রাণীনগরে উন্নত জাতের গারল পালনে মান্নানের সফলতা

সুকুমল কুমার প্রামানিক,রাণীনগর(নওগাঁ) :

চেষ্টা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে জয় করা যায় অনেক কিছুই। তারই উল্লেখযোগ্য দৃষ্ঠান্ত নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার মালশন গ্রামের বলিদাগাছী পাড়ার আব্দুল মান্নান মোল্লা। তিনি বাড়ির পাশে একটি খামার তৈরি করে উন্নত জাতের গারল পালন করে সফলতার মুখ দেখছেন এই উদ্দ্যোক্তা।

মান্নানের খামারে বর্তমানে ছোট-বড় মিলে রয়েছে প্রায় ৫০ টি গারল। এরই মধ্যে আসন্ন পবিত্র কুরবানী ঈদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে ৮ টি খাসি গারল। এই উদ্যোক্তা আব্দুল মান্নান মোল্লা উপজেলার বড়গাছা ইউনিয়ন মালশন গ্রামের বলিদাগাছী পাড়ার মৃত আব্বাস মোল্লা মাষ্টারের ছেলে।

জানা গেছে, মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন মান্নান। তিনি একজন চাউলের ব্যবসায়ী। ব্যবসার পাশাপাশি পশু পালনের সখ তার অনেক দিনের। গারল পালনের আগে ছোট একটা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন কিভাবে সফল হওয়া যায়। তার সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতেই স্বল্প পরিসরে শুরু করেন গারল পালন। মালশন গ্রামে তার বাড়ির পাশে গড়ে তুলেছেন গারলের খামার।

তেমন কোন অভিজ্ঞতা ছাড়াই ২০১৬ সালে মেহেরপুর জেলা থেকে ৪০ টি গারল কিনে খামার শুরু করেন মান্নান। এতে তার খরচ হয় প্রায় ৩ লাখ টাকার মত। আর খামারসহ অবকাঠামো তৈরীতে খরচ হয় প্রায় ২ লাখ টাকা। মোট ৫ লাখ টাকা ব্যয় করে শুরু করে এই গারলের খামার। ঘাসের চাহিদা মেটাতে আড়াই বিঘা জমিতে লাগানো হয়েছে নেপিয়ার ঘাস। দিনের বেশির ভাগ সময় মাঠে চরে বেড়ায়। এতে খাবারের খরচ অনেকটাই কম হয়। দিনে একবেলা দানাদার জাতীয় খাবার দেওয়া হয়। যেখানে গমের ভ‚ষি, ভুট্টা, ও খৈল থাকে। খামারিরা বলছেন, বর্তমানে গো খাদ্যের দাম তুলনামুলক বেশি। গো খাদ্যে দাম বাড়ায় পশু খামারিরা অনেকটা বিড়ম্বনার মধ্যে পড়েছেন। যদি দানাদার খাবারের দাম কম হয় তবে অনেক বেকাররা আবারও খামারের দিকে আগ্রহী হবে।

স্থানীয় যুবক রানা সরদার জানান, মান্নান ভাই একজন পরিশ্রমী মানুষ। চাউল ব্যবসার পাশা-পাশি তিনি বেশ কয়েক বছর থেকে পশু পালনে ঝুঁকেছেন। বর্তমানে তিনি একজন সফল গারল খামারী। গ্রামের অনেক বেকার যুবকদের জন্য এমন গারল পালন অনুকরনীয় হতে পারে।

খামারী আব্দুল মান্নান মোল্লার প্রবিবেশি যুবক ফিরোজ হোসেনের সাথে কথা হলে তিনি জানান, মান্নান ভাই ৪-৫ বছর আগে থেকে গারল খামার শুরু করেছেন। তার খামারে এখন ৫০ টির মত গারল আছে। প্রতিদিন গ্রামের মাঠে কর্মচারীরা গারলগুরো নিয়ে যায়। মাঠের ঘাস গারলরা খুব পছন্দ করেন। প্রদিদিন গারল গুলোকে দেখি আর খুব যত্ন করা হয়। আমারও মনে ইচ্ছে হচ্ছে এরকম খামার করার।

কথা হয় গারল খামারী উদ্দ্যোক্তা আব্দুল মান্নান মোল্লার সাথে তিনি জানান, কোন ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই খামার শুরু করেছিলাম। প্রথমে যে খামারটি করেছিলাম মাচা না থাকায় বর্জ্যে ঘরের মধ্যে গ্যাস হয়ে গিয়েছিলো। এছাড়া ঠান্ডাও লেগেছিল। এতে ৬ মাসের মধ্যে রোগবালাই হয়ে অনেক গারল মারা গিয়ে শেষ পর্যন্ত ১৩ টি থাকে। পশু ডাক্তার দেখিয়ে কোন সুফল পাওয়া যায়নি। কারন গারল পালনে যে পরিবেশ প্রয়োজন ঠিকমতো তা ছিল না। একারনে রোগে আক্রমণ করে। এজন্য প্রথম দিকে লোকসান গুনতে হয়। পালন করা থেকেই এখন বাস্তব অভিজ্ঞতা হয়েছে। কোন মৌসুমে কি ধরনের সেবা-যত্ন নিতে হবে কখন কি ধরনের ভ্যাকসিন দিতে হবে তা পালন করা থেকে অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে।

তিনি জানান, পরবর্তিতে খামারটির অবকাঠামো পরিবর্তন করায় গারল বসবাস করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করছে। খামারে বর্তমানে ৫০ টি গারল আছে। এর মধ্যে বাচ্চা আছে ১৪ টি। এই কুরবানী ঈদ উপলক্ষে ৮ টি খাসি গারল প্রস্তুত করা হয়েছে। বাজারে গারল বিক্রি করলে প্রকারভেদে ১৫-২৫ হাজার টাকা দাম হবে বলে এমনটাই আশা করছেন তিনি।

খামারী আব্দুল মান্নান আরও জানান, তিন একর জমির ওপর প্রজেক্ট করেছি। যেখানে ছাগল ও গরু পালনের সিদ্ধান্তও নিয়েছি। তবে ছাগলের চেয়ে গারল পালন অনেকটাই সহজ বলে মনে হয়েছে। যে কোন পরিবেশে গারল পালন করা সম্ভব। তিনি বলছেন, দানাদার খাবারের দাম যদি কমানো হয় তাহলে অনেক বেকাররা খামার করতে আগ্রহী হবে। তার খামারে বর্তমানে চারজন কর্মচারী কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কর্মচারীদের বেতন দেওয়া হয় ৬-৮ হাজার টাকা করে।

আব্দুল মান্নানের খামারের কর্মচারী আব্দুল মতিন বলেন, প্রায় তিন বছর থেকে এ খামারে কাজ করছি। সারা বছরই এখানে কাজ করা যায়। অন্য কোথাও কাজ করার প্রয়োজন হয়না। এখানে কাজ করে যে বেতন পাওয়া যায় তা দিয়ে সংসার চলে যায়।

খামারের আরেক কর্মচারী আব্দুল কুদ্দস বলেন, প্রায় ২ বছর যাবৎ মান্নান ভাইয়ের খামারে কাজ করছি। গারল গুলোকে মাঠে নিয়ে যাওয়া, তাদের খাবার দেয়াসহ গারলের দেখাশুনা করতে হয়। মাসে ৮ হাজার টাকা করে আমাদের দেয়া হয়। যা দিয়ে আমাদের সংসারের খরচ চলে। বেকার ছিলাম। এখানে কাজ পেয়ে আমার কর্মসংস্থানের একটা সুযোগ হয়েছে।

এ ব্যাপারে রাণীনগর উপজেলা প্রাণীসম্পদের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. আমিনুল ইসলাম বলেন, মান্নানের খামারে উন্নত জাতের গাড়ল রয়েছে। উপজেলার অন্য কোন স্থানে এত বেশি গারল পালন করা হয়না। অল্প খরচে গারল পালন করে বেশি লাভবান হওয়া সম্বব। গারল পালনের পাশাপাশি তিনি গরু ছাগলও পালনের উদ্দ্যোগ নিয়েছেন। বসে না থেকে যে বেকার যুবকরা আছেন যারা কিছু করে নিজের কর্মসংস্থানের উদ্দ্যেগ নিতে চান তাদের উচিত এই খামার পরিদর্শন করা।

ডা. আমিনুল ইসলাম আরও বলেন, আমরা উপজেলা প্রাণীসম্পদ অফিস থেকে তার খামার বেশ কয়েক বার পরিদর্শন করেছি। উদ্দ্যোক্তা আব্দুল মান্নানকে নানা ভাবে পরামর্শ দিয়েছি। উপজেলা প্রাণী সম্পদ অফিস থেকে তাকে সব সময় সার্বিক সহযোগী করা হবে বলেও জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা। আগামীতে ছাগলের বিকল্প হিসেবে গাড়ল পালন হবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেছেন।

স/জে