে জন্ম নেওয়া তাদের ছয় সন্তানের মধ্যে তৃতীয় সন্তান খোকা (শেখ মুজিবুর রহমান) একটি জাতিরাষ্ট্রের জনক হবেন- তা কে ভেবেছিল! ঘটনা-পরিপ্রেক্ষিত-কর্মকাণ্ড ইত্যাদি একজন মানুষকে তার পর্যায় নির্ধারণের সড়ক নির্মাণ করে দেয়। গোপালগঞ্জের পাটগাতী ইউনিয়নের বাইগার নদীতীরবর্তী টুঙ্গিপাড়ার সন্তান খোকা শেখ মুজিবুর রহমান থেকে ক্রমান্বয়ে বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতার ভূমিকা কিংবা কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। ১৯৩৯ সালে মিশনারি স্কুলের শিক্ষার্থী শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতিতে হাতেখড়ি বলতে গেলে তখনই। ১৯৪২ সালে কলেজে অধ্যয়নকালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে এসে তার রাজনৈতিক জীবনের নতুন বাঁক পর্যায়ক্রমে তাকে উন্নীত করে জাতীয় পর্যায়ের নেতা হিসেবে। এ পর্যায়েও তিনি নিজেই নিজেকে ছাপিয়ে হয়ে উঠলেন একজন বিশ্বনেতা পরিচয়ে। বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের দিকনির্দেশক ও নেতৃত্বদানকারী এই মহানায়ক ফাঁসির মঞ্চের বলতে গেলে খুব কাছে থেকে ফিরে এসেছিলেন তার জনভিত্তির জোরেই। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সাহসে কুলায়নি ওই পর্যায় পর্যন্ত যেতে। আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, জুলফিকার আলি ভুট্টো তাদের সব কূটচাল, বঙ্গবন্ধুকে দমানোর এমনকি প্রাণনাশের চক্রান্তও ভেসে গেল জনগণের ভালোবাসার তরঙ্গে। বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের পর বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম তার প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশে ফিরে এলেন বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বলতে দ্বিধা নেই, বাঙালি জাতি অনেক নেতাকে পেলেও জনগণের মুখপাত্র হয়ে ওঠা, জনগণের চেতনা-ভাবনা-স্বপ্ন সবকিছু ধারণ করতে বঙ্গবন্ধু সক্ষম হয়েছিলেন বলেই তিনি বাঙালি রাজনৈতিক নেতা হিসেবে সবার ঊর্ধ্বে। তার দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এই জাতিরাষ্ট্রের স্বাধীন সত্তার যে উদ্ভব; এর চূড়ান্ত পর্যায়ের ভূমিকাই অন্যদের থেকে তাকে ছাপিয়ে তোলে।

একাত্তর পর্বে বঙ্গবন্ধুর চোখে ভাসছিল সাড়ে সাত কোটি বাংলার মানুষের একটি স্বাধীন-সার্বভৌম আবাসভূমি। যার ডাকে একটি ভূখণ্ডের আবালবৃদ্ধবনিতা লিপ্ত হয় সর্বাত্মক জনযুদ্ধে, তিনি নানাভাবেই মূল্যায়িত হতে থাকবেন অনন্তকাল। বাঙালি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ প্রতিষ্ঠা করে দেওয়ার প্রয়াস ছিল আরও অনেক বাঙালি নেতার। শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব করলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক

সূত্র: সমকাল