রুয়েটে চলছে দূর্নীতির মহাৎসব

নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়- রুয়েটে এখন চলছে বড় ধরণের অনিয়ম দূর্নীতির মহাউৎসব। বেশ কয়েকটি বড় দূর্নীতির ঘটনার সাথে সম্পৃক্তদের চিহ্নিত করা গেলেও উপাচার্য তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে ঘটনা ধামাচাপা দিয়েছেন। এর ফলে দূর্নীতিবাজদের তৎপরতা আরও বেগবান হয়েছে।

রুয়েট সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে রুয়েটে যেসব বড় ধরণের দূর্নীতির ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চেক জালিয়াতের মাধ্যমে ব্য্যংক থেকে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ টাকা আতœসাৎ করার ঘটনা। এই দূর্নীতির ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পর রুয়েট উপাচার্য প্রফেসর মোহা: রফিকুল আলম বেগ প্রথমে বিষয়টি চেপে যাওয়ার চেষ্টা করনে। কিন্ত প্রগতিশীল শিক্ষকদের চাপে তিনি এই আলোচিত দূর্নীতি ঘটনার তদন্তের জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড, মুশফিক আহমেদকে আহ্বায়ক করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কিন্তু তদন্ত কমিটি রুয়েট কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতার কারনে এখনও তদন্ত শুরু করতে পারেনি বলে অভিযোগ করেছেন।

এই দূর্নীতির ঘটনার ব্যাখ্যা চেয়ে দূর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং ইউজিসি উপাচার্য বরাবর পত্র দেন। কিন্তু উপাচার্য এই চাঞ্চল্যকর চেক জালিয়াতির সাথে জড়িত ভারপ্রাপ্ত রেজিষ্ট্রার প্রফেসর মোশারফ হোসেন ও কম্পোট্রলার নাজিমউদ্দীন আহমেদ সম্পৃক্ততা না দেখিয়ে নিন্ম পর্যায়ের কয়েজন কর্মচারীকে দায়ী করে রিপোর্ট দাখিল করেছেন। এছাড়া এই চ্যাঞ্চলকর দূর্নীতির ঘটনা সিন্ডিকেট সভায় অবহিত না করার জন্য সিন্ডিকেট সদস্যগণ প্রচন্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

রুয়েটের কয়েক শিক্ষক ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, রুয়েটেরে এযাবৎ কালের সবচেয়ে বড় দূর্নীতির ঘটনা হচ্ছে সিএসই বিভাগের এক ছাত্রের টেব্যুলিশন শিট টেম্পারিং করে ফাস্ট ক্লাশ পাইয়ে দেয়া। এই ভয়াবহ দূর্নীতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন তৎকালিন উপাচার্য প্রফেসর সিরাজুল করিম চৌধুরী। এই দূর্নীতির বিরুদ্ধে প্রগতিশীল শিক্ষক ও ছাত্রসমাজ ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুললে প্রায় এক মাসের বেশী সময় রুয়েট বন্ধ থাকে। এই রেজাল্ট জালিয়াতের ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রফেসর সিরাজুল করিম চৌধুরীকে উপাচার্য পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় এবং এই দূর্নীতির ঘটনা খতিয়ে দেখতে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

পরবর্তীতে তদন্ত কমিটি এই রেজাল্ট জালিয়াতির সাথে প্রফেসর সিরাজুল কমিরম চৌধুরীর সম্পৃক্ততা জানিয়ে তদন্ত রিপোর্ট রুয়েট কর্তৃপক্ষের নিকট দাখিল করে। কিন্ত বর্তমান উপাচার্য তদন্তের অভিযোগ আমলে না নিয়ে প্রফেসর সিরাজুল কমির চাকুরীর মেয়াদ আরও দুই বছর বৃদ্ধি করে এবং তাঁর বিরুদ্ধে দূর্নীতির নানা অভিযোগ থাকার পরেও তাঁকে পেনশনের সকল পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে অবসর গ্রহণের পথ সহজ করে দেন। এতে আন্দোলনকারী প্রগতিশীল শিক্ষক ও ছাত্রসমাজ প্রচন্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।

সূত্রগুলো আরও জানায়, রুয়েটে আরও একটি বড় দূর্নীতির ঘটনা হচ্ছে, ইউজিসি’র নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে উপাচার্য রুয়েটের আইকিউএসি সেলের পরিচালক ও অতিরিক্ত পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন যথাক্রমে ভারপ্রাপ্ত রেজিষ্ট্রার প্রফেসর মোশারফ হোসেন এবং আইসিইনটি’র পরিচালক প্রফেসর শহীদ উজ্ জামানকে। অথচ আইকিউএসি সেলের নীতিমালায় সৃস্পষ্টভাবে বলা আছে কোন শিক্ষক অন্যকোন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকলে তাঁদের এই দু’টি পদে কোনভাবেই নিয়যোগ দেয়া যাবে না। কিন্তু উপাচার্য এই নিয়ম না মেনে অবৈধ্যভাবে ভারপ্রাপ্ত রেজিষ্ট্রার প্রফেসর মোশারফ হোসেন এবং আইসিইনটি’র পরিচালক প্রফেসর শহীদ উজ্ জামানকে এই দু’টি পদে নিয়োগ দেন। এরমধ্যে ভাপ্রপাপ্ত রেজিষ্ট্রার ও আইকিউএসি’র পরিচালক স্ব স্ব অফিসের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করে অফিস আদেশ নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে বেশীরভাগ সময় ব্যস্ত থাকেন বলে সূত্রটি জানিয়েছে।

তিনি ২০১৭ সালে প্রায় ১৮০ দিন অফিস করেননি। এর মাধ্যমে তিনি রুয়েট থেকেও টিএ ডিএ বিল নিচ্ছেন এবং পরীক্ষক হিসেবেও ভাতা গ্রহণ করছেন। গত চার বছরে অবৈধ্যভাবে তিনি কোটি টাকারও ওপরে টিএ ডিএ বিল তুলেছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া তিনি অফিস আদেশ নিয়ে পরীক্ষকের কাজে বাইরে যাওয়ার কথা থাকলেও সেখানে না গিয়ে টিএ ডিএ ভাতা তুলেছেন বলে চঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। উপাচার্যকে এই বিষয়ে কয়েক শিক্ষক অভিযোগ করলেও তিনি তাঁর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থ্যা গ্রহণ করেনি। সূত্রমতে, রুয়েটের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নের নামে আইকিউএসি’র পরিচালক ও অতিরিক্ত পরিচালক কোটি কোটি টাকা অপচয় করছেন। নিজেদের পছন্দীয় শিক্ষকদের বিদেশ সফরে পাঠাচ্ছেন অথচ এসব শিক্ষকগণ সংশ্লিষ্ট কাজের সাথে সম্পৃক্ত নয়।

সূত্রগুলো জানাচ্ছে, রুয়েটের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, কম্পোট্রলার, প্রধান প্রকৌশলী ও চীফ মেডিকেল অফিসারের মত গুরুত্বপূর্ণ পদে বিএনপি জামায়তপন্থীদের নিয়োগ দিতে উপাচার্য ভয়বাহ দূর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন। এই চারজন নিয়োগ দেয়ার জন্য উপাচার্য পরপর তিনবার নিয়োগ বোর্ড আহ্বান করেন। কিন্তু প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক হাসান আজিজুল হকসহ অন্য নিয়োগ কমিটির অন্যান্য সদস্যগণ বিষয়টি টের পেয়ে তাঁরা কেউ নিয়োগ বোর্ডে উপস্থিত হোননি। এরফলে এই চার বিএনপি জামায়াতপন্থী কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়ার তিনটি উদ্যোগ ব্যার্থ হয়। এরফলে উপাচার্য নিজ ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাতারাতি বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের নিয়ে নিয়োগ বোর্ড গঠন করে এই চার বিএনপি জামায়তপন্থী কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিতে সফল হোন। এই বির্তকিত কর্মকর্তাদের দিয়ে তিনি সকল প্রকার প্রশাসনিক কর্মকান্ড ও অনিয়ম করে চলেছে। এ নিয়ে রুয়েটের প্রগতিশীল শিক্ষকরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

সূত্রমতে, যন্ত্রকৌশল বিভাগের প্রফেসর ড. নূরুন্নবী রুয়েটে ১৫ বছর চাকুরীরত অবস্থায় ৮ বছর দেশের বাইরে উচ শিক্ষা ও চাকুরীর জন্য অবস্থান করেছেন। চাকুরীবিধি অনুযায়ী তিনি ফুল পেনশন পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। কিন্তু উপাচার্য তাঁকে ডেকে নিয়ে এসে রাতারাতি ফুল পেনশন দিয়ে রুয়েটের চাকুরী থেকে অব্যাহতি দিয়ে বড় ধরণের অনিয়ম করেছেন।

রুয়েট সূত্র আরও জানিয়েছেন, বর্তমান উপাচার্য প্রফেসর মোহা: রফিকুল আলম বেগ আরও বেশ কয়েকটি মারাত্বক অনিয়ম ও দূর্নীতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত রয়েছেন। এরমধ্যে তিনি বড় অংকের টাকার বিনিময়ে আর্কিটেকচার ভবন নির্মানের টেন্ডার পাইয়ে দিয়েছেন বিএনপি নেতা আনোয়ার হোসেন উজ্জলকে। এছাড়া গ্লাস এন্ড সিরামিক ভবন নির্মান কাজের ঠিকাদারও ছিলেন বিএনপি’র এই নেতা। এই ভবন নির্মানে নিন্মমানের কাজের অভিযোগ তদন্তে প্রমানিত হয়েছে। অথচ উপাচার্য এই ঠিকাদারের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করে অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে উল্টো তাঁকে অতিরিক্ত ৮০ লাখ টাকার বিল পরিশোধের ব্যবস্থা করেছেন।

সূত্রটি জানায়, এই উপাচার্য টেন্ডার ছাড়াই নিয়বর্হিভূতভাবে ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩০ টি নিন্মমানের এলইডি টিভি ক্রয় করেছেন। যার অনেকগুলো এখন নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। এছাড়া টেন্ডার ছাড়াই তিনি ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রশাসনিক ভবনে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের কাজ করেছেন। এই কাজটি তত্ত্বাবধায়ন করেছেন আইইনসিটি’র পরিচালক প্রফেসর শহীদ উজ্জ জানান। এখানে অনেক অর্থের হরিলুট হয়েছে বলে অভিযোহ পাওয়া গেছে।

সূত্রটি আরও জানায়, সম্প্রতি রুয়েটের বাস, মিনিবাস, মাইক্রোবাস ও জিপ ক্রয়েও মোটা অংকের টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। রুয়েটের জন্য যানবহন বরাবর সরকারী প্রতিষ্ঠান প্রগতি থেকে ক্রয় করা হলেও এবার অর্থ আত্মসাতের জন্য নাভানা থেকে এসব যানবহন উচ্চ মূল দেখিয়ে কেনা হয়েছে। যানবহন ক্রয়ের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন বিএনপিপন্থী কর্মকর্তা কম্পোট্রলার নাজিম উদ্দীন আহমেদ ও সহকারী পরিচালক (ট্রন্সপোর্ট) ফরমান আলী। এছাড়া উপাচার্য ও তাঁর পরিবারের সদস্যগণ রুয়েটের তিনটি জিপ অবৈধ্যভাবে ব্যবহার করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।

রুয়েটের উপাচার্য প্রফেসর মোহা: রফিকুল আলম বেগের বিরুদ্ধে এসব ভয়াবহ দূর্নীতির অভিযোগ বেরিয়ে আসার পর রুয়েটের প্রগতিশীল শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভের সৃস্টি হয়েছে। তাঁরা এই উপাচার্যের বিরুদ্ধে উঠা দূর্নীতির অভিযোগগুলো সুষ্ঠুভাবে তদন্তের জন্য প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী এবং ইউজিসির হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।

তাঁদের মতে, প্রফেসর মোহা: রফিকুল আলম বেগকে দ্বিতীয়বারের মত রুয়েটে উপাচার্য হিসেবে নিয়োহ দেয়া হলে প্রগতিশীল শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী তাঁকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে তাঁর অপসারনের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলে রুয়েটটে অচল করে দেয়া হবে।

রুয়েটে ভয়াবহসব দূর্নীতির পূষ্টপোষক প্রফেসর মোহা: রফিকুল আলম বেগকে কেউ আর রুয়েটের উপাচার্য হিসেবে দেখতে চান বলে তাঁরা ক্ষোভের সাথে জানিয়েছেন। বরং রুয়েটে দূর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে তিনি যে সক্রিয় ভূমিরা রেখেছেন তার যথাযথ তদন্তের দাবী জানিয়েছেন তারা।
স/শ