রাবিতে ভিসি নিয়োগ : প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে নাম যাওয়া তিন অধ্যাপকের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানোয় ক্ষোভ

নিজস্ব প্রতিবেদক:

তিন মাস অতিবাহিত হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে (রাবি) উপাচার্য নিয়োগ হয়নি। তবে খুব দ্রুতই বিশ^বিদ্যালয়টি নতুন উপাচার্য পেতে যাচ্ছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে। ইতোমধ্যেই বিশ^বিদ্যালয়টির তিনজন সিনিয়র অধ্যাপকের নামের একটি ফাইল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গেছে। ব্যতিক্রম কিছু না ঘটলে চলতি সপ্তাহেই রাবি পেতে পাওে কাঙ্খিত অভিভাবক।

এদিকে উপাচার্য নিয়োগের জন্য যে তিনজন সিনিয়র অধ্যাপকের নামের তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়েছে বলে জানা গেছে তাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ এনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রধামন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের ১৬ সদস্যের স্বাক্ষরে পাঠানো এই চিঠি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র অধ্যাপকগণ ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে- প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের যাওয়া তিন অধ্যাপকগণ হলেন- আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের বর্তমান আহ্বায়ক অধ্যাপক হবিবুর রহমান, পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার এবং সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক জান্নাতুল ফেরদৌস। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, তাদরে কাছে তিন শিক্ষকের বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছে। তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ, পরিবারের রাজনৈতিক মতাদর্শসহ বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজ করা হচ্ছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্রমতে- তালিকার প্রথমে রয়েছে অধ্যাপক হাবিবুর রহমানের নাম।  তাঁর বাবা ডা. ইয়াসিন আলী একজন ভাষাসৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠক। রাষ্ট্রভাষা বাংলা’র দাবিতে ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারী পতাকা দিবসে ভুবন মোহন পার্কে সমাবেশে ছাত্রদের মধ্য থেকে বক্তব্য রাখেন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ডা. ইয়াসিন আলী। ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে নির্বাচন করেন কিন্তু বিএনপির ভোট ডাকাতির কারণে হেরে যান।

দীর্ঘ ৩০ বছর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতিও ছিলেন দীর্ঘদিন। ড. হাবিবুর রহমান এর দুই চাচা মহসিন আলী ও সামশুদ্দিন আহমেদ বীর মুক্তিযোদ্ধা। ড. হাবিবুর রহমান নিজে কলেজ জীবন থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েই শাহজালাল হল ছাত্রসংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্যানেলে সহ-ক্রীড়া সম্পাদক পদে মনোনীত হন। তৎকালীন বাকৃবি’র ছাত্রলীগ নেতা মরহুম আব্দুল মান্নান, টাঙ্গাইলের সাবেক সংসদ সদস্য শওকত মোমেন শাহজাহান, ড. আওলাদ হোসেনের সাহচর্যে রাজনীতি করেছেন।

পরের বছর তিনি রাবিতে বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে ভর্তি হয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের সদস্য নির্বাচিত হন ১৯৯১ সালেই, পরে ১৯৯৭ সালেও নির্বাচিত হন। বর্তমানে এই প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের নির্বাচিত আহবায়ক। ১ /১১ এর সময় শেখ হাসিনার মুক্তি আন্দোলনের জন্য শিক্ষকদের স্বাক্ষর গ্রহণের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন বলেও জানা গেছে।

তিনি ১৯৯০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক পদে যোগদান করেন। নিজ বিভাগের সভাপতি ও বিজ্ঞান অনুষদের ডিনের দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া তিনি শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়ক পদে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন।  ফলে প্রশাসনের দায়িত্বে এই অধ্যাপকের আসার সম্ভাবনাই অনেক বেশি বলে আশা প্রকাশ করছেন বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা।

তালিকায় নাম থাকা আরেক শিক্ষক অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার তাপু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক। বর্তমানে তিনি পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে তিনি ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টার দায়িত্বও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। পরবর্তীতে তিনি নিজ বিভাগের সভাপতি হন। এ ছাড়া তিনি তিন বার প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ছিলেন।

বিশ^বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে- অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার তাপু ১/১১ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুক্তি আন্দোলনে কারাবরণ করেছিলেন। এই অধ্যাপক শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য। তাঁর বড় ভাই গোলাম মাহবুবু সাত্তার মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে তাঁর বড় ভাই শহীদ হন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে- অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার পারিবারিকভাবে আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বর্তমানে তিনি মহানগরীর মতিহার থানা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী মহানগর বঙ্গবন্ধু পরিষদেরর সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।

তালিকায় থাকা আরেকজন হলেন- অধ্যাপক হলেন জান্নাতুল ফেরদৌস। তিনি সমাজকর্ম বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক। তিনি নিজ বিভাগের সভাপতি, হল প্রাধ্যক্ষ, সহকারী প্রক্টর, ছাত্র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ ২০১৯ সালে সিকদার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান। তবে পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব শেষ না করেই তিনি অব্যাহতি নেন। তিনিও পারিবারিকভাবে আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

এদিকে এই তিন অধ্যাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্বলিত যে চিঠিটি শিক্ষামন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছে তা ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। দাবি করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীলমনা অনেক শিক্ষক। অথচ যারা পাঠিয়েছেন তারাও আওয়ামীপন্থী শিক্ষক সমাজের সদস্য বলে জানা গেছে। নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতেই এমন মিথ্যার আশ্রয় নেয়া হয়েছে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।

রাবির সিনিয়র এক অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন- যাদের স্বাক্ষর সম্বলিত চিঠি বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়েছে তাদের অনুসারী জুনিয়র বেশ কিছু শিক্ষকের স্ত্রীদের চাকরি দেয়ার প্রলোভন দিয়ে রেখেছেন। এজন্য নিজেদের প্যানেলের কেউ উপাচার্য হলে এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তিনি আরও বলেন, এই তিন অধ্যাপক গায়ে ভিন্ন রাজনীতির তকমা তারা লাগাতে না পেরে এমন কুৎসা রটিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

রাবির ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মলয় ভৌমিক চিঠির বিষয়ে বলেন, নিউজের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পারলাম। সেখানে স্বাক্ষরকৃত কেউ এ বিষয়ে মুখ খুলতে চাইছেন না, কয়েকজন স্বাক্ষরের বিষয়ে অস্বীকারও করেছেন। মানে এটা ভুয়া অপপ্রচার। বলা যায়, এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন উড়ো চিঠি। সরকার এসব চিঠিকে কোন গুরুত্ব দিবেন না। অবশ্যই সৎ, দক্ষ, প্রগতিমনা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী কাউকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ প্রদান করবেন সরকার।

উল্লেখ্য, গত ৬ মে অধ্যাপক এম. আব্দুস সোবহানের উপাচার্যের দায়িত্ব পালনের মেয়াদ শেষ হয়। ওইদিন সন্ধ্যায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব উপ-উপাচার্য আনন্দ কুমারা সাহাকে দেন। এরমধ্যে গত ১৬ জুলাই আনন্দ কুমার সাহার উপ-উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হয়। পরে সম্প্রতি উপ-উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়া অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলামকে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয় শিক্ষামন্ত্রণালয়।

এএইচ/এস