লাশ ঠিকানায় পাঠানো যার কাজ!

কাজী কামাল হোসেন,নওগাঁ
নওগাঁর রাণীনগরের মইন আলীর পেশায় লাশ বহন করা। অভাব-অনাটনের সংসারে অনেক কষ্ট করেই কিনেছেন একটি ভটভটি। প্রায় ২ থেকে ৩ বছর ধরে ভটভটি দিয়ে সড়কে যাত্রী বহনের কাজ করতেন তিনি। হঠাৎ এক দিন তার গ্রামের একটি লোকের অর্ধগলিত লাশ তার গাড়ীতে বাধ্য হয়ে বহন করতে হয়।
লাশ বহনের পর মনের ভিতর জেগে যায় ধর্মীয় অনুভূতি, নামাজ পড়তে শুরু করলেন, মুখেও দাড়ি রাখলেন মইন আলী। তখন তার মাথায় চিন্তা আসে যে, সবাই তো যাত্রী বহন করে, মরদেহ বহন করার লোক পাওয়া যায় না। লাশ নিয়ে পরিবারের লোকজনদের ও থানা পুলিশদের নানান বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।
পঁচন ধরা অর্ধগলিত লাশ গাড়ীতে বহন করতে চায় না কেউ। ঠিক তখনই অর্থাৎ গত প্রায় ১৪ বছর আগে মইন আলী সিদ্ধান্ত নেয় তিনি শুধুমাত্র লাশ বহন করবেন। তিনি থানা পুলিশকে বলেন, ‘স্যার লাশ নিয়ে আপনাদের আর কোন সমস্যায় পড়তে হবে না ! আমাকে খবর দিবেন, আমি লাশ বহনের জন্য চলে আসবো’।
সেই থেকে রাণীনগর উপজেলায় ব্যক্তি পর্যায় ও থানাপুলিশের পক্ষ থেকে লাশ বহনের কাজটি মইন আলী কে দিয়েই চলছে। এপর্যন্ত তিনি প্রায় ১ শ’ ১০ টি লাশ বহন করেছেন। অজ্ঞাত পঁচন ধরা ভাসমান দূর্গন্ধ হওয়া লাশ, রেল ও সড়ক দূর্ঘটনায় ক্ষতবিক্ষত  হওয়া, হত্যা-আত্মহত্যাসহ সব ধরণের লাশ কাপড় বা চাটায় দিয়ে মোড়ানো ও বহনের ক্ষেত্রে  মইন আলীই যথেষ্ট।
ঘটনাস্থল থেকে ময়না তদন্তের জন্য হাসপাতালে নেওয়া থেকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা পর্যন্ত লাশের দ্বায়িত্বে থাকতে হয় মইন আলীকে। লাশ নিয়ে কাজ করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় অন্য কাজ করতেও মন চায় না মইনের। লাশ বহন করতে পাড়লেই যেন তার মনে তৃপ্তি আসে। লাশ বহন করে গাড়ী ভাড়া বেশ ভাল পাওয়ার কারণে তার সংসারও চলছে এখন বেশ স্বাচ্ছন্দে।
লাশ বহনের জন্য তিনি নিজেই তৈরি করেছেন সাদা পোষাক। ঘটনাস্থল যত দূরে ভাড়াটাও তত বেশি পাওয়া যায়। পঁচনশীল লাশের ক্ষেত্রেও ভাড়া খুব ভালই হয়। প্রায় দেড় থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত এক একটি লাশের ভাড়া হয়। এছাড়াও বিপদগ্রস্ত পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে লাশ বহনের মাধ্যমে এক রকম সহযোগিতাও করেন তিনি।
এতে বিপদগ্রস্থ পরিবারের লোকজন তার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন বলে মইন আলী জানান। তিনি আরোও জানান, সব সময় লাশ বহনের কাজ হয় না। মাসে দু’একটি করে লাশের ভাড়া পাওয়া যায়। তাই অন্য সময় আমার গাড়ী দিয়ে যাত্রী বহন করতে গেলে ‘লাশের গাড়ী’ বলে গাড়ীতে কেউ উঠতে চায় না। ফলে মাসের বেশির ভাগ দিন উপার্জন ছাড়াই বসে থাকতে হয়। শতাধিক লাশ বহন করাটায় তার জীবনের বড় সফলতা অর্জন বলে মনে করেন মইন আলী।
রাণীনগর উপজেলা সদরের সিম্বা গ্রামের মৃত আশরাব আলী মন্ডল’র ছোট ছেলে মইন আলী (৩৫)। বাবার মৃত্যুর পর চার ভাই-বোনের সংসার ধীরে ধীরে আলাদা হয়ে যায়। অভাবের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠা মইন আলী কিছুদিন পর বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করেন। বছর কয়েক পর মইন আলীর অভাব-অনটনের সংসারে জন্ম নেয় এক মেয়ে ও পরে এক ছেলে।
ভটভটি চালিয়ে মেয়েকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত লেখা-পড়া করিয়েছেন। ছেলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণীতে লেখা-পড়া করছে। অভাবের সংসারে বেশি দূর পর্যন্ত লেখা-পড়ার খরচ ব্যয় করা অসম্ভব। তাই বড় মেয়ের লেখা-পড়া বন্ধ হয়ে যায়। কয়েক বছর পর মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু বিয়ের খরচ বাবদ কোন টাকা-পয়সা তার কাছে নেই, তাই টাকার প্রয়োজনে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া দেড় শতক ভিটে-মাটি বড় ভাইদের কাছে বিক্রি করে মেয়েকে বিয়ে দেয়।
কিছুদিনের মধ্যে বিক্রি করা বসত ঘর ছেড়ে দিতে হয়। কোথায় থাকবে? কি করবে? এমন দূঃসময়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য মো: ইসরাফিল আলমের ছোট ভাই সিরাজুল ইসলাম চাঁদ’র সরানাপন্ন হলে তিনি এলাকার ঝিনা গ্রামের পার্শ্বে গড়ে উঠা গুচ্ছগ্রামে তাকে বসবাস করার ব্যবস্থা করে দেন। সেই থেকে মইন আলী ওই গুচ্ছ গ্রামেই বসবাস করছেন।
উপজেলার সিম্বা গ্রামের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো: সাইদুল ইসলাম ফকির জানান, মইন আলী আমার গ্রামের ছেলে। সে ১৫/১৬ বছর আগে একটি ভটভটি কিনে এই এলাকায় যাত্রী বহনের কাজ করত, বছর কয়েক পর যাত্রী বহন বাদ দিয়ে শুধুমাত্র লাশ বহনের কাজ শুরু করে মইন। আমার জানা মতে, এই কাজ করে সে ভালই উপার্জন করে।
রাণীনগর থানার অফিসার ইনচার্জ এএসএম সিদ্দিকুর রহমান জানান, আমি এই থানায় আসার পর থেকেই দেখছি লাশ বহনের কাজ মইন আলীই করছে। শুনেছি সে দীর্ঘদিন ধরে এই কাজের সাথে জরিত। থানায় মইনের মোবাইল নাম্বার রাখা আছে। যখন প্রয়োজন পড়ে তখন মইনকে ফোন করে ডেকে নেওয়া হয়।
স/আ