রায় ঘোষণার পরে ছাত্রলীগ নেতা শাহেনের মা বললেন-‘এখন মরেও শান্তি পাবো’


নিজস্ব প্রতিবেদক:
খতেজা বেওয়া (৮০)। এই বয়সে এখনো হেঁটে চলাচল করতে পারেন। পাড়ার এ বাড়ি-ওবাড়ি এখনো ঘুরে ঘুরে দেখেন তিনি। কিন্তু মাঝে মাঝে যেন আনমনে হয়ে দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়ে পড়ে তাঁর। প্রায় ৮ বছর ধরে যেন তিনি হাসতেও ভুলে গেছেন। হাসি ভুলে কখনো কখনো অনেকটা শব্দ করেও ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি।

আর সেই খতেজা হলেন, রাজশাহী নগরীর গোলজারবাগ গুড়িপাড়া এলাকার মৃত মোয়াজ্জেম হোসেনের স্ত্রী ও ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রজব আলীর মা। ২০১৩ সালে ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই খুন হয়েছিলেন রজবের ছোট ভাই ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শাহিন আলম ওরফে শাহেন শাহ।

শাহেন শাহ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে গতকাল বৃহস্পতিবার। তাতে ৯ আসামির ফাঁসির আদেশ ও ২২ আসামির যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। রায়ের পরে শাহিন আলম ওরফে শাহেন শাহ’র মা কালের কণ্ঠকে বলেন, এখন আমি মরেও শান্তি পাবো। স্বামী মরার পরে যে কষ্টটা না পেয়েছি, তার চেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি আমার জোয়ান ছেলেকে হারিয়ে। আমার তরতাজা ছেলেকে বাড়ির পাশেই কুপিয়ে হত্যা করেছে ওরা। ওদের আমি ফাঁসি দেখে যেতে পারলে আরও খুশি হবো। কিন্তু এতোদিন পরে যে রায় হয়েছে, তাতে আমি অনেক খুশি।’

গতকাল সন্ধ্যায় নিহত শাহেন শাহর বাড়িতে গেলে মা খতেজা বেওয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলেকে যারা কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করেছে, তাদের আমি দ্রুত ফাঁসি দেখতে চাই। তাদের মা-বাবারও বুঝুক ছেলে হারানোর যন্ত্রণা কতটা কষ্টকর।’

প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নগরীর ১ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন ওই এলাকার বর্তমান ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা রজব আলী এবং সাবেক কাউন্সিলর ও বিএনপি নেতা মনুসুর রহমান। ওই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২৮ আগস্ট গুড়িপাড়া সাকিনের ক্লাব মোড়ে রজবের আলীর প্রচারণার সময় মুনসুর রহমানসহ তাঁর লোকজন শাহেন শাহকে কুপিয়ে এবং পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। পরে শাহেন শাহকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ সময় কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

শাহেন শাহ ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ছাড়াও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগ করে করে গেছেন। তিনি ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কার্য নির্বাহী কমিটির সদস্যও ছিলেন। পাশাপাশি রাজশাহী আদালতে শিক্ষানবীশ আইনজীবী ছিলেন। ১৯৯৪ সালে এসএসসি পাশ করে শাহেন শা রাজশাহী কোর্ট কলেজে ভর্তি হন। এর পর তিনি ছাত্রলীগের নেত্রত্বে আসেন।

এক ছেলে-এক মেয়ের মধ্যে বড় মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার মাত্র দুই মাসের মধ্যে বাবা শাহেন শাহকে হত্যা করে বিএনপির নেতাকর্মীরা। সেই থেকে তাঁর স্ত্রী শ্যামলী সংসারের হাল ধরেছেন। এখনো নিজ কাঁধে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন সংসারটাকে। মেয়েকে বিয়ে দিলেও ছোট ছেলে সাজিদ হাসান শান্তকে পড়া-লেকা করাচ্ছে মা শ্যামলী বেওয়া।

তবে শাহেন আলম ওরফে শাহেন শাহ’র স্ত্রী শ্যামলী বেওয়া বলেন, ‘স্বামীর মৃত্যুর পরে বুকে পাথরচাপা দিয়ে রেখেছি। তবে এতোদিন পরে মামলার রায় হলো। এখন খুব মনটা একটু হলেও হাল্কা হয়েছে। যাদের ফাঁসির আদেশ হয়েছে, তাঁদের ফাঁসি যেন কার্যকর হয় দ্রুত। আর যাঁদের যাবজ্জীবন হয়েছে, তারা যেন আর কখনো জেল থেকে বের হতে না পারে। তাহলেই জীবনেই বাকিটা সময় মনকে কিছুটা হলেও মানাতে পারব।’

জানতে চাইলে নিহত শাহেন শাহ’র ভাই নাহিদ আক্তার নাহান বলেন, ‘একের পর এক যখন মামলার রায় ঘোষণার দিনে পরিবর্তন করা হচ্ছিল, তখন প্রতিবারই হৃদয়ে যেন রক্তক্ষরণ আরও বাড়ছিল। ভাইয়ের হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনতে পারব না বলে মনের মাঝে শঙ্কাও তৈরী হচ্ছিল। কিন্তু এখন আমরা অনেক খুশি। শেষ পর্যন্ত আইনের জয় হয়েছে। আমরা জয়ী হয়েছি। আমরা বিচার পেয়েছি। এখন রায় কার্যকর করার দাবি জানাচ্ছি।’

জেএ /এফ