রাজশাহী পলিটেকনিকে ছাত্রলীগের তাণ্ডব: নেপথ্যে পরীক্ষা বাণিজ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজশাহী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে তাণ্ডবের নেপথ্যে নিজেদের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী ৪২ শিক্ষার্থীকে পাশ করে না দেওয়ার ঘটনায় ক্ষুব্দ হয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এ ঘটনা ঘটায় বলে অভিযোগ উঠেছে। আর ওই তালিকা করার জন্য ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বাণিজ্যেও জড়িত হয়ে পড়েন বলে দাবি করেছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাও।

তবে ছাত্রলীগ নেতারা দাবি করেছেন, প্রথম পর্বের শিক্ষার্থীদের পরিচিতি অনুষ্ঠানে তাদের বক্তব্য দিতে না দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে কিছু নেতাকর্মী অনুষ্ঠান শেষে অডিটোরিয়ামে ঢুকে চেয়ার-টেবিল, জানালার গ্লাস, মঞ্চ, ফ্যান, বাল্প ভাংচুর ও তছনছ করে।

প্রসঙ্গত, গতকাল মঙ্গলবার সকালের ওই ঘটনার পরে পণ্ড যায় দুপুরে অভিভাবকদের নিয়ে মতবিনিময় সভা এবং দ্বিতীয় শিফটের পরিচিতি অনুষ্ঠান। ছাত্রলীগের হামলায় প্রায় ৫ লাখ টাকার ক্ষতি সাধন হয় কলেজের।

সকাল সাড়ে ১১টার দিকে পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান রিমেল (রিগেন) ও রাশেদ রহমানের নেতৃত্বে এ তাণ্ডব চালানো হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। পরে খবর পেয়ে অতিরিক্ত পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।  এ নিয়ে পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, গতকাল সকাল সাড়ে নয়টায় ডিপ্লোমা প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া নতুন শিক্ষার্থীদের নিয়ে পরিচিতি সভার আয়োজন করে রাজশাহী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট। এ সভায় শিক্ষা ওই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দিন আহমেদ, উপাধ্যক্ষ হাবিবুল্লাহ সরকার ছাড়াও প্রতিষ্ঠানের ৮ বিভাগের বিভাগীয় প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন। ওই অনুষ্ঠান চলা অবস্থায় সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান রিমেল (রিগেন) ও রাশেদ রহমানের অডিটোরিয়ামে গিয়ে প্রবেশ করেন।

প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন শিক্ষক জানান, ছাত্রলীগের ওই নেতা অডিটোরিয়ামে ঢুকেই শিক্ষকদের কাছে জানতে চান, কেন তাদের ছাড়ায় এ অনুষ্ঠান করা হলো, তারা অনুষ্ঠান শুরু করতে দেরি করতে বলার পরেও কেন অনুষ্ঠান আগে-ভাগেই কেন শুরু করা হয়েছে?

এসময় শিক্ষকরা ছাত্রলীগের নেতাদের জানান, অনুষ্ঠান সময়মতোই শুরু হয়েছে। গরমের কারণে সেটি শেষ হতেও চলেছে। তারপরেও ছাত্রলীগের নেতারা বক্তব্য দিতে চাইলে তারা দিতে পারেন বলেও জানানো হয় শিক্ষকদের পক্ষ থেকে। কিন্তু এরপর আর কোনো কথা না বলে ছাত্রলীগের ওই দুই নেতা অডিটোরিয়াম থেকে বাইরে চলে আসেন।

প্রত্যক্ষদর্শী এবং কলেজের শিক্ষকরা অভিযোগ করে জানান, ছাত্রলীগ নেতা রিগেন ও রাশেদ অডিটোরিয়াম থেকে বের হওয়ার পরপরই মিছিল শুরু করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এরই মধ্যে পরিস্থিতি বেগতিক দেখে অনুষ্ঠান শেষ করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অডিটোরিয়াম থেকে বের হয়ে যান। এরপর অডিটোরিয়ামে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় তালা।

কিন্তু ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মিছিল শুরু হওয়ার পর পরই সকাল ১১টার দিকে তারা অডিটোরিয়ামের তালা ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করে। এরপর তারা অডিটোরিয়ামের ভিতরের মঞ্চ, ভাড়া করে আনা চেয়ার-টেবিল ফ্যান, অডিটোরিয়ামের জানালার কাঁচ ও বাল্প ভাংচুর করতে থাকে। পরে খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে তৎক্ষণে অনুষ্ঠানস্থলের সবকিছু ভেঙে তছনছ করা হয়। সবমিলিয়ে প্রায় ৫ লাথ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

ওই অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার জন্য নগরীর শালবাগান বাজারের শাপলা ডেকোরেটর থেকে চেয়ার এবং ফ্যান বাড়া করে আনা হয়। সেই সঙ্গে অনুষ্ঠানের মঞ্চও তৈরী করে শাপলা ডেকেরেটর। কিন্তু অনুষ্ঠানের জন্য আনা ৬৪০টি চেয়ার এবং ৬টি ফ্যান ভাঙচুর করে তছনছ করা হয়। এছাড়াও কলেজেরও অন্তত ৫০টি চেয়ার ও দুটি ফ্যান ভাঙচুর করা হয়। সবমিলিয়ে প্রায় ৫ লাখ টাকার ক্ষতি করা হয় বলে দাবি করেন ডেকেরোটর মালিক ফরহাদ হোসেন।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ রহমান বলেন, ওই অনুষ্ঠানে আমাদের কোনো বক্তব্য দিতে দেওয়া হয়নি। আবার আগস্ট মাস শোকের মাস হলেও নিরবতা পালন করা হয়নি। সেইসঙ্গে এখানে কোনো রাজনীতি করা যাবে না বলে অধ্যক্ষ ঘোষণা দেন। এসব কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে কিছু কর্মীরা অডিটোরিয়ামে প্রবেশ করে কয়েকটি চেয়ার ভাঙচুর করেছে।

কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান রিমেল ওরফে রিগেন বলেন, ‘প্রতিবার আমাদের বক্তব্যে দিতে দেওয়া হয় পরিচিতি সভায়। কিন্তু এবার বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়নি। আমাদের পরিচিত করে না দিলে আমাদের চিনবে কি করে নতুন শিক্ষার্থীরা? আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি করা যাবে না বলেও ঘোষণা দিয়েছেন অধ্যক্ষ। এসব নিয়েই ক্ষুব্ধ হয়ে কিছু নেতাকর্মী কয়েকটি চেয়ার ভাঙচুর করেছে। এর বাইরে তেমন কিছু হয়নি।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে ছাত্রলীগের ওই নেতা বলেন, ‘রেজাল্ট হয়েছে গত রবিবার বিকেলে। কাজেই রেজাল্টের সঙ্গে এ নিয়ে কোনো সম্পর্ক নাই। ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতেই এখন এই কথা বলা হচ্ছে।

ইন্সটিউটের অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দিন বলেন, কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বেই এ হামলা চালানো হয়। এ ঘটনার ব্যবস্থা নিতে আমরা কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছি।’

তিনি আরো জানান, প্রতিষ্ঠানে দ্বিতীয় পর্বের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় পাশ করানোর জন্য ছাত্রলীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক দুজনে মিলে অন্তত ৪০০ জনের তালিকা দেন প্রত্যেকটি বিভাগের প্রধানদের।

এর মধ্যে ৪২ জন শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হওয়ায় ছাত্রলীগের ওই নেতারা ক্ষুব্ধ হন। গত সোমবার সকালেও এসে তারা আমাদের হুমকি দিয়ে গেছেন। এরপর পরিচিতি সভায় তাদের আমন্ত্রণ করে বক্তব্য দিতে বলা হলেও তারা সেটি না করে দলবল নিয়ে অডিটোরিয়ামে ঢুকে ব্যাপক ভাঙচুর করেছে। এটি মেনে নেওয়া যায় না।’ ছাত্রলীগের দেওয়া পরীক্ষার্থীদের তালিকাও কালের কণ্ঠকে দেখান অধ্যক্ষ।

অধ্যক্ষ আরো জানান, সকালে পরিচিত সভা ছাড়াও দুপুর ১২টা অভিভাকদের নিয়ে মতবিনিময় সভা এবং দুপুর আড়ায়টায় দ্বিতীয় শিফটের শিক্ষার্থীদের পরিচিতি সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল অডিটোরিয়ামে। কিন্তু পরের দুটি অনুষ্ঠান ভেস্তে গেছে চেয়ার-টেবিল জানালার কাঁচ এবং মঞ্চ ও ফ্যান ভাঙচুরের কারণে।

এদিকে পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট সূত্র মতে, গত জুন-জুলাই দ্বিতীয় পর্বের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এ পরীক্ষায় মোট ৯৪০ জন অংশ গ্রহণ করে। তাদের মধ্যে অন্তত ৪০ জনকে পাশ করানোর জন্য আটটটি বিভাগের বিভাগীয় প্রধানদের কাছে হাতে লিখা তালিকা পাঠান ছাত্রলীগ সভাপতি মেহেদী হাসান রিমেল ওরফে রিগেন এবং সাধারণ সম্পাদক রাশেদ রহমান।

ইন্সটিটিউটের একাধিক শিক্ষক অভিযোগ করে বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী শতকরা ৪০ মার্ক পেলে তবেই পাশ দেওয়া হয় পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের। সেই হিসেবে খাতা মূল্যায়ন শেষে রাজশাহী পলিটেকনিকের দ্বিতীয় পর্বে ৯৪০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে পাশ করে মাত্র ১৮১ জন। অকৃতকার্য হয় ৪২৫ জন। আর রেফার্ড লাভ করে (এক থেকে দুই বিষয়ে অকৃতকার্য) ৩৩৩ জন। তবে ছাত্রলীগের নেতাদের চাপে একপর্যায়ে যারা ১০ পেয়েছে তাদেরও পাশ দিতে বাধ্য হন শিক্ষকরা। এরপর ৪২ জন শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হন। আর তাতেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন ছাত্রলীগ নেতা রিগেন ও রাশেদ।

ওই সূত্রটি আরো জানায়, ফলাফল ঘোষণা হয় গত রবিবার বিকেলে। এরপর গত সোমবার সকাল ১০টার দিকে ছাত্রলীগ নেতা রিগেন এবং রাশেদ অধ্যক্ষ ফরিদ উদ্দিনের কক্ষে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়েন। এসময় বিভাগের প্রধানদের নিয়ে বৈঠক করছিলেন অধ্যক্ষ। কিন্তু বিভাগের প্রধানদের বাইরে যেতে বলেন ছাত্রলীগের ওই দুই নেতা। তবে শিক্ষকরা ছাত্রলীগের দুই নেতার শারীরিক ভঙি দেখে তাঁরা আর বাইরে যাননি। ফলে বিভাগের শিক্ষকদের সামনেই ছাত্রলীগের দুই নেতা অধ্যক্ষের কাছে জানতে চান, কেন ৪২ জনকে ফেল দেখানো হয়েছে?

এর প্রতি উত্তরে অধ্যক্ষ তাঁদের জানান, এ নিয়ে বিভাগের প্রধানরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে যারা ফেল করেছে, তারা পরীক্ষার উত্তর পত্রে যা লিখেছে-তার প্রতিফলই দিয়েছেন শিক্ষকরা। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ছাত্রলীগের দুই নেতা রিগেন ও রাশেদ অধ্যক্ষকে বিভাগের প্রধানদের সামনেই নানাভাবে হুমকি-ধমকি দিয়ে বের হয়ে চলে যান।

এরপর গতকাল নবাগত শিক্ষার্থীদের পরিচিত সভায় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেওয়ার জন্য সোমবার বিকেলেই ফোন করে দাওয়াত দেন উপাধ্যক্ষ হাবিবুল্লাহ সরকার। কিন্তু গতকাল ওই অনুষ্ঠানের একেবারে শেষদিকে গিয়ে ঝামেলা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন ছাত্রলীগের ওই দুই নেতা। তবে পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে অনুষ্ঠান তড়িঘড়ি করে শেষ করে দেওয়া হলেও পরে গিয়ে ভাঙচুর চালায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মী।

পলিটেকনিকের একাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী অভিযোগ করে জানান, পরীক্ষায় পাশ করে দেওয়ার নাম করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ব্যাপক বাণিজ্য করে থাকেন। এমনকি পরীক্ষার হলে শিক্ষকরা যেন কড়াভাবে ডিউটি করতে না পারেন, সে জন্যেও হুমকি দেওয়া শিক্ষকদের। পরীক্ষা শেষে আবার বিভাগীয় প্রধানদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় পরীক্ষার্থীদের তালিকা।

ছাত্রলীগ নেতাদের টাকা দেওয়ার কথা কোনো কোনো শিক্ষার্থী স্বীকারও করেছেন। তবে কেউ হয়রানি ও সম্মানের ভয়ে এ নিয়ে মুখ খুলতে চাননি। তারা এও জানান, পলিটেকনিক ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান রিমেল ওরফে রিগেন এবং সম্পাদক রাশেদ রহমানের ছাত্রত্ব দুই বছর আগেই শেষ হয়েছে।  ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার কথা স্বীকারও করেছেন দুই ছাত্র নেতা। তবে তারা তালিকা দেওয়ার নামে টাকা আদায়ের কথা অস্বীকার করেছেন।

তাঁরা বলেন, ‘এই ধরনের অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমরা কারো নিকট কোনো অর্থ আদায় করিনি। এটা কেউ বলতেও পারবে না। তবে কিছু নিজেদের কর্মী যারা পরীক্ষা দিয়েছে তাদের তালিকা আমরা দিয়েছিলাম এটা সঠিক।’

স/আর