সিন্ডিকেটে জিম্মি

রাজশাহী মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩ পদে একই ব্যক্তিকে বার বার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ

 

নিজস্ব প্রতিবেদক:
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ থেকে বিরত থাকতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) থেকে বার বার নির্দেশনা দেওয়া হলেও সেটি মানছে না রাজশাহী মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আর সেই সিদ্ধান্ত অম্যান্য করে একটি সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে ১৩টি গুরুত্বপূর্ণ পদে অযোগ্য ব্যক্তিদের বসানো হয়েছে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে। একজনকে অনধিক ছয় মাসের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার নিয়ম থাকলেও সেটিও মানছে না এ বিশ^বিদ্যলয় কর্তৃপক্ষ। এমনকি রেজিস্ট্রার, পরিচালক, উপচরিচালক, সহকারী পরিচালক পদ মর্যদার ১৩টি পদের একেকজনকে তিন-ছয়বার পর্যন্ত চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এ বিশ^বিদ্যালয়ে। আর একেকটি পদের বিপরীতে বিশ্ববিদ্যালয় আইনের বাইরে গিয়ে একেকজনকে দুই-তিন গুন টাকা বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছে। এতে করে বছরে কোটি টাকা সরকারকে গোচ্চা দিতে হচ্ছে তাঁদের পেছনে। যা বিশ^বিদ্যালয় আইনের চরম লঙ্ঘন বলেও ইউজিসি থেকে চিঠি দিয়ে বলা হয়েছে। আর এই ১৩টি পদই নিয়ন্ত্রণ করছেন একটি সিন্ডিকেট। যাদের মধ্যে ১১ জনই হলেন একই ব্যাচের শিক্ষার্থী পরস্পর বন্ধু। এঁদের নিয়োগের ক্ষেত্রে যে ধরনের অভিজ্ঞতা থাকার কথা, সেটিও পূরণ করা হয়নি। আবারএই সিন্ডিকেটটিই পুরো রাজশাহী মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ে নিয়োগ বাণিজ্য থেকে শুরু করে টেন্ডার, কেনাকাটা এবং স্বজনপ্রীতির সঙ্গে জড়িত বলেও নিশ্চিত হওয়া গেছে।

রামেবি সূত্র মতে, ২০১৭ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরের বছর রেজিষ্ট্রার হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয় অধ্যাপক ডাক্তার আনোয়ারুল কাদেরকে। এরপর দুই বছর টানা তিনি ওই পদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০২০ সালে তাঁকে বাদ দেওয়া হলেও ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর আবারও একই পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। রাজশাহী মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১৬ এর ১৩ ধারা (১০) ধারা অনুযায়ী রামেবির আইন অনুযায়ী ভিসি সিন্ডিকেটের পূর্বানুুমোদনক্রমে কোনো শূন্য পদে সম্পূর্ণ অস্থায়ী ভিত্তিতে অনধিক ৬ মাসের জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিতে পারবেন। প্রয়োজনে উক্ত নিয়োগের মেয়াদ অনধিক ৬ মাস পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে পারবেন। কিন্তু সেই নিয়ম লঙ্ঘন করে চুক্তিভিত্তিক রেজিস্ট্রার পদে আনোয়ারুল কাদেরকে ২০২১ সালের পরে আরও তিনবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। এই পদ মর্যদার কর্মকর্তার বেতন হওয়ার কথা ছিল ৫৬ হাজারের কিছু বেশি। কিন্তু তাঁকে বেতন দেওয়া হয় এক লাখ দুই হাজার ৬৪৩ টাকা। সেই হিসেবে ওই কর্মকর্তার পেছনেই রামেবি বছরে খরচ করে অতিরিক্ত ৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা।

রামেবি সূত্র মতে, এই আনোয়ারুল কাদেরই রামেবির দুর্নীতির মূল হোতা। তাঁর মাধ্যমে রামেবিতে গড়ে উঠেছে বিশাল সিন্ডিকেট এবং পরবর্তিতে তাঁর ব্যাচের আরও ১৩ জনকে একইভাবে বিশ^বিদ্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ ১৩টি পদে বসানো হয়েছে। তাঁদের এককেজনকেও সর্বনি¤œ ৩ থেকে ৬ বার পর্যন্ত চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যাঁদের মধ্যে দুইজনের পূর্ব প্রতিষ্ঠানে চাকররিত অবস্থায় দুর্নীতির দায়ে পেনসন পর্যন্ত বন্ধ আছে। আবার প্রত্যেককেই সম পদের বিপরীতে যে বেতন পাওয়ার কথা, সেটি না করে দুই থেকে তিন গুন করে বেতন দেওয়া হচ্ছে। এভাবে রামেবিতে বছরে অন্তত কোটি টাকা ক্ষতি করা হচ্ছে সরকারের। এছাড়াও এঁদের প্রত্যেকের রামেবিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে যে ধরনের অভিজ্ঞতার থাকা সেটিও পূরণ করা হয়নি। পরস্পর বন্ধু ও আত্মীয়-স্বজন হওয়ার কারণে এই ১৩ জন বছরের পর বছর ধরে রামেবিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে আছেন।

অপর ১২ জনের মধ্যে রামেবির উপরেজিস্ট্রার ডাক্তার আমিন আহমেদকে চার বার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁর বেতন ধরা হয়েছে ৫৫ হাজার ৫২৪ টাকা। ত৭ার বেতন পাওয়ার কথা ছিল ২৯ হাজার টাকার মতো। পরিচালক (অর্থ ও হিসাব) ডাক্তার জাকির হোসেনকে ৬ বার একইভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁর বেতন দেওয়া হয় এক লাখ ১৯ হাজার ৫৪৬ টাকা। অথচ তাঁর বেতন হওয়ার কথা ছিল ৫৬ হাজার টাকার কিছু বেশি। উপপরিচালক আখতার হোসেকে একইভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে চার বার। তাঁর বেতন হওয়ার কথা ছিল ৩৯ হাজার টাকার কিছু বেশি। কিন্তু তিনি বেতন পান ৭৪ হাজার ৭১৬ টাকা। রামেবির জমি অধিগ্রহণ না হতেই পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তর খুলে পরিচালক পদে বসানো হয়েছে সিরাজুম মনির নামে এক প্রকৌশলীকে। তাঁকে একইভাবে চারবার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই কর্মকর্তার বেতন হওয়ার কথাছিল ৫৬ হাজার টাকা। কিন্তু তাকে দেওয়া হয় এক লাখ ১৯ হাজার ৭৯০ টাকা। সাবেক রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক শিবির নেতা এসএম ওবাইদুলকে দুইবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের উপপরিচালক পদে। তাঁর বেতন হওয়ার কথা ৩৯ হাজার টাকা। তাঁকে দেওয়া হয় ৮৪ হাজার ২ টাকা।
এছাড়াও সহকারী পরিচালক হিসেবে আবুল আশরাফকে তিনবার, পরীক্ষা নিয়ণন্ত্রক আনোয়ার হাবিবকে চার বার, উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক সারওয়ার জাহানকে চার বার, সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আমীর হোসেনকে তিন বার, কলেজ পরদির্শক মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেনকে তিন বার এবং জোহা মোহা: মেহের ওয়ারকে চার বার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এদেরও প্রত্যেকের বেতন স্কেলের দুই-তিনগুন বেশি দেওয়া হচ্ছে।

এর মধ্যে সারোয়ার জাহান দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ে চাকরিরত অবস্থায় দুর্নীতির অভিযোগে পেনশন বন্ধ রয়েছে। আমিন আহমেদের রংপুর স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক থাকা অবস্থায় দুর্নীতির অভিযোগে পেনশন বন্ধ হয়েছে।

এছাড়াও দুর্নীতির দায়ে দুদকের মামলার আসামি রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক সহকারী প্রকৌশলী রিয়াজাত হোসেন রিটুকে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে রামেবির প্রকিউরমেন্ট কনসালটেন্ট হিসেবে। তাঁকে বেতন দেওয়া হয় সর্বোচ্চ দুই লাখ এক হাজার টাকা। তাঁর বেতন হওয়ার কথা ছিল ৩৯ হাজারের কিছু বেশি। তাঁকে দুইবার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই পদটিও বিশ্ববিদ্যালয়য়ের উন্নয়ন প্রকল্প শুরু হওয়ার আগে নিয়োগ দেওয়ার নিয়ম নাই। কিন্তু সেটিও করা হয়েছে বিধি বর্হিভূতভাবে। এই রিটু এবং ওবাইদুল ছাড়া অন্যরা সকলেই রেজিস্ট্রার ডাক্তার আনোয়ারুল কাদেরে সহপাঠি। যাঁরা গড়ে তুলেছেন বিশ^বিদ্যালয়ে নিয়োগ বাণিজ্য থেকে শুরু করে, টেন্ডার বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি ও কেনাকাটার নামে লাখ লাখ টাকার দুর্নীতিতে জড়িত। ফলে একই বিশ্ববিদ্যালয়টির কোনো কর্মকর্তার স্ত্রী, ভাতিজা, ভাইসহ পরিবারের একাধিক ব্যক্তি পেয়েছেন চাকরি। সম্প্রতি প্রকাশিত কর্মচারী নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মধ্যমে আরও একাধিক পদে পরিবারের লোকজনকে নিয়োগেরও প্রক্রিয়া চলছে অনিয়মের মাধ্যমে। সিল্কসিটিনিউজের হাতে এসব অনিয়মেরর তথ্য-প্রমাণ এসে পৌঁছেছে।

রামেবির একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, বর্তমান উপাচার্য এ.জেড. এম মোস্তাক গত ২০২১ সালে দায়িত্ব পাওয়ার পরেও এই সিন্ডিকেটটি ভাঙতে পারেননি। বরং বেড়েছে সিন্ডিকেটটির আরও দৌরাত্ব। ফলে একের পর এক চুক্তি ভিত্তিক মেয়াদ বৃদ্ধি করা হচ্ছে ওই ১৩টি পদের কর্মকর্তাদের।

জানতে চাইলে রামেবির রেজিস্ট্রার ডাক্তার আনোয়ারুল কাদের বলেন, ‘আমাদের যাকিছু সিদ্ধান্ত বাস্বতবায়ন হয়, সবই বিশ^বিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে অনুমোদন রয়েছে। আমরা এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেই না। এছাড়াও আমরা কোনো দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। এর বেশিকিছু জানতে চাইলে বিশ^বিদ্যালয়ে আসেন। সাক্ষাতে কথা বলবো।’

এদিকে, জানতে চাইলে বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য এ.জেড. এম মোস্তাক বলেন, ‘যেসব সিদ্ধান্ত নেওযা হয়েছে, সবেই সিন্ডিকেটের অনুমোদনক্রমে। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের কারণে অভিজ্ঞদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এতে নিয়মের কোনো ব্যতয় হয়নি। তবে অন্যান্য যেসব অনিয়ম আছে, সেসব খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

স/আর