রাস্তার ওপর রাসিকের মার্কেট নিয়ে চলছে বাণিজ্য, ভোগান্তিতে পথচারীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক:

সরকারি জায়গা-জমি দখল করে বাড়ি-ঘর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠার নজির দেশের ইতিহাসে ভুরিভুরি। কিন্তু এক্কেবারে পাকা রাস্তার অর্ধেকাংশ দখল করে মার্কেট গড়ে তোলার নজির খুব কমই আছে বলা যায়। তবে এই কাজটি করেছে খোদ রাজশাহী সিটি করপোরেশন। নগরীর সাহেব বাজার আরডিএ মার্কেটের পাশে মুড়িপট্টি ভেঙে সেখানে ১০ তলা ভবন নির্মাণকাজের জন্য মুড়ির দোকানগুলোকে অস্থায়ীভাবে নগরীর লোকনাথ স্কুলের সামনে বসানো হয়।

পাকা রাস্তা দখল করে সেখানে অস্থায়ী ভিত্তিকে আধা-পাকা মার্কেট গড়ে তোলা হয় সেই ২০১২ সালে। কিন্তু এখন আর কোনো মুড়ির দোকান সেখানে নাই। মুড়ির দোকানের স্থানে গড়ে উঠেছে কম্পিউটার কম্পোজ ও ফটোকপির দোকান। এতে করে বেড়েছে জনভোগান্তি।

সরেজমিন ঘুরে ও দোকান মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লোকনাথ স্কুল মার্কেট থেকে একেবারে রাজশাহী কলেজের সামনে পর্যন্ত সারি করে একে একে গড়ে উঠেছে ২৫টি দোকান ঘর।

নগরীর ব্যস্ততম এই রাস্তাটি দখল করে মার্কেট গড়ে তোলার কারণে ওইদিক দিয়ে সব ধরনের যান চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এতে করে নগরীর সাহেব বাজার, সোনাদিঘীর মোড়, মনিচত্তর মোড় ও রাজশাহী সরকারি কলেজ মোড়ে সবসময়ের জন্য ভীড় লেগেই থাকছে। বিশেষ করে রাজশাহী কলেজ শিক্ষার্থীদের বেশি ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে কলেজে যাতায়াত করতে। কিন্তু দোকানগুলো এখনো ভেঙে ফেলার কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। বরং অস্থায়ী দোকানগুলো নিয়ে রাসিকের কিছু অসাধু কর্মকর্তা মেতেছেন বাণিজ্যে। সেখানে দোকান বসানোর জন্য আদায় করা হয়েছে লাখ লাখ টাকা। আবার মাসিক ভাড়াও আদায় করা হচ্ছে লক্ষাধিক টাকা।

রাজশাহী কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আবু জাফর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রতিদিন ৫টি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ নগরীর লোকনাথ স্কুলের সামনে দিয়ে যাওয়া এই রাস্তাটি ব্যবহার করে। রাস্তার অর্ধেকাংশ দখল করে খোদ সিটি করপোরেশনই গড়ে তুলছে মার্কেট। কিন্তু এই রাস্তা দখল করে মার্কেট নির্মাণের ফলে বছরের পর বছর ধরে চলাচলকারী ৫টি বৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ও সাধারণ মানুষকে ব্যাপক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। আবার রাজশাহী নগরের সোনাদিঘী মোড় এলাকার যানজটও বৃদ্ধি পাচ্ছে।


সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, নগরীর লোকনাথ স্কুলের সামনে দিয়ে যাওয়া জনবহুল ওই রাস্তার প্রায় ১৫ ফিট প্রস্থ ও দুই গজ দীর্ঘ পাকা রাস্তাটির অর্ধেকাংশ দখল করে মার্কেটটি গড়ে তোলা হয়েছে। ২০১২ সালের মার্চ মাসে এই মার্কেটটি অস্থায়ীভাবে গড়ে তোলা হয়। রাস্তার উত্তর পাশ দখল করে একই সারিতে আরো ২৫টি দোকান নির্মণা করা হয়েছে।

  • জানা গেছে, যানজটপূর্ণ নগরের সোনাদিঘি মোড় এলাকা থেকে রক্ষা পেতে নগরীর কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী সরকারি কলেজ, লোকনাথ স্কুল, সার্ভে ইন্সটিটিউট ও রাজশাহী সিটি কলেজের হাজার হাজার শিক্ষার্থী প্রতিদিন লোকনাথ স্কুলের সামনে দিয়ে যাওয়া রাস্তা দিয়ে চলাচল করে থাকেন। এছাড়া রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শতশত রোগী ও হেতেম খাঁ এবং রাজা হাতা এলাকাবাসীও এই রাস্তা দিয়ে চলাচল করেন।

শুরুতে নগরীর সাহেব বাজার আরডিএ মার্কেটের পাশে মুড়ির দোকানদারদের অস্থায়ী ভিত্তিতে পুন:বার্সন করার জন্য লোকনাথ স্কুলের সামনের এই মার্কেটটি গড়ে তোলা হয়। আরডিএ মার্কেটের পাশে ১০ তলা ভবন নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলে মুড়ি ব্যবসায়ীদের আবার সেখানে জায়গা করে দেওয়ার শর্তে রাস্তা দখল করে তাদের জন্য অস্থায়ী ভিত্তিতে লোকনাথ স্কুলের সামনে মার্কেটটি নির্মাণ করে দেওয়া হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মার্কেটটি গড়ে তোলার সময় মুড়িপট্টির ২৫ জন ব্যবসায়ীকে লোকনাথ স্কুলের সামনের রাস্তার ওপরে করা অস্থায়ী মার্কেটের ২৫টি দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু তাদের মধ্যে এখন সেখানে ব্যবসা করছেন তিতাস উদ্দিন, মাসুদ রানা ওরফে রানা, মাইনুল এবং পটা। এই চার ব্যবসায়ী ছাড়া অন্যরা অস্থায়ী দোকানগুলো ভাড়া দিয়ে রেখেছেন কম্পিউটার কম্পোজ ও এবং ফটোকপির দোকানদারদের কাছে। আশে-পাশে ৫টি বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে এই কম্পিউটার ব্যবসা এখানে জমজমাট আকার ধারণ করেছে। কিন্তু ওইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াতকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাসহ হাজার হাজার পথচারি যে বিড়ম্বনার মধ্যে পড়েছেন সেটি আর নজরে আনছে না সিটি করপোরেশন।

  • অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, মুড়িপট্টির ব্যবসায়ীদের মধ্যে জিল্লুর রহমান, শ্রী গণেশ, শাহিন আলী, তিলোক, সান্টু, হাসানসহ অন্য ২২ জন ব্যবসায়ীই এখন সেখানে আর ব্যবসা করেন না। দোকানগুলো সিটি করপোরেশনের নিকট থেকে বরাদ্দ নিয়ে কিছুদিন কয়েকজন সেখানে ব্যবসা করে আবার মুড়িপট্টিতে ফিরে গেছেন। কিন্তু দোকানগুলো তারা ভাড়া দিয়ে মাসের পর মাস টাকা উত্তোলন করে খাচ্ছেন।

আবার কেউ কেউ ভাড়া নিয়ে হাত বদল করে নিজেরা আবার ভাড়া দিয়েছেন। সঙ্গে জামানত হিসেবে লাখ লাখ টাকা আদায় করেছেন। এভাবে রাস্তা দখল করে বছরের পর বছর ধরে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন এই চক্রটি। যার কিছু যাচ্ছে রাসিকেরও কয়েকজন কর্মকর্তার পকেটে। ফলে মার্কেটটিএখন আর উচ্ছেদ করা হচ্ছে না। এতে করে জনদুর্ভোগ থেকেই যাচ্ছে।

এ নিয়ে জানতে চাইলে ভাড়া আদায়কারী হাসান আলী বলেন, ওখানে অন্য কোনো ব্যবসার সুযোগ নাই। তাই জায়গাটি আমরা ভাড়া দিয়েছি।’

  • আরকে ব্যবসায়ী মাসুদ রানা বলেন, তিনি মুড়িপট্টির হাসান আলী নামের এক ব্যক্তির নিকট থেকে জায়গাটি ভাড়া নিয়েছেন। এর জন্য তাকে মাসে ২ হাজার টাকা করে দিতে। হয় তিনি আগেও হাসানের মুড়িপট্টির জায়গায় ভাড়া দোকানে ব্যবসা করতেন। সেই সূত্রে লোকনাথ স্কুলের সামনের মার্কেটেও হাসানের জায়গায় ব্যবসা করছেন। তবে অন্যদের ভাড়া তিন থেকে ৫ হাজার কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশি আদায় করা হচ্ছে। এগুলো হাত বদল হয়ে যাওয়ার কারণেই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত মুড়িপট্টির ব্যবসায়ী এখানে তিনজন ছাড়া বাকি সবাই ভাড়া খাটাচ্ছেন।’

নগরীর আরডিও মার্কেটের পাশে মুড়িপট্টির ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা কয়েকজন মুড়ি ব্যবসায়ী সবমিলিয়ে লোকনাথ স্কুলের সামনের ওই অস্থায়ী মার্কেটে বড় জোর বছর খানেক ছিলাম। এর পর সেখান থেকে চলে এসেছি। কিন্তু আমাদের নাম করে শুরু থেকেই ওই মার্কেটে গড়ে ওঠে বেশ কয়েকটি কম্পিউটার কম্পোজ ও ও ফটোকপির দোকান। এরপর আমরা চলে আসার পরে গোটা মার্কেটটিই এখন চলে গেছে কম্পিউটার কম্পোজ ও ফটোকপির দোকানদারদের দখলে। শুনেছি ওই দোকানগুলো থেকে নিয়মিত মাসিক ভাড়া আদায় করা হয়। আবার দোকানগুলো বসাতেও আদায় করা হয়েছে লাখ লাখ টাকা জামানত। কিন্তু এই টাকা করা নেয় বলতে পারব না।’

  • রাজশাহী সরকারি সিটি কলেজের অনার্স চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ওবাইদুর রহমান বলেন, অনেক দিন ধরে এই কলেজে যাতায়াত করেছি। কিন্তু রাস্তা দখল করে মার্কেট নির্মাণ করার কারণে রিকশা নিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার দূর দিয়ে ঘুরে আসতে হয় কলেজে। অথচ রাজশাহী কলেজের সামনে দিয়ে আসতে পারলে পায়ে হেঁটে এক মিনিটেই কলেজে পৌঁছা যায়।

লোকনাথ স্কুলের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই স্কুলে ২৫ বছর ধরে চাকরি করছি। প্রতিদিন এই রাস্তা দিয়েই স্কুলে যাতায়াত করি। এখন প্রায় এক কিলোমিটার দূর দিয়ে আমাকে ঘুরে স্কুলে আসতে হচ্ছে।’

ওই মার্কেটের একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই দোকান বসাতে হয়েছে এখানে। নগরীর পাঁচটি বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শিক্ষার্থী এখানে কম্পিউটার কম্পোজ ও ফটোকপি করার জন্য ভীড় করে বলে এই জায়গার চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে ব্যাপক হারে। ফলে রাস্তার ওপরে মার্কেটটি গড়ে গড়ে তোলা হলেও কম্পিউটার কম্পোজ ও ফটোকপি দোকানদাররা নিয়মিত মাসিক চাঁদা দেওয়ায় এখন আর মার্কেটটি সরানো হচ্ছে না।

জানতে চাইলে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) আশরাফুল হক বলেন, নগরীর আরডিএ মার্কেটের মুড়ি পট্টিতে বহুতল ভবন নিমার্ণ করা হচ্ছে। সেখানকার ব্যবসায়ীদের সাময়িকভাবে পূর্নবাসনের জন্য সিটি করপোরেশনের নিজ উদ্যোগে রাস্তার ওপরে দোকানঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। ওই মুড়ি ব্যবসায়ীরা নিজেরা দোকান না করে সেখানে ভাড়া দিয়েছেন বলে জানি। তবে আরডিএ মার্কেটের পাশের মার্কেটটির নির্মাণকাজ শেষ হলেই লোকনাথ স্কুলের সামনের ওই অস্থায়ী মার্কেটটি উচ্ছেদ করা হবে।

স/আর