রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ১১ বছর আজ, বিচারের অগ্রগতি যৎসামান্য

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক

সাভারে রানা প্লাজা ধসের ১১ বছর পূর্ণ হলো আজ। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল আটতলা ওই ভবনটি ধসে পড়ে মারা যায় ১১ শতাধিক পোশাকশ্রমিক। বিশ্বের ইতিহাসে এটি অন্যতম ভয়াবহ শিল্প-দুর্ঘটনা। দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও এ দুর্ঘটনায় দায়ের হওয়া হত্যামামলাসহ তিন মামলার বিচারের সামান্যই অগ্রগতি হয়েছে। অন্য দুটি মামলার মধ্যে ইমারত নির্মাণ আইনে একটি মামলা করেছে রাজউক এবং ইমারত নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগে অন্য মামলাটি করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

এদিকে এ দিনটি ঘিরে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে নানা কর্মসূচি নিয়েছে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন। এক দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও বিচারকাজ শেষ না হওয়ায় হতাশ হতাহত শ্রমিকদের স্বজনরা।

নথি থেকে দেখা যায়, খুনের মামলার তদন্তে সময় লেগেছে দুই বছর। সরকারি ৬ কর্মকর্তাকে চার্জশিটভুক্ত আসামি করার ক্ষেত্রে অনুমতি না পাওয়ায় তদন্ত শেষ করতে দেরি হয়। তাদের চার্জশিটভুক্ত করার বিপরীতে জনপ্রশাসন ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের যুক্তি ছিল- যারা বড় অপরাধ করেননি, তাদের চার্জশিটভুক্ত করার অনুমতি দেওয়া হবে না। তবে অনুমোদন না পেলেও তাদের আসামি করে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এরপর মামলার বিচার শুরুর আদেশ হয় আরও এক বছর পর। আদেশের পরপরই এটি চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে যান সাত আসামি। উচ্চ আদালত থেকে বিচারকাজে স্থগিতাদেশ আসায় প্রায় পাঁচ বছর মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম বন্ধ ছিল।

পরবর্তীকালে ছয়জনের পক্ষে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হলে ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করেন ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এএইচএম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া। তিনি এ সময়ের মধ্যে মামলার ৫৯৪ সাক্ষীর মধ্যে ৮৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করেছেন। আগামী ২৮ এপ্রিল মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে।

হত্যামামলার বিচারের অগ্রগতি সম্পর্কে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) বিমল সমাদ্দার বলেন, আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় প্রায় ৫ বছর বিচারকাজ বন্ধ ছিল। এরপর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। এখন ৮৪ নম্বর সাক্ষীর সাক্ষ্য চলমান আছে। তিনি বলেন, মামলার মূল আসামি সোহেল রানা গত বছরের ৬ এপ্রিল

হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছিলেন। তবে আপিল বিভাগ গত ১৫ জানুয়ারি সেই জামিন স্থগিত করে ৬ মাসের মধ্যে বিচারিক আদালতকে মামলা নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী মামলাটি নিষ্পত্তির চেষ্টা করা হচ্ছে।

তিনটি মামলার ৪২ আসামির মধ্যে ভবনটির মালিক সোহেল রানাই শুধু কারাগারে আছেন। অন্যদের মধ্যে ৭ জন পলাতক, ৩২ জন জামিনে এবং ২ আসামির মৃত্যু হয়েছে।

এদিকে সম্পদের হিসাব দাখিল না করায় সোহেল রানার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলায় ২০১৭ সালের ২৮ আগস্ট তিনি তিন বছরের কারাদ-ে দ-িত হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনের একটি মামলা এবং শ্রম আদালতে শ্রমিকদের করা আরও ১১টি মামলা বিচারাধীন আছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া অবৈধ সম্পদ অর্জন ও তথ্য গোপনের মামলায় গত বছরের ২৯ মার্চ সোহেল রানার মা মোসা. মর্জিনা বেগমের ৬ বছরের কারাদ- হয়েছে।

রাজউকের ইমারত নির্মাণ আইনের মামলা

২০১৩ সালের ২৫ এপ্রিল ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে রানা প্লাজা ভবনটি নির্মাণ করায় রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন ১৩ জনকে আসামি করে সাভার থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায়ও হত্যা মামলার সঙ্গে ২০১৫ সালের ১ জুন পৃথক একটি চার্জশিট দাখিল করেন সিআইডির একই কর্মকর্তা। চার্জশিটে ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে আসামি করা হয়। তাদের মধ্যে ১৭ জনই হত্যা মামলার আসামি।

চার্জগঠনের পর ৩ আসামি চার্জ আদেশ বাতিলের জন্য পৃথক ৩টি রিভিশন মামলা দায়ের করেন। এর মধ্যে ২টি খারিজ হলেও এখনো একটি বিচারাধীন থাকায় সাক্ষ্যগ্রহণ বন্ধ রয়েছে।

দুদকের ইমারত নির্মাণে দুর্নীতির মামলা

ছয় তলা নির্মাণের অনুমোদন থাকলেও নয় তলা ভবন নির্মাণ করে দুর্নীতি করায় ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারা ও দ-বিধির ১০৯ ধারায় সাভার থানায় ২০১৩ সালের ১৫ জুন মামলাটি করে দুদক। এ মামলা প্রসঙ্গে দুদকের প্রসিকিউটর মোশারফ হোসেন কাজল বলেন, মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ চলমান। আশা করি, অপর সাক্ষীদের সাক্ষ্য নিয়ে দ্রুত মামলাটির বিচার শেষ করতে পারব।

তিন মামলার আসামিদের অবস্থান

তিন মামলায় মোট আসামি ছিল ৪২ জন। কারাগারে রয়েছেন শুধু ভবনমালিক সোহেল রানা। ২ আসামি আবু বকর সিদ্দিক ও মো. আবুল হাসান মারা গেছেন।

৭ আসামি এখনো পলাতক। তারা হলেন- সাভার পৌরসভার সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, সাভার পৌরসভার নগর পরিকল্পনাবিদ ফারজানা ইসলাম, নান্টু কন্ট্রাক্টার, মনোয়ার হোসেন বিপ্লব, রেজাউল ইসলাম, নয়ন মিয়া ও সফিকুল ইসলাম।

৩২ আসামি জামিনে আছেন। তারা হলেন- রফিকুল ইসলাম, মো. সারোয়ার কামাল, মো. আওলাদ হোসেন, আব্দুল খালেক ওরফে কুলু খালেক ও মর্জিনা বেগম (সোহেল রানার বাবা-মা), আলহাজ রেফাত উল্লাহ, মোহাম্মাদ আলী খান, রাকিবুল হাসান রাসেল, বজলুস সামাদ আদনান, মাহমুদুর রহমান তাপস, আনিসুর রহমান ওরফে আনিসুজ্জামান, আমিনুল ইসলাম, মো. মধু, অনিল দাস, মো. শাহ আলম ওরফে মিঠু, উত্তম কুমার রায়, মো. আব্দুস সামাদ, বেলায়েত হোসেন, মো. ইউসুফ আলী, মো. মহিদুল ইসলাম, জান্নাতুল ফেরদৌস, মনোয়ার হোসেন বিপ্লব, মো. আতাউর রহমান, মো. আব্দুস সালাম, বিদ্যুৎ মিয়া, সৈয়দ শফিকুল ইসলাম জনি, মো. আব্দুল হামিদ, আব্দুল মজিদ, মো. আমিনুল ইসলাম, মো. ইউসুফ আলী ও মাহবুল আলম।

প্রসঙ্গত, রানা প্লাজা ধসের পর ১,১১৭ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ১৯ জন। আহত হন আরও ১ হাজার ১৭০ জন। তাদের মধ্যে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন ৭৮ জন।

শোকার্তরা এখনো খুঁজে ফেরেন প্রিয়জনের স্মৃতি

স্বজন হারানো শোকার্ত হাজারো মানুষ এখনো দুর্ঘটনাস্থলে খুঁজে ফেরেন প্রিয় স্বজনের স্মৃতি। একদিকে শোকার্ত হৃদয়, অন্যদিকে বিচার না পাওয়ার বেদনায় মুষড়ে পড়েছেন অনেকেই।

রানা প্লাজা ট্রাজেডিতে হারানো ছেলেকে এখনো খুঁজে ফেরেন জয়পুরহাটের ষাটোর্ধ্ব ফেরদৌসী বেগম। ১০ বছর ধরে ছেলের সন্ধান করেছেন তিনি। ‘আমার ছেলে মাহিদুল ইসলাম কাজ করত রানা প্লাজার পঞ্চম তলায়। আমি কি আমার হারানো মানিককে কোনোদিন পাব না?’ প্রশ্ন রাখেন অশ্রুসিক্ত এই বৃদ্ধা।

রানা প্লাজা ধসে ভাগ্যের জেরে প্রাণ ফিরে পাওয়া রুপালি আক্তার বলেন, ‘রুদ্ধশ্বাস ১৭ ঘণ্টা, কীভাবে বেঁচে ফিরেছি জানি না। যখন আমাকে উদ্ধার করা হয়, তখনো বিশ্বাস করিনি বেঁচে ফিরব। দুঃসহ সেই দিনের ভয় আর আতঙ্ক আজও আমাকে তাড়া করে।’

কথা হয় গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতারের সঙ্গে। তিনি বলেন, বছর ঘুরে ২৪ এপ্রিল আসে। কিন্তু বিচার আমরা পাই না। পোশাকশিল্পের ইতিহাসে অন্যতম এই ট্রাজেডির ১১ বছর পার হয়ে গেলেও এখনো শ্রমিকরা তাদের বিচার পাননি। তাদের নায্য দাবি পূরণ হয়নি- এটা আমাদের জন্যে কষ্টের।

প্রতি বছরের মতো রানা প্লাজা ট্রাজেডির দিনটিকে ঘিরে এ কা-ে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করা, ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক ও তাদের পরিবারদের পুনর্বাসন, হতাহতদের ক্ষতিপূরণের আইন পরিবর্তনসহ অন্যান্য দাবি নিয়ে নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন। এসবের মধ্যে রয়েছে দুর্ঘটনাস্থলে হতাহত শ্রমিকদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন, প্রতিবাদ র?্যালি, শিশুদের চিত্রাংকন, আলোচনা সভা ইত্যাদি।