লালপুরের পয়তারপাড়া গণহত্যা দিবস

 

লালপুর (নাটোর)প্রতিনিধি:
২৯ মে ১৯৭১। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকহানাদার বাহিনী নাটোরের লালপুরের উপজেলার ধুপইল, পয়তারপাড়া ও দিলালপুর গ্রাম ঘেরাও করে। অর্ধশতাধিক মানুষকে ধরে এনে বড়াল নদীর তীরে পয়তারপাড়া নামক স্থানে ২৫ জনকে জবাই করে, ব্রাশ ফায়ার করে ও বেনোয়াট দিয়ে আঘাত করে গণহত্যা চালায়। স্বাধীনতার পর শহীদদের সলিল সমাধির নিরব স্বাক্ষী গণহত্যা স্থলে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মান করা হয়েছে। প্রতিবছর ধুপইলের মানুষ দিনটিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে আসছেন।

পাক হানাদার বাহিনীর লোমহর্ষক হত্যা যজ্ঞের নীরব স্বাক্ষী বুলেট বিদ্ধ হয়ে লাশের স্তুপের নিচে চাপা পড়েও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান এই গ্রামের ৮২ বছর বয়স্ক মো. হায়দার মন্ডল (সাক্ষাৎকার: ২৫ জুন ২০০৩)। সেই বিভিষীকাময় ভয়াবহ দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে বলেন, ২৯ মে ১৯৭১ আনুমানিক ভোর তিনটা বাজে। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ঘুম থেকে জেগেই হৈচৈ শুনতে পায়। জানলাম বিশাল পাক আর্মি বহর ধুপইল গ্রাম ঘেরাও করেছে। পুরুষ লোকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ৪/৫ জন করে একসাথে পিছমোড়া দিয়ে বেঁধে ওমর বিশ্বাসের বাড়িতে এনে বেদম মারপিট শুরু করে। সেই সাথে প্রতিটি বাড়িতে লুটপাট করতে থাকে। গ্রামের দুই শতাধিক মানুষকে তারা ধরে নিয়ে আসে। এ সময় ‘গন্ড’ নামে গ্রামের একজন আমাদের চিহ্নিত করে দেয়। চিহ্নিতদের তারা অমানবিক নির্যাতন করতে থাকে। সকালের দিকে বেছে বেছে আমাদের বড়াল নদীর ধারে নিয়ে গিয়ে গুলি করে। গগণবিদারী চিৎকারে আকাশ-বাতাসে আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ে। মুহুর্তের মধ্যে নদীর ধার লাশের স্তুপে পরিণত হয়। তাজা রক্তের স্রোতে রক্ত রাঙা হয়ে যায় নদীর পানি। নিথর নিস্তব্ধ হয়ে যায় প্রকৃতি। মৃত্যু নিশ্চিত করতে বেয়ানেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও ছুরি দিয়ে টুকরো করে লাশ নদী পানির মধ্যে গড়িয়ে দেয়। অনেককে জবাই করে হত্যা করে। আমার গলায় গুলিবিদ্ধ হলে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে যায়। এক সময় জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখি আমি লাশের স্তুপের নিচে রক্তে রঞ্জিত অবস্থায় পড়ে আছি। লাশের স্তুপের মধ্যে উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে জীবন্ত কাউকে খুঁজে ফিরেেছ সবাই। কিন্তু আমি ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই। আহত অবস্থায় প্রতিরাতে ফুলবাড়ি গ্রামের লুৎফর ডাক্তার আমাকে চিকিৎসা দিতেন। কিন্তু ঘাড়ের রগ ছিঁড়ে যাওয়ায় বাম হাতও অকেজো হয়ে গেছে।

তিনি ক্ষোভ ও দুঃখের সাথে আহত হায়দার বলেন, দেশ-বিদেশের কতো লোক আমার কাছে ঘটনা শুনতে এসেছে। অনেকে ছবি তুলেছে, ভিডিও করে নিয়ে গেছে। কিন্তু কারো দ্বারা কোন উপকার পায়নি। সেই ভয়াবহ দিনের কথা মনে এলে এখনও মনের মধ্যে আতংকিত হই। আমার কষ্ট নিয়ে আমি বেঁচে আছি। আমার কথা আর কাউকে বলতে চাই না। শুনি সরকার যুদ্ধে আহতদের জন্য অনেক কিছু করে। কিন্তু আমার জন্য কেউ কোন দিন কিছু করলো না।

এই গণহত্যায় মহান শহীদরা হলেন, ওমর আলী বিশ্বাস, ছইর উদ্দিন প্রাং, সফি প্রাং, সুরাত আলী, সাজেদুর রহমান, সফের উদ্দিন, বাদল প্রাং, লকি প্রাং, দেবেন্দ্র নাথ কুন্ডু, নিতাইপদ কুন্ডু, তারাপদ কুন্ডু, দেবেন্দ্র নাথ কুন্ডু (বড়), নকুল চন্দ্র কুন্ডু, টগর চন্দ্র পাল, অরুণ চন্দ্র পাল, বৃন্দাবন চন্দ্র দাস, সুরেন্দ্রনাথ মন্ডল, উপেন্দ্রনাথ মন্ডল, সতীশ চন্দ্র মন্ডল, নরেন্দ্রনাথ মন্ডল, কার্তিক চন্দ্র মন্ডল, দেবেন্দ্রনাথ মন্ডল, গঙ্গা চরন মন্ডল, রনিক চন্দ্র মন্ডল, রুহিনী চন্দ্র মন্ডল, মফিজ উদ্দিন, আব্দুল হাকিম মন্ডল, গোকুল চন্দ্র কুন্ডু, মন্টু মিয়া, লক্ষিন্দর চন্দ্র প্রামানিক, আব্দুল হাকিম প্রামানিক প্রমুখ। আরো অনেক শহীদদের নাম পাওয়া যায়নি।

শুক্রবার (২৮ মে ২০২১) পয়তারপাড়ায় সরেজমিন দেখা যায়, বড়াল নদীর পূর্বপাড়ে অযত্ন-অবহেলায় নামে স্মৃতিসৌধ হিসেবে একটি স্মৃতিচিহ্ন দাঁড়িয়ে আছে। লালপুর থানা আওয়ামী লীগের সৌজন্যে নির্মিত যার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন, নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মমতাজ উদ্দিন। দেখে মনে হচ্ছে কত দিন পরিচর্যা নেই। নামফলক বোঝার উপায় নেই।

স/জে