রাবিতে থামছেই না ছাত্রী হয়রানি, ‘বহিরাগত’ উৎপাতে জিম্মি শিক্ষার্থীরা

রেদওয়ান বিজয়, রাবি:

‘২১ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টা। কাজলা থেকে হেঁটে হলে ফিরছিলাম। জুবেরী ভবন পার হতেই পেছন থেকে মোটরসাইকেলে আসা দুই যুবক অশ্লীল মন্তব্য করে চোখের পলকেই মিলিয়ে গেল। মিনিট দুয়েক পরেই ওরা আবার সামনে থেকে এসে বুকের ওড়না টান দিয়ে নিয়ে একটু দূরে গিয়ে থামলো। তারপর অট্টহাসি দিয়ে ওড়নাটা রাস্তায় ফেলে চলে দ্রুত কাজলার দিকে চলে গেল।’

এভাবেই হয়রানির বর্ণনা দিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের এক ছাত্রী। শুধু ওই ছাত্রীই নন, এর আগের দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে টিউশনি করিয়ে ফিরছিলেন ওই অনুষদেরই আরেক ছাত্রী। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডে পৌঁছুলে সামনের দিক থেকে দ্রুতগতির একটি মোটরসাইকেল তাকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। সামলাতে না পেরে রাস্তার উপরেই পড়ে যায় ওই ছাত্রী।

এসব যেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিত্যদিনের স্বাভাবিক কার্যক্রমের মতোই। ক্যাম্পাসে বেড়েই চলেছে ছাত্রী হয়রানি ও লাঞ্ছনার ঘটনা। খুন, ছিনতাই, এমনকি দিন-দুপুরে ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রী অপহরণের ঘটনাও সম্প্রতি ঘটেছে।

চলতি মাসের ১৭ তারিখ সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম পাড়া এলাকা থেকে এক ছাত্রীকে জোর করে মাইক্রোবাসে অপহরণ করে তার সাবেক স্বামী। পরে ঢাকা থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়। এসব ঘটনায় ক্যাম্পাসের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে রীতিমতো শঙ্কাগ্রস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

এসব ঘটনায় জড়িত সন্দেহে শিক্ষার্থীরা আঙুল তুলছেন বহিরাগতদের বিরুদ্ধে। তাদের অভিযোগ- ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের চলাফেরায় কোন বাঁধা-নিষেধ না থাকা, মোটরসাইকেলের গতি নিয়ন্ত্রণে কোন ব্যবস্থা না নেওয়া, যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সোচ্চার না হওয়াতেই বহিরাগতরা এ ধরনের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।

নিশ্চুপ যৌন নিপীড়ন নিরোধ কমিটি
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ন নিরোধ কমিটি কাগজে কলমে থাকলেও সেটির কার্যকারিতা নেই বলে জানান শিক্ষার্থীরা। ফলে ছাত্রীরা অভিযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়ছেন। কয়েকজন শিক্ষার্থী অভিযোগ করে বলেন, অনেক শিক্ষার্থী আছেন যারা পুরুষ শিক্ষক কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিতে লজ্জাবোধ করেন। সেক্ষেত্রে যৌন নিপীড়ন নিরোধ কমিটিতে নারী শিক্ষিকা দায়িত্বে থাকায় এখানে অভিযোগ দেওয়া সহজ হয়। কিন্তু এই কমিটি এখন পুরোপুরি কার্যকর নয়।

হয়রানির শিকার দুই ছাত্রী ওই কমিটিকে এ ব্যাপারে জানিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তারা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জানিয়ে কি লাভ? এর আগে অনেকেই এ ধরনের অভিযোগ দিয়েছে। কোন পদক্ষেপই তারা নেয়নি।’

তবে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ অসত্য দাবি করে কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক সেলিনা পারভীন বলেন, ‘আমাদের কমিটি নিজ থেকে কাজ করে না। আর শিক্ষার্থীরাও আমাদের কাছে অভিযোগ করে না। অভিযোগ না পেলে আমাদের পক্ষে কাজ করা অসম্ভব।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক সদস্য জানান, ‘এর আগে আমরা পাঁচটি অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে জমা দিয়েছিলাম। কিন্তু এই প্রতিবেদন নিয়ে সিন্ডিকেট সভায় কোন আলোচনা হয়নি। বিষয়টি উপাচার্যকে জানালে তিনি বিষয়টি দেখবেন বলে আশ্বাস দেন।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন সিনিয়র অধ্যাপক বলেন, উত্যক্তকারীরা পরবর্তীতে সমস্যা করতে পারে বা সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে হয়রানির পরও ছাত্রীরা কোন অভিযোগ করে না। এক্ষেত্রে এই কমিটির উচিত স্বতস্ফুর্তভাবে এসব কর্মকা- প্রতিরোধে কাজ করা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধূরী সারওয়ার জাহান বলেন, ‘সম্প্রতি ক্যাম্পাসে বেশ কয়েকটি ছাত্রী হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। এতে ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে আমরা শঙ্কিত। এ সমস্যা সমাধানে কর্তৃপক্ষের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।’

আটকানো যাচ্ছে না ছিনতাই
এ ছাড়াও ক্যাম্পাসে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে চলেছে অহরহ। ক্যাম্পাসে বেড়াতে এসে গত ৩০ এপ্রিল সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবাস বাংলাদেশ মাঠ চত্বরে ছিনতাইয়ের শিকার হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। ৮ মে রাত নয়টার দিকে জুবেরি ভবনের সামনের রাস্তায় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এক শিক্ষার্থীকে ছুরি দেখিয়ে মোবাইল ও নগদ এক হাজার টাকা কেড়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। ১৫ মে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ভবনের সামনে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে সাইকেল, মোবাইল, ঘড়ি ও মানিব্যাগ হারান ইতিহাস বিভাগের এক শিক্ষার্থী।

ফোকলোর বিভাগের শিক্ষার্থী সায়েম ও আইন বিভাগের পঙ্কতি দেব জানান, ‘ক্যাম্পাসে একের পর এক অপকর্ম করে দুষ্কৃতিকারীরা অনায়াসেই পালিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের প্রতি প্রশাসনের ‘উদাসীন মনোভাবে’ এ সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক লুৎফর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ক্যাম্পাসের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে আমরা একেবারে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ক্যাম্পাসে পুলিশের টহলের পাশাপাশি সাদাপোশাকে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা কাজ করছেন। সামনে বহিরাগত ও মোটরসাইকেল চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অভিযান পরিচালনা চালানো হবে।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে আমরা বসেছিলাম। এ ব্যাপারে প্রক্টরিয়াল বডিকে কঠোর নজরদারির জন্য যথাসম্ভব ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’