রাসিক নির্বাচন: বিতর্কিতরাই কাউন্সিলর প্রার্থী হচ্ছেন, বাড়ছে উত্তেজনা

নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবারো অধিকাংশ ওয়ার্ডেই বিতর্কিতরাই কাউন্সিলর প্রার্থী হচ্ছেন। এ নিয়ে নগরজুড়ে সাধারণ ভোটারদের মাঝে দেখা দিয়েছে ক্ষোভ। পাশাপাশি বিতর্কিতদের অনেকেই এলাকায় নানাভাবে ভোটারদের প্রভাবিত করারও চেষ্টা করছেন। ফলে মেয়র প্রার্থী নিয়ে বড় দুই দলের মধ্যে এখন পর্যন্ত যতটা না উত্তেজনা রয়েছে, তার চেয়ে তিনগুন উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে ওয়ার্ড পর্যায়ে।
নগরবাসী মনে করছেন, বিতর্কিত এসব কাউন্সিলর প্রার্থীদের কারণেই নির্বাচনী পরিবেশ শেষ পর্যন্ত স্বাভাবিক থাকবে কিনা-তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) বর্তমান কাউন্সিলরদের মধ্যে বিএনপি-জামায়াতপন্থি রয়েছেন ২৩ জন। এঁদের নামে রয়েছে হত্যা, নাশকতাসহ একাধিক মামলা। এর বাইরে আওয়ামী লীগপন্থি কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে রয়েছে মাদক সংশ্লিষ্টতা, প্রতারণাসহ নানা অভিযোগ। কারো কারো বিরুদ্ধে এখনো মামলা চলমান। আবার এবার যারা কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করার জন্য এরই মধ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছেন তাদেরও অধিকাংশের বিরুদ্ধে রয়েছে মাদক সংশ্লিষ্টতা, যৌন কেলেঙ্কারী, প্রতারণাসহ নানা অভিযোগ। ফলে এখন পর্যন্ত সেযব কাউন্সিলর প্রার্থী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন-তাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধেই রয়েছে নানা অভিযোগ। হলফ নামায়ও তাঁদের বিরুদ্ধে চলমান মামলার কথা উল্লেখ করছেন কেউ কেউ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাসিকের বর্তমান কাউন্সিলরদের মধ্যে প্যানেল মেয়র-১ ও ২৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আনোয়ারুল আমিন আযব, ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মুনসুর রহমান, ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাহবুব সাইদ টুকু, ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান, ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর রুহুল আমিন টুনু, ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সোহরাব হোসেন, ১১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবু বাক্কার কিনু, ১২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইকবাল হোসেন দিলদার, ১৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর রবিউল আলম মিলু, ১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ টুটুল, ১৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুস সোবহান লিটন, ১৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর বেলাল আহম্মেদ, ১৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মনির হোসেন, ১৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুরুজ্জামান টিটো, ২৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মুস্তাক হোসেন, ২৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তরিকুল আলম পল্টু, ২৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুরমোহাম্মদ মোল্লা, ২৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আশরাফুল হাসান বাচ্চু, ২৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শাহজাহান আলী ও ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও মতিহার থানা জামায়াতের আমির আবদুস সামাদের বিরুদ্ধে রয়েছে নাশকতা, হত্যাসহ একাধিক মামলা। এদের মধ্যে ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান ও ২৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তরিকুল আলম পল্টু পরে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন।

এছাড়াও সংরক্ষিত-৯ নারী কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র-২ নুরুন্নাহার, সংরক্ষিত-৫ শামসুন্নাহার বেগমের নামেও রয়েছে নাশকতার মামলা। এসব কাউন্সিলররা এবারো নির্বাচনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। তারা প্রচারণাতেও নেমেছেন। এসব কাউন্সিলররা দাবি করেন, রাজনৈতিকভাবে ষড়যন্ত্র করে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। যেন এই নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন তাঁরা। তবে তারা কোনো নাশকতার সঙ্গে জড়িত নয় বলেও দাবি করেন নুরুন্নাহারসহ অন্যরা।

রাজশাহী রাজপাড়া থানা নির্বাচন কার্যালয় সূত্র মতে, গতকাল বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র জমাদানের শেষ দিন পর্যন্ত রাসিক নির্বাচনের জন্য সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৭০ জন এবং সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ৫২ প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।

সূত্র মতে, আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত যেসব কাউন্সিলর প্রার্থী এখন রয়েছেন, তাঁদের মধ্যেও অধিকাংশই নানা কা-ে বিতর্কিত। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান, ৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কামরুজ্জামান কামরু, ২১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নিযাম-উল আযিম, ২৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাহাতাব উদ্দিন, ২৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আরমান আলী নানা কাণ্ডে বিতর্কিত। তাঁদের মধ্যে আরমান আলীর বিরুদ্ধে ছিল মাদক মামলা, মাহতাব আলীর বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ, হাবিবুর ও পল্টুর বিরুদ্ধে নাশকতার মামলা। ৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কামরুজ্জামান কামরুর বিরুদ্ধে রয়েছে পুকুর ভরাটের অভিযোগ। কামরু একসময় বাম রাজনীতি করতেন। পরে বিএনপিতে যোগ দেন। এরপর আওয়ামী লীগে যোগ দেন তিনি।
তবে এসব বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে কাউন্সিলর মাহতাব বলেন আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে কিছু বিতর্কিত সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সেগুলো এলাকার সাধারণ ভোটাররা জানে। তাই ভোটাররা এবারো আমাকেই নির্বাচিত করবেন বলে আশা রাখি।

কামরুজ্জামান কামরু পুকুর ভরাটের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, কেউ আমার নাম ভাঙিয়ে এগুলো করতে পারে। তবে আমি সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করি।’

এদিকে কাউন্সিলর হওয়ার দৌড়ে নির্বাচনে অংশ নিতে আরো যেসব বিতর্কিত নেতাকর্মীদের নাম শোনা যাচ্ছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সম্প্রতি যৌন কেলেঙ্কারীর অভিযোগে ব্যাপক বিতর্কিত বহিস্কৃত যুবলীগ নেতা তৌহিদুল হক সুমন, ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা একসময়ের অস্ত্র, চাঁদাবাজিসহ একাধিক মামলার আসামি রেজাউন্নবী আল মামুনসহ আওয়ামী লীগের আরো একাধিক নেতাকর্মী। সর্বশেষ গত ১৪ জুন আল মামুন ঢাকা থেকে বিমানে রাজশাহী এলে বিমানবন্দরে তাঁর কর্মী-সমর্থকরা পুলিশের সঙ্গে মারপিটে জড়িয়ে পড়েন। এ ঘটনায় তিন কর্মীকে গ্রেপ্তারও করে পুলিশ।

নগরীর ১৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘যাঁদের ভয়ে সাধারণ মানুষ তটস্থ থাকে, তারা কাউন্সিলর প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে রয়েছেন। এরা কাউন্সিলর প্রার্থী হলে নির্বাচনী পরিবেশই বিনষ্ট হবে। সাধারণ ভোটারদের মাঝে নানাভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবে।’

নগরীর ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মুনসুর রহমান বলেন, এই কয়দিন আগেই একজন কাউন্সিলর প্রার্থীর বিরুদ্ধে যৌন কেলেঙ্কারীর অভিযোগ উঠে তোলপাড় হলো। এখন শুনছি তিনিই নাকি নির্বাচন করবেন। এরা প্রার্থী হলে সাধারণ ভোটারদের প্রভাবিত করবেন এটাই স্বাভাবিক। তবে প্রশাসনকে এদের বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।’

নগরীর ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মোমিন বলেন, নাশতকার মামলার আসামিরাও এবার কাউন্সিলর প্রার্থী। এরা জয়ী হলে আবারো তা-ব চালাবেন না তার গ্যারান্টি কোথায়? এদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ব্যবস্থা না নিলে তারা নির্বাচনের সময়ও এলাকায় নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করবেন। এসব নিয়ে সাধারণ ভোটাররা এখনই নানাভাবে শঙ্কিত।’

তবে নির্বাচনে কেউ কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করলে সেটি কঠোর হাতে দমন করা হবে বলে জানান রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ইফতে খায়ের আলম। তিনি বলেন, আমরা প্রার্থীদের সম্পর্কে ডাটা সংগ্রহ করছি। তাঁদের কারো কারো তথ্য আমাদের কাছে আছেও। সে অনুযায়ী প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

স/শা