সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ
আগামী কয়েকদিনের মধ্যে একের পর এক মিউচ্যুয়াল ফান্ডের লভ্যাংশের ঘোষণা আসবে। গত বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও ভালো লভ্যাংশের ঘোষণা আসবে বলেই ধারণা করা যাচ্ছে। তবে লভ্যাংশের এই মৌসুমেও অবহেলিত অবস্থায় রয়েছে প্রায় সবগুলো মিউচ্যুয়াল ফান্ড। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৬টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে ৩০টিরই দাম বর্তমানে অভিহিত মূল্যের নিচে। এমনকি মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোর মূল্য এনএভিরও (প্রকৃত সম্পদ মূল্য) অনেক নিচে রয়েছে।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোর দামে এমন চিত্র বিরাজ করলেও গত বছর এসব ফান্ড বড় মুনাফার পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের বড় লভ্যাংশও দেয়। এমনকি ফান্ডগুলোর অধিকাংশের চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত নয় মাসের হিসাবে ভালো মুনাফা রয়েছে।
এরপরও মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোর দাম তলানিতে থাকার কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীরা যুক্তিসঙ্গত আচরণ করছেন না। এখানে আসলে প্রকৃত বিনিয়োগকারীর সংখ্যা খুব কম। শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের বেশিরভাগ অল্প সময়ে বেশি মুনাফা করতে চান। লভ্যাংশের আশায় বিনিয়োগ করেন এমন বিনিয়োগকারী খুব কম।
তারা আরও বলছেন, গত বছর মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো ভালো মুনাফার পাশাপাশি ভালো লভ্যাংশ দিলেও তার আগে এ খাতের পারফরম্যান্স ভালো ছিল না। সম্পদ ব্যবস্থাপকদের অদক্ষতা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বল সিদ্ধান্তের কারণে মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ওপর থেকে বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো ধারাবাহিকভাবে কয়েক বছর ভালো করতে পারলে এ খাতের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসতে পারে।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৬টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে ২৯টির হিসাব বছর শেষ হয় জুনে। জুন ক্লোজিংয়ের পর এসব মিউচ্যুয়াল ফান্ড আগস্ট মাসের মধ্যে লভ্যাংশের সিদ্ধান্ত জানায়। মিউচ্যুয়াল ফান্ডের নীতিমালা অনুযায়ী একটি ফান্ড যত আয় করবে তার কমপক্ষে ৭০ শতাংশ লভ্যাংশ হিসেবে দিতে হবে। মাঝে লভ্যাংশ হিসেবে নগদ অর্থের পাশাপাশি রি-ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে ইউনিট দেওয়ার সুযোগ থাকলেও পরে তা বাতিল করা হয়েছে। এখন মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোকে শুধু নগদ লভ্যাংশ দিতে হবে।
ফান্ডগুলোর চিত্র:
নম্বর | নাম | গত বছরের লভ্যাংশ | ২০২১–২২ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ইউনিটপ্রতি মুনাফা | বর্তমান দাম |
১ | ডিবিএইচ ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড | ১২ শতাংশ | ৩৮ পয়সা | ৭ টাকা |
২ | গ্রীন-ডেল্টা মিউচ্যুয়াল ফান্ড | ১২ শতাংশ | ৪০ পয়সা | ৬ টাকা ৮০ পয়সা |
৩ | এসইএমএল-এফবিএলএসএল গ্রোথ ফান্ড | ১৫ শতাংশ | ৮৬ পয়সা | ৮ টাকা ৪০ পয়সা |
৪ | এসইএমএল-লেকচার ইক্যুইটি ফান্ড | ১৫ শতাংশ | ৬৮ পয়সা | ৯ টাকা ৩০ পয়সা |
৫ | এনএলআই ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড | সাড়ে ১৭ শতাংশ | ৩৫ পয়সা | ১৪ টাকা ৪০ পয়সা |
৬ | ফার্স্ট জনতা ব্যাংক | ১৩ শতাংশ | ৪০ পয়সা | ৬ টাকা ১০ পয়সা |
৭ | এবি ব্যাংক ফার্স্ট ইউনিট | ৮ শতাংশ | ৫৫ পয়সা | ৫ টাকা ৩০ পয়সা |
৮ | এশিয়ান টাইগার সন্ধানী লাইফ | ১৫ শতাংশ | ৯৩ পয়সা | ৯ টাকা ৮০ পয়সা |
৯ | সিএপিএমবিডিবিএল | ১৩ শতাংশ | ৪৫ পয়সা | ১০ টাকা ৪০ পয়সা |
১০ | সিএপিএমআইবিবিএল | সাড়ে ১৩ শতাংশ | ৪১ পয়সা | ১৪ টাকা ২০ পয়সা |
১১ | ইবিএল ফার্স্ট | ১৩ শতাংশ | ৫৭ পয়সা | ৭ টাকা ৫০ পয়সা |
১২ | ইবিএল এনআরবি | ৬ শতাংশ | ১ টাকা ৩৫ পয়সা | ৬ টাকা ৬০ পয়সা |
১৩ | এক্সিম ব্যাংক ফার্স্ট | সাড়ে ৭ শতাংশ | ৭৬ পয়সা | ৫ টাকা ৮০ পয়সা |
১৪ | এফবিএফআইএফ | ৪ শতাংশ | ৬৪ পয়সা | ৫ টাকা ১০ পয়সা |
১৫ | গ্রামীণ ওয়ান: স্কিম টু | ১৩ শতাংশ | ১ টাকা ১ পয়সা | ১৫ টাকা ৩০ পয়সা |
১৬ | আইসিবি এএমসিএল থার্ড এনআরবি | ৭ শতাংশ | ৪৭ পয়সা | ৬ টাকা ৫০ পয়সা |
১৭ | আইসিবি-এএমসিএল ফার্স্ট অগ্রণী ব্যাংক | ৭ শতাংশ | ৬২ পয়সা | ৯ টাকা ১০ পয়সা |
১৮ | আইসিবিএএমসিএল-২ | ৮ শতাংশ | ৬০ পয়সা | ৮ টাকা ৬০ পয়সা |
১৯ | আইসিবি এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ড-১: স্কিম-১ | ৬ শতাংশ | ৪১ পয়সা | ৭ টাকা ১০ পয়সা |
২০ | আইসিবি সোনালী ব্যাংক ফার্স্ট | ৭ শতাংশ | ৬১ পয়সা | ৮ টাকা |
২১ | আইএফআইসি ব্যাংক ফার্স্ট | সাড়ে ৭ শতাংশ | ৭৭ পয়সা | ৫ টাকা ২০ পয়সা |
২২ | আইএফআইএল ইসলামিক | ৪ শতাংশ | ২৪ পয়সা | ৬ টাকা ৪০ পয়সা |
২৩ | ফিনিক্স ফাইনান্স ফার্স্ট | ৬ শতাংশ | ৪৮ পয়সা | ১১ টাকা ৩০ পয়সা |
২৪ | পিএইচপি ফার্স্ট | সাড়ে ৮ শতাংশ | ৬০ পয়সা | ৫ টাকা ২০ পয়সা |
২৫ | পপুলার লাইফ ফার্স্ট | সাড়ে ৮ শতাংশ | ৬৪ পয়সা | ৫ টাকা ১০ পয়সা |
২৬ | প্রাইম ব্যাংক ফার্স্ট আইসিবি এএমসিএল | সাড়ে ৭ শতাংশ | ৫৭ পয়সা | ৭ টাকা ৬০ পয়সা |
২৭ | রিলায়েন্স ওয়ান | সাড়ে ১০ শতাংশ | ৫৪ পয়সা | ১০ টাকা ৮০ পয়সা |
২৮ | এসইএমএল আইবিবিএল শরিয়াহ্ ফান্ড | ১০ শতাংশ | ৬৩ পয়সা | ৮ টাকা ৫০ পয়সা |
২৯ | ট্রাস্ট ব্যাংক ফার্স্ট | ৯ শতাংশ | ৯০ পয়সা | ৫ টাকা ৭০ পয়সা |
ভালো মুনাফা করার পরও মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোর দাম তলানিতে থাকার কারণ হিসেবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) এক সদস্য বলেন, বাইরের দেশে মিউচ্যুয়াল ফান্ড হলো শেয়ারবাজারের প্রাণ। বাজারকে সাপোর্ট দিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে মিউচ্যুয়াল ফান্ড। যারা বাজার সম্পর্কে ভালো বোঝেন না, তারা মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু আমাদের দেশের শেয়ারবাজারে মিউচ্যুয়াল ফান্ডের কোনো ভূমিকাই নেই। এর প্রধান কারণ ফান্ড ম্যানেজারদের অদক্ষতা।
তিনি বলেন, গত বছর বেশিরভাগ মিউচ্যুয়াল ফান্ড ভালো লভ্যাংশ দিলেও তার আগের বছরগুলোর ইতিহাস খুব একটা ভালো নয়। অতীতে বেশকিছু মিউচ্যুয়াল ফান্ডে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। যে কারণে মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ওপর থেকে বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। তবে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বর্তমান কমিশন মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতে কিছু পরিবর্তন এনেছে। এখন মিউচ্যুয়াল ফান্ড শুধু নগদ লভ্যাংশ দিতে পারে। যদি পর পর কয়েকটি বছর মিউচ্যুয়াল ফান্ড ভালো লভ্যাংশ দিতে পারে তাহলে এ খাতের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসতে পারে।
এ নিয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, মিউচ্যুয়াল ফান্ডে অতীতে অনেক অনিয়ম হয়েছে। এ কারণে এ খাতের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কম। তাছাড়া আমাদের দেশের অধিকাংশ বিনিয়োগকারী হুজুগে বিনিয়োগ করেন। তারা রাতারাতি বড়লোক হতে চান। লভ্যাংশ পাওয়ার আশায় বিনিয়োগ করেন না।
তিনি বলেন, রাতারাতি মুনাফা পাওয়ার আশায় যেসব বিনিয়োগকারী জুয়াড়িদের পেছনে ছুটছেন তাদের বেশিরভাগ লাভের বদলে লোকসান করেন। তাই বিনিয়োগকারীদের উচিত হুজুগে বিনিয়োগ না করে, প্রতিষ্ঠানের সার্বিক অবস্থা ভালো করে বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগ করা।
তিনি আরও বলেন, মিউচ্যুয়ার ফান্ড ভালো করতে না পারার জন্য সম্পদ ব্যবস্থাপকরাও দায়ী। আমাদের এখানে সম্পদ ব্যবস্থাপকরা সবাই সমান কমিশন পান। এক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা উচিত। যে মিউচ্যুয়াল ফান্ড বিনিয়োগকারীদের ভালো লভ্যাংশ দেবে, তার সম্পদ ব্যবস্থাপক বেশি কমিশন পাবেন। একইভাবে যে মিউচ্যুয়াল ফান্ড কম লভ্যাংশ দেবে তার সম্পদ ব্যবস্থাপক কম কমিশন পাবেন- এমন নিয়ম করা উচিত।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, আমাদের শেয়ারবাজারে সবাই দ্রুত লাভ পেতে চায়। কিন্তু মিউচ্যুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করলে দ্রুত লাভ পাওয়া যায় না। এ কারণে মিউচ্যুয়াল ফান্ডের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কম। তবে লভ্যাংশের জন্য মিউচ্যুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করলে অনেক বেশি লাভ পাওয়া সম্ভব। গত বছর মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো বেশ ভালো লভ্যাংশ দিয়েছে। আমার ধারণা মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোর লভ্যাংশের এই ধারা অব্যাহত থাকলে এ খাতের প্রতি বিনিয়োগকারীরা আগ্রহী হবেন।
সুত্রঃ জাগো নিউজ