রোজগার না হলেও হাওলাত করে চাঁদা দিতে হয়, না হলে মারধর!

দক্ষিণে বিমানবন্দরের বিপরীত পাশের সড়ক থেকে উত্তরে তুরাগতীরের আব্দুল্লাহপুর বেড়িবাঁধ পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক এবং এলাকার অলিগলির ফুটপাতে হাত মেপে বসানো হয়েছে দোকান। উত্তরা এলাকার ফুটপাতে প্রায় ১০ হাজার দোকান রয়েছে। এসব দোকান বসাতে অগ্রিম নেওয়া হয়েছে অন্তত সাত কোটি টাকা। আর প্রতিদিন চাঁদাবাজি হয় ২৫ লাখ টাকা। বিপুল পরিমাণ এই চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িতরা ক্ষমতাসীন দলের ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী। কয়েক হাত ঘুরে চাঁদার টাকা চলে যায় এলাকা নিয়ন্ত্রণকারী নেতাদের কাছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতি সন্ধ্যায় ফুটপাতের দোকান থেকে চাঁদা আদায়ের জন্য লোক রয়েছে। তাদের একেকজন গড়ে ১০০ দোকান থেকে চাঁদা তুলে প্রতিদিন ৫০০ টাকা করে পায়। তারা চাঁদা তুলে জমা দেয় রাজনৈতিক নেতাদের নিয়োগ করা ক্যাডারদের কাছে। ওই সব ক্যাডার টাকা জমা দেয় রাজনৈতিক নেতাদের কাছে। এই নেতাদের চাঁদা তোলার এলাকা নির্দিষ্ট হয় নিজেদের পেশিশক্তি ও ‘গডফাদার’ নেতার মাধ্যমে।

স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব বদল হওয়ার পর পরিবর্তন এসেছে চাঁদাবাজ নেতাদেরও। তবে বেশ কয়েকজন রয়েছেন যাঁরা আগেও ফুটপাতে চাঁদাবাজি করতেন, এখনো করছেন। নেতৃত্ব বদলের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা আনুগত্য বদলে মিশে গেছেন নতুন নেতার সঙ্গে। এমন তিন চাঁদাবাজ হলেন উত্তরা পশ্চিম থানা শাখা কৃষক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাসেল, একই সংগঠনের পরিচয় দেওয়া উজ্জল এবং আব্দুল্লাহপুর বেড়িবাঁধ এলাকার কথিত যুবলীগ নেতা জাকির হোসেন। এক যুগ ধরেই তাঁরা দাপটের সঙ্গে চাঁদাবাজি করে চলেছেন।

সরেজমিনে অনুসন্ধান করে জানা গেছে, ফুটপাতের দোকানভেদে অগ্রিম নেওয়া হয়েছে তিন হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। গড়ে কমপক্ষে সাত হাজার টাকা করে ধরলেও অগ্রিম নেওয়ার পরিমাণ দাঁড়ায় সাত কোটি টাকা। প্রতিদিন চাঁদা আদায় করা হয় ২০০ ৭০০ টাকা পর্যন্ত। গড়ে কমপক্ষে ২৫০ টাকা ধরলেও দিনে চাঁদা আদায় হয় ২৫ লাখ টাকা।

যেসব এলাকায় চাঁদাবাজি : বর্তমানে যে এলাকাগুলোতে ফুটপাতে দোকান বসিয়ে চাঁদা তোলা হচ্ছে, সেসব এলাকা হচ্ছে জসীমউদ্দীন এভিনিউ থেকে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত প্রধান সড়কের দুই পাশ, জসীমউদ্দীন এভিনিউয়ের পূর্ব থেকে পশ্চিমে পাকা সড়ক পর্যন্ত, রাজলক্ষ্মী বিপণিবিতান থেকে পশ্চিমে ফ্রেন্ডস ক্লাব হয়ে ৫ নম্বর সেক্টরের কল্যাণ সমিতির কার্যালয় পর্যন্ত, রবীন্দ্র সরণি থেকে পশ্চিমে লাবাম্বা কাবাবের দোকান পর্যন্ত, মাস্কাট প্লাজা থেকে সোনারগাঁ জনপথ সড়ক হয়ে পশ্চিমে লেক পর্যন্ত, পূর্ব দিকে আলাওল এভিনিউ হয়ে রেললাইন পর্যন্ত, ঈশা খাঁ এভিনিউ হয়ে রাজউক কলেজ, শাহাজালাল এভিনিউ থেকে আজমপুর মোড়, আজমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পূর্বে রেললাইন, ৭ নম্বর সেক্টরের ৩৫ নম্বর সড়ক, আমিন কমপ্লেক্স থেকে এইচএম প্লাজা, গরীবে নেওয়াজ এভিনিউ, ময়লার মোড়, শাহ মখদুম এভিনিউ, সাউথ ব্রিজ সু্কলের সামনের সড়ক, বিমানবন্দরের বিপরীত দিকের সড়ক ও আব্দুল্লাহপুর বেড়িবাঁধ এলাকা।

ফুটপাতের এসব দোকানে প্রসাধনসামগ্রী, জুতা, শাড়ি, পোশাক, বিছানার চাদর, ফাস্ট ফুডের দোকান, ভাতের হোটেল থেকে শুরু করে সব পণ্যই বিক্রি হয়। সোনারগাঁ জনপথ সড়কের কাপড়ের দোকানি জামসেদ আলী  বলেন, ‘প্রায় তেরো বছর হইল এখানে ব্যবসা করি, সমস্যা হয় না। শুধু নতুন নতুন চাঁদাবাজ আসে। চাঁদাটা ঠিকমতো দিলে সমস্যা নেই। তবে চাঁদাবাজ বদল হলে আবার নতুন করে অগ্রিম টাকা দিতে হয়।’

মাস্কাট প্লাজার সমানের ফুটপাতের বস্ত্রসামগ্রী বিক্রেতা সোহান  বলেন, ‘আমাদের কাছ থেকে চাঁদা নেন রাসেল। উনি আগেও ছিলেন, এখনো আছেন। অন্যান্য জায়গায় নতুন চাঁদাবাজ এলেও রাসেলের বদল হয়নি।’

গরীবে নেওয়াজ এভিনিউ এলাকার ফুটপাতের ফাস্ট ফুডের এক দোকানি অনুরোধ করেন যেন তাঁর নাম ছাপা না হয়। তাঁর ভাষায়, ‘পত্রিকায় নাম এলে আপনি আমাকে বাঁচাতে পারবেন না।’ তিনি বলেন, ‘এক টাকা রোজগার না হলেও হুমায়ুন নামের ছেলেটাকে হাওলাত করে চাঁদা দিতে হয়, না হলে মারধর করে, অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করে।’

চাঁদাবাজিতে যাঁদের নাম আসছে : ফুটপাতের দোকান থেকে আদায় করা চাঁদার টাকার ভাগ নেন উত্তরা পশ্চিম থানা শাখা আওয়ামী লীগ নেতা নজরুল ইসলাম। তিনি ২০১২ সালে গঠিত উত্তরা থানা যুবদলের সহ-আইন বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। নুরুল আমিন নুরুর বাড়ি উত্তরা পশ্চিম থানায় হলেও তিনি অধিপত্য বিস্তার করে আছেন উত্তরা পূর্ব থানা এলাকায়। তিনিও চাঁদার টাকার ভাগ নেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

যদিও নজরুল ইসলাম ও নুরুল আমিন দুজনই দাবি করেন, তাঁরা চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত নন। তাঁদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।

তবে উত্তরায় চাঁদাবাজদের সমন্বয়ক হিসেবে পরিচিত কৃষক লীগ নেতা রাসেল কারো নাম উল্লেখ না করে বলেন, ‘আমি চাঁদা তুলে নেতাদের ভাগ দিই। নেতারাই বেশির ভাগ টাকা নিয়ে নেন।’

আব্দুল্লাহপুর বেড়িবাঁধ এলাকার দোকান থেকে চাঁদা আদায় করেন কথিত যুবলীগ নেতা জাকির হোসেন। তিনি চাঁদার টাকার ২০ শতাংশ রেখে বাকি টাকা জমা দেন মুক্তা মিয়া নামের একজনের কাছে। মুক্তা মিয়া ওই টাকা জমা দেন মতি নামের আওয়ামী লীগের এক নেতার কাছে।

তবে জাকির হোসেন কাছে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ অস্বীকার করেন।

গরীবে নেওয়াজ এভিনিউয়ের ফুটপাতের দোকান থেকে পদহীন যুবলীগ নেতা ইফতেখারুল ইসলাম জুয়েলের নামে চাঁদা আদায় করেন হুমায়ুন নামের এক যুবক।

রাজউকের প্লটে ফার্নিচার মার্কেট : ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় প্রভাবশালী একটি গ্রুপ সোনারগাঁ জনপথ সড়কে রাজউকের ১৮টি প্লট অবৈধভাবে দখলে নিয়ে ফার্নিচার মার্কেট তৈরি করেছে। সেখানে দোকান আছে ৮০টি। প্রতিটি দোকান থেকে মাসে ভাড়া আদায় করা হয় ৪০ হাজার টাকা করে। সে হিসাবে মাসে ভাড়া আদায় হয় ৩২ লাখ টাকা।

রাজউকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অবৈধ দখলদারদের কারণে তাঁরা প্রকৃত মালিকদের প্লট বুঝিয়ে দিতে পারছেন না। তবে শিগগিরই তাঁরা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করবেন।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, রাজউকের প্লট দখল করে অবৈধভাবে দোকান বসিয়ে ভাড়া আদায় করছেন ইফতেখারুল ইসলাম জুয়েল। এলাকায় নিজেকে যুবলীগের নেতা হিসেবে পরিচয় দিলেও তিনি সংগঠনের কোনো পদে নেই। অভিযোগ রয়েছে, একসময় তিনি ছাত্রদল নেতা আজিজুল বারী হেলালের সঙ্গে চলাফেরা করতেন। মার্কেটের ৫৪ নম্বর দোকানটি তাঁর। ২৯ নম্বর দোকানের আংশিকও তাঁর দখলে। এলাকার কিশোর গ্যাংকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। এ নিয়ে কিছুদিন আগে উত্তরা পশ্চিম থানায় সাধারণ ডায়েরির (জিডি) পর জুয়েলকে পুলিশ আটক করলেও খুব প্রভাবশালী এক রাজনৈতিক নেতার অনুরোধে জিডি মুছে ফেলে তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ। ফার্নিচার মার্কেটের সঙ্গে আরো জড়িত রয়েছেন এক ক্ষমতাশালী রাজনীতিকের ভাগ্নে কবির হাসান। আরো রয়েছেন শ্রমিক নেতা ইউনুস ও উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকার দলীয় নেতা সোহেল।

ফার্নিচার মার্কেটে দোকান ও ফুটপাতে চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে ইফতেখার হোসেন জুয়েল  বলেন, এগুলো অপপ্রচার। আমি বিত্তবান ঘরের সন্তান। নিজে ব্যবসা করি, রাজনীতি করি। আমার চাঁদাবাজির প্রয়োজন হয় না।’

এ বিষয়ে উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি আকতারুজ্জামান ইলিয়াস  বলেন, পুলিশ চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত নয়। তবে চাঁদাবাজি হয়। এগুলো বস্তির লোকেরা করে।’

উত্তরা পূর্ব থানার ওসি মো. কামালউদ্দিন  বলেন, ‘ভাই, আপনি-আমি একই দেশেই বসবাস করি, বাস্তবতাটা বোঝার চেষ্টা করুন। অনেক সময় আমরা চাইলেও ফুটপাত থেকে দোকান উচ্ছেদ করতে পারি না। চাঁদাবাজিও বন্ধ করতে পারি না। তবে চেষ্টা করি তুলে দিতে, আবার এসে বসে।’

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ