স্বার্থ হাসিলের জন্য হয়রানি করা হচ্ছে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের

রামেক হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের লবিংগ্রুপিংয়ের শেষ কোথায় ?


নিজস্ব প্রতিবেদক :
একের পর এক অনাকাঙ্খিত ঘটনায় বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। নানাভাবে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের হয়রানি, একজন আরেক জনের প্রতি বিষেদাগার, কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মধ্যে লবিং-গ্রুপিং, বিশৃংখলা সৃষ্টি করে হাসপাতালে পরিবেশ নষ্ট করাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে এখন রামেক হাসপাতালে চরম অস্থিরতা বিারজ করছে। মূলত মুষ্টিমেয় কিছু কর্মচারিরা সুবিধা না পেয়ে এ ধরনের কর্মকাণ্ডে লিপ্ত বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিশেষ করে সম্প্রতি রামেক হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার অফিসের ইনচার্জ এসএম মোশাররফ হোসেনের ‘এইচএসসি পরীক্ষার সার্টিফিকেট জাল’ এমন অভিযোগ তুলে বেনামে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দেয়ার বিষয়টি কর্মচারিদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। কর্মচারিরা বলছেন এটি বাইরের কাজ নয়, এটি হাসপাতালেরই কর্মচারিদের কাছ। ওয়ার্ড মাস্টার অফিসের ইনচার্জকে হয়রানি ও হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য এ কাজ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে রামেক হাসপাতালের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে দায়ি করছেন কর্মচারিরা। তবে রামেক হাসপাতালের পরিচালক বলছে, বিষয়টি আমাদের নজর আছে। আর হাসপাতালে বিশৃংখলাকারীদের প্রশ্রয় দেয়া হবে না।

জানা গেছে, ২০২০ সালের আগ পর্যন্ত রামেক হাসপাতাল সুষ্ঠু ছিল। ২০২০ সালে নভেম্বর মাসে হাসপাতালটিতে জনবল নিয়োগের পর থেকে অরাজকতা সৃষ্টি শুরু হয়। ওই সময়ে কিছু কর্মচারি নিয়োগ হয়েছে, যারা হাসপাতালে চাকরি করতে এসে নিজেদের ক্ষমতা ও দাপট জাহির করা নিয়ে ব্যস্ত। মূলত সাবেক পরিচালকের সময় মূল দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারিরা দৈনিক মজুরী ভিত্তিক ও আউট সোর্সিং কর্মচারি নিয়োগের নামে যে বাণিজ্য করেছে, এখন তা করতে না পেরে তারা কর্মকর্তারা-কর্মচারিদের নানাভাবে হয়রানি করছেন। যদিও বর্তমান প্রেক্ষপট ভিন্ন। টানা প্রায় তিন বছর হাসপাতালে অরাজকতা চললেও বর্তমান পরিচালক যোগদানের পর হাসপাতালের ভারসাম্য ফিরে এসেছে। কিন্তু পূর্বে দায়িত্বে থাকা কর্মচারি-কর্মকর্তারা এখনো ভেতরে ভেতরে হাসপাতালে বিশৃংখলা সৃষ্টি করছে।

সূত্রে জানা গেছে, সাবেক পরিচালক হাসপাতালে থাকা অবস্থায় মুষ্টিমেয় জুনিয়র কর্মচারিদের নিয়ে তিনি হাসপাতাল পরিচালনা করেছেন। সাবেক পরিচালক হাসপাতাল যাদের নিয়ে পরিচালনা করেছেন তারা পুরো হাসপাতালে দুর্নীতির আখড়ায় পরিনত করে। টাকার বিনিময়ে দৈনিক মুজুরী ভিত্তিক কর্মচারি নিয়োগ, আবার নিয়োগকৃত কর্মচারিদের কাছ থেকে মাসোয়ারা উত্তোলন ছিল এ হাসপাতালের নিত্যদিনের ঘটনা। টানা প্রায় তিন বছর রামেক হাসপাতালের দুর্নীতি পত্র পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে। এসব বিষয়ে কয়েকবার তদন্ত কমিটিও গঠন হয়েছে। কিন্তু তদন্ত কমিটির প্রতিবেদক আলোর মুখ দেখেনি। চলতি বছরের নতুন পরিচালক যোগদানের পর দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়গুলোর তদন্ত শেষ হয়। এতে হাসপাতালের দায়িত্বশীল দুই কর্মচারিকে সতর্ক ও আউট সোর্সিংয়ের দুই কর্মচারিকে চাকরিচ্যুত করা হয়। বর্তমান হাসপাতালে সুষ্ঠু পরিবেশ থাকলেও, সাবেক পরিচালকের সময় দায়িত্বে থাকা বেশ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারি এখনো বিভিন্নভাবে হয়রানি করছে।

জানা গেছে, রামেক হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার অফিসের ইনচার্জ এসএম মোশাররফ হোসেন গত ২০ বছর ধরে চাকরি করছেন। কিন্তু ২০ বছর পর এসে তার এইচএসসি সার্টিফিকেট জাল উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অভিযোগ দেয়া হয়েছে। নাম, ঠিকানা বিহীন অভিযোগটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পাওয়ার পর সেটি তদন্তের জন্য  রামেক হাসপাতালের পরিচালকের কাছে পাঠানো হয়েছে যা তদন্তাধীন রয়েছে। যদিও এক সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদক দাখিলের কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত প্রতিবেদক দাখিল করা হয়নি। শুধু তাই নয়, মোশাররফ হোসেনকে রাজাকারের সন্তান হিসাবে আখ্যায়িত করে হাসপাতালের কিছু অসাদু কর্মচারিরা প্রচারণা চালাচ্ছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইনচার্জ এসএম মোশাররফ হোসেন ১৯৯৫ সালে এইচএসসি পাস করেছেন। তার সার্টিফিকেট জাল উল্লেখ করে অভিযোগ দেয়া হলেও রাজশাহী মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডে ভেরিফাই করে দেখা যায় তার সার্টিফিকটি জাল নয়। রাজশাহী শিক্ষাবোর্ড সূত্র বলছে, এই সার্টিফিকেটে কোনো ধরনের অসঙ্গতি নেই। এমন কি জাল প্রমান করারও কোনো সুযোগ নেই।

এদিকে এসএম মোশাররফ হোসেনকে রাজাকারের পরিবারের সন্তান বলেও আখ্যায়িত করে প্রচারণা চালানোর বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, তার বাবা যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধার সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। তার বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধা খাওয়া দাওয়া করেছেন। মুক্তিযোদ্ধারা তার কাছ থেকে সার্বিক সুযোগ সুবিধা পেয়েছেন। যারা এসএম আখতার উদ্দিনের পরিবারকে রাজাকার বলবে তাদের পরিচয় নিয়েই সন্দেহ রয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে কথা বলা হয় গোদাগাড়ী উপজেলার পাকড়ি ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ইসাহক আলী সাথে। তিনি বলেন, এসএম মোশাররফ হোসেনের বাবা এসএম আখতার উদ্দিন ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। গোদাগাড়ীর পাকড়ি ইউনিয়নে ছিল এসএম মোশাররফ হোসেনের বাবা এসএম আখতার উদ্দিনের বাসা। সেই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ আশ্রয় দিতো না, খাবার দিতো না। কিন্তু এসএম আখতার উদ্দিন মুক্তিযোদ্ধাদের তার বাসায় আশ্রয় দিয়েছেন, তাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। তার বাড়ি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। যুদ্ধ চলাকালীন সময় পর্যন্ত তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে থেকেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নিয়েছেন। তার নাম মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে লেখা বইতেই রয়েছে। তার পরিবারকে নিয়ে কটুক্তি বা খারাপ মন্তব্য করা হলে সেটা মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করার সামিল হবে বলে আমি মনে করি।

এব্যাপারে ওয়ার্ড মাস্টার অফিসের ইনচার্জ এসএম মোশাররফ হোসেন বলেন, কে বা কারা, নাম ঠিকানা বিহীন অভিযোগ দিয়েছে তা জানি না। এ বিষয়টি তদন্ত করার জন্য আমি নিজেও পরিচালককে জানিয়েছি। আমার সার্টিফিকেট কেউ জাল প্রমান করতে পারবে না। আমার সার্টিফিকেট ভেরিফাইয়ের সাথে কে বা কারা এমন মিথ্যে অভিযোগ দিয়েছে তাদের সনাক্ত করার জন্যও পরিচালকের কাছে দাবি জানিয়েছি।

এব্যাপারে রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. এফএম শামীম আহাম্মদ জানান, রামেক হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার অফিসের ইনচার্জের সার্টিফিকেট জাল কিনা জানতে তদন্ত কমিটি কাজ করছে। সার্টিফিকেট জাল হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে, আর সার্টিফিকেট জাল না হলে অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।