রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের বর্ষপূর্তি : বিশ্ব শান্তি ও নিরপত্তা নিশ্চিতে যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে

 

ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন :

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে। ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগদান করলে রাশিয়ার নিজস্ব নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে এই সম্ভাবনা থেকে রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান চালায় যা এখন ভয়াবহ এবং বিধ্বংসী যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। বর্তমান অস্থিতিশীল বিশ্ব পরিস্থিতিতে গত এক বছর ধরে চলমান রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের তীব্রতা ক্রমে বেড়েই চলছে। সময় দ্রুত গড়িয়ে যায়, দুর্ভোগের শিকার মানুষগুলো দুর্গতি ও বিভীষিকাময় সময় পার করতে বাধ্য হয়,মানবিকতা ভূলুণ্ঠিত হয় যুদ্ধরত দেশগুলোর অবকাঠামো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ইউক্রেন এখন সে অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।জনগণের এক বিশাল অংশ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে এবং অনেকে নিজের দেশে বাস্তুচ্যুত হয়ে দিনাতিপাত করছে।

ইউরোপের সামরিক ক্ষমতাধর দেশগুলোর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও  কানাডার আধুনিক ও শক্তিশালী ট্যাংক বহর ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর সাথে যোগ হচ্ছে। রুশবাহিনীকে প্রতিহত করতে ইউক্রেন বন্ধু দেশগুলো থেকে যুদ্ধ বিমান চেয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এই যুদ্ধ রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হলেও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দিক থেকে এটা ইউরোপ থেকে আমেরিকা পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল তথা সাড়া বিশ্বের উপর প্রভাব ফেলছে। দীর্ঘ এক বছর পার হলেও বিশ্ব সম্প্রদায় এই মারাত্মক সশস্ত্র সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব ও আমেরিকা ইউক্রেনকে সমর্থন করতে গিয়ে পরোক্ষভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে এবং এই সংকটকে একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।এই যুদ্ধের ফলে ইউক্রেনের অবকাঠামো দিন দিন ধ্বংস হচ্ছে আর অপরিসীম দুঃখ কষ্টে সাধারণ মানুষ বাস্তুচ্যুত ও উদ্বাস্তু জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে।

রুশ সেনাবাহিনী ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর বেসামরিক স্থাপনা ও অন্যান্য স্থানে হামলা করে ইউক্রেনের দোনেৎস্ক,  লুহানস্ক, খেরসন ও জাপোরিঝিয়া দখল করে নিয়েছে। দখলকৃত এলাকাগুলোতে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে। রাশিয়ার দখলে থাকা অঞ্চলগুলো ফিরে পেতে পাল্টা আক্রমণ করেছে ইউক্রেন।এ যুদ্ধে ইউক্রেনের সমর্থনে ন্যাটো সামরিক জোট এবং পশ্চিমাবিশ্ব সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে আর রাশিয়া চীন, তুরস্ক ও ইরানের কাছে সমর্থন ও সহযোগিতা চাইছে। ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর আক্রমণে দেশটিতে পানি ও বিদ্যুতের সংকট চরম আকার ধারণ করেছে এবং লাখ লাখ ইউক্রেনীয় জনগণ বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন অবস্থায় জীবনযাপন করছেন। যুদ্ধের শুরু থেকেই ইউক্রেনীয় বাহিনী রাশিয়ার কাছে থেকে তাদের ভূমি রক্ষা করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমেরিকার দেয়া আর্থিক, সামরিক এবং মানবিক সহায়তার সাথে যুক্তরাজ্যসহ তার মিত্রদের সমর্থনে ইউক্রেন গত এক বছর ধরে রাশিয়ার সাথে যুদ্ধ চালিয়ে আসছে। যুদ্ধের শুরু থেকেই ইউক্রেনকে নানা ধরনের সমরাস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে আসছে পশ্চিমা দেশগুলো। ইউক্রেনকে অত্যাধুনিক ট্যাংক সরবরাহের বিষয়ে একমত হয়েছে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো ও পশ্চিমা মিত্ররা। সামরিক সহযোগিতায় এখন যুক্ত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের শক্তিশালী ও উন্নতমানের ট্যাংক।  পশ্চিমা দেশগুলো একত্রিত হয়ে ইউক্রেনকে নতুন নতুন অস্ত্র সরবরাহের বিপরীতে রাশিয়া নিজেদের শক্তিশালী অস্ত্রগুলোর ব্যবহার শুরু করেছে।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেন সেনাসম্ভারে যোগহচ্ছে জার্মান ট্যাঙ্ক। দ্বিতীয় যুদ্ধের সময় রাশিয়ার কাছে পরাজিত হয়েছিল জার্মানি। আবার ৮০ বছর পর জার্মানির ট্যাঙ্ক লড়াইয়ের ময়দানে রাশিয়ার আক্রমন প্রতিহত করছে। যুদ্ধ চালিয়ে যেতে ইউক্রেন ন্যাটো জোট ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যুদ্ধবিমান দেয়ার অনুরোধ করছে।ইউক্রেনকে যুদ্ধবিমান দেয়া নিয়ে মিত্রদেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান সরবরাহ করবে না বলে জানিয়েছে।পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মাতেউস মোরাউইকিও ইউক্রেনকে যুদ্ধবিমান সরবরাহের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করে জানায় যে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে ‘পুরোপুরি সমন্বয়ের’ মাধ্যমে এই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ইউক্রেনকে যুদ্ধবিমান সরবরাহের বিষয়ে বাল্টিক দেশগুলো ও পোল্যান্ডকে সতর্ক করেছে রাশিয়া।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের অতিরিক্ত দাম মার্কিন ভোটারদের ওপর প্রভাব ফেলেছে। এই যুদ্ধের ফলে আগ্রাসী শক্তিগুলো লাভবান হচ্ছে, অস্ত্রের ব্যবহার ও উৎপাদন বাড়ছে, মানুষ গৃহহীন ও উদ্বাস্তু হচ্ছে, খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে, মূল্যস্ফীতির করাল গ্রাসে পড়ছে মানুষ। উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি ধীর হয়ে গেছে বা থেমে যাচ্ছে, বিশ্ব ব্যাংক ও আই এম এফ তাদের ঋণের হাত বাড়িয়ে সামনের সারিতে চলে এসেছে। ইউরোপে জার্মানরা শক্তিশালী হয়ে উঠছিল, অপর পক্ষে ব্রিটিশদের প্রাধান্য কমে যাচ্ছিল। জার্মানদের উত্থান বেশ ভাল বোঝে ইউরোপীয় শক্তিগুলো, এই যুদ্ধে জার্মান সক্ষমতা কিছুটা হলে ও কমবে।চীন ও জাপান এশিয়াতে এগিয়ে যাচ্ছিল, এখন চীনের সাথে জাপানের দ্বন্দ্বে উভয় দেশের ক্ষমতা কমবে এবং পুনরায় তাদের এই সক্ষমতা ফিরে আসতে সময় লাগবে। রাশিয়া আস্তে আস্তে ক্ষয় হচ্ছে, রাশিয়া, চীন, জাপান ও জার্মানের শক্তি কমে আসলে আবার পৃথিবী সেই আগের অবস্থায় ফিরে আসবে এবং চলমান পরিস্থতি আরও কয়েক দশক স্থায়ী হবে। মধ্যে দিয়ে এশিয়া ও আফ্রিকার উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়া দেশগুলো আবার তাদের পূর্বের অবস্থানে ফিরে যাবে,এটাই আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য।

যুদ্ধের প্রভাবে সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় পণ্যের দাম বেড়ে গেছে।আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল এবং গমসহ নানা ভোগ্যপণ্য এবং সেবার দাম বেড়ে গেছে। নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার জটিল ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়া বিশ্বব্যাপী মূল্যবৃদ্ধির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে এবং পণ্য, খাদ্যসামগ্রী, শক্তি ও সারের উচ্চ মূল্যস্ফীতি ঘটিয়েছে। অনেকগুলি ক্ষেত্রে সরবরাহ শৃংখল বিঘ্নিত হয়েছে। মুদ্রা বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, জাতীয় ঋণের মাত্রা বাড়ছে, এবং অনেক অর্থনীতির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি কঠোর মুদ্রাসংক্রান্ত ও আর্থিক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশের ওপর বড় প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছে। বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে সামরিক সরঞ্জাম, খাদ্যপণ্য ইত্যাদি আমদানি করে এবং তৈরী পোশাকের নতুন বাজার হিসেবেও রাশিয়া বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই যুদ্ধ বেশি দিন স্থায়ী হলে বাংলাদেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। রাশিয়া ও ইউক্রেন গম উৎপাদনের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ, যুদ্ধের কারণে গমেরও সঙ্কট দেখা দিতে পারে। তাই বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতা এবং এক দেশ অপর দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি সমর্থন রেখে যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের পটভূমিতে ‘অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করা এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় যৌথ পদক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনভাব ব্যক্ত করেন।

রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ করার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ একটি খসড়া প্রস্তাবে ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি ব্যাপক, ন্যায্য এবং দীর্ঘস্থায়ী শান্তিতে পৌঁছানো’র ওপর জোর দিতে ভোট দিবে। এ প্রস্তাবে মস্কোর প্রতি সেনা প্রত্যাহারের দাবি তোলা হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা ইউক্রেনে রুশ আক্রমণকে উসকানি ছাড়াই সার্বভৌম দেশের ভূমি দখল বলে দাবি করে আসছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ইউক্রেন ঘুরে এসেছেন ও ইউক্রেনের প্রতি তার সমর্থন পুনঃ ব্যক্ত করেছেন। নানা কারণে মার্কিন জনগণের মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতি সমর্থন হ্রাস পেয়েছে। ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রে হাজার হাজার মানুষ ওয়াশিংটন ডিসি অঞ্চলে মিছিল ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। তারা ইউক্রেন যুদ্ধে আর কোনো অর্থ ব্যয় না করা, ন্যাটো জোট ভেঙে দেয়া এবং প্রতিরক্ষামূলক বাজেট কমানোসহ নানা দাবি জানিয়েছে। অনেকের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারগুলো উপেক্ষা করে ইউক্রেনকে ব্যাপক অর্থ বরাদ্দ দেওয়ায় তারা ক্ষুব্ধ। এই যুদ্ধের কারনে মন্দা থেকে বাঁচতে সবচেয়ে বেশী চাপে আছে উন্নয়নশীল দেশগুলো। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের মত আরও অনেক উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর সংকট বাড়বে বলে মনে করে বিশ্ব ব্যাংক। আমদানি নির্ভর দেশগুলো আমদানি ব্যয় মিটাতে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হবে এবং মুদ্রার অবমূল্যায়ন বন্ধ করতে না পারলে মুদ্রাস্ফীতির চাপ বাড়বে। বৈদেশিক ঋণের চাপ বাড়ার ফলে দেশগুলো নানা ভাবে তাদের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে চেষ্টা করবে।

ইউরোপের দেশগুলো বহু বছর নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে বুঝেছে যে যুদ্ধ কখনো শান্তি আনে না এবং যুদ্ধ উপকরণ উৎপাদন করে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব না। এই যুদ্ধের ফলে ইউরোপের শান্তি ও উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। বহু বছরের যুদ্ধ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ইউরোপের দেশগুলো জানে কিভাবে যুদ্ধ বন্ধ করতে হয়। এই যুদ্ধ যদি সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে ও বিশ্বযুদ্ধে রূপ নেয়  তাহলে পৃথিবী ব্যাপী ধংসযজ্ঞ শুরু হবে এবং আবার দারিদ্র, ক্ষুধা, রক্ত ক্ষরণ পৃথিবীকে গ্রাস করবে। যুদ্ধ কারো কাম্য হওয়া উচিত নয়, সেই সাথে ইউক্রেন হেরে যাক কিংবা রাশিয়া  নিঃশেষ হউক এটা ও কেউ চায় না। এই প্রেক্ষাপটে  বৈশ্বিক উন্নয়ন, শান্তি  ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে এই যুদ্ধ অবিলম্বে বন্ধ করার সক্রিয় উদ্যোগ নিতে হবে। যুদ্ধ এড়িয়ে দু’পক্ষের বিরাজমান সমস্যাগুলো কূটনীতির মাধ্যমে সমাধা করাই বুদ্ধিমানদের কাজ। বিশ্বশান্তি ও মানবাধিকার রক্ষার স্বার্থে সবাইকে এই যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।