রাজশাহী থেকে বছরে সাড়ে ৭’শ কোটি টাকার মাছ যায় বিভিন্ন জেলায়

আমজাদ হোসেন শিমুল:
রাজশাহীতে কয়েক বছর থেকেই মাছ চাষে রীতিমতো বিপ্লব ঘটে গেছে। আর নতুন করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তাজা মাছ সরবরাহে প্রথম স্থানেও এখন রাজশাহী বিভাগ। প্রতিদিন রাজশাহী জেলা থেকে ১৪০-১৫০ ট্রাকযোগে প্রায় দুই কোটি টাকার তাজা মাছ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলে যাচ্ছে। সেই হিসেবে বছরে গড়ে প্রায় ৭ শত ৩০ কোটি টাকার তাজা মাছ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে গিয়ে বিক্রি হচ্ছে। এতে দেশের ফরমালিন মুক্ত মাছ পাচ্ছে বাইরের ক্রেতারা। সেই সাথে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল হওয়ার পাশাপাশি শিল্প কারখানা বিহীন রাজশাহীতে নতুন করে তৈরি হচ্ছে বেকারদের কর্মস্থান।

রাজশাহী বিভাগীয় মৎস অফিস সূত্রে জানা যায়, তাজা মাছের বাইরে পাঠানোর উৎদ্যেগটি প্রথমে রাজশাহী জেলা থেকে শুরু হয়। জেলার পুঠিয়া, পবা, মোহপুর, দুর্গাপুর, বাগমারা ও তানোর উপজেলা এবং নাটোর জেলার সিংড়া, গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রামের মাছ সবচেয়ে বেশি ঢাকাতে যাচ্ছে। রাজশাহী জেলা থেকে প্রতিদিন অন্ততপক্ষে ১৫০ ট্রাক মাছ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলে যাচ্ছে। আর একটি ট্রাকে মাছ থাকে ৭০০ থেকে ৯০০ কেজি। বর্তমানে জেলার ১২ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এই মাছ চাষে। সেই হিসেবে প্রায় দুই লক্ষ ৮৮ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান এখন মাছ চাষে। রাজশাহী বিভাগের বাইরে বছরে প্রায় সাড়ে ৭ শত কোটি টাকার মাছের ব্যবসাসহ মাছচাষে সবমিলিয়ে আয় হচ্ছে কয়েক হাজার কোটি টাকা।

মৎস অফিস সূত্র জানায়, জেলায় বর্তমানে ১৩ হাজার ৫০ হেক্টর জমির কয়েক হাজার পুকুরে প্রতিবছর ৮৪ হাজার মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হচ্ছে। তবে গত ৫ বছরে জেলায় আরো নতুন করে আরো কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে পুকুর খনন করা হয়েছে। যা মৎস্য অফিসের অন্তর্ভৃক্ত নয়।

রাজধানীতে উত্তরাঞ্চলের তাজা মাছের ব্যাপক চাহিদা থাকায় এখানে প্রতিনিয়ত নতুন পুকুরের পাশাপাশি বাড়ছে চাষিদের সংখ্যা। তথ্যমতে, রাজশাহী জেলায় সবমিলিয়ে প্রতিবছর ৮৪ হাজার মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হচ্ছে। যার বর্তমান বাজার মূল্য কয়েক হাজার কোটি টাকা। আর মৎস্যজীবিদের মাঝে নতুন করে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার বেকার যুবকের।

জেলার বিভিন্ন উপজেলার কয়েকজন মাছ চাষি ও ব্যবসায়ীদের সাথে কথা হলে জানা গেছে, রাজধানীসহ সারাদেশে রাজশাহী অঞ্চলের উৎপাদিত বিভিন্ন প্রকার মাছের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আর মাছে ফরমালিন আতঙ্কের কারণে ক্রেতারা গত কয়েক বছর থেকে বড় আকারের তাজা মাছ কিনতে বেশী আগ্রহী হয়েছে। তাদের চাহিদা মোতাবেক প্রতিদিন শত শত ট্রাকে বিশেষ ব্যবস্থায় তাজা মাছ সরবরাহ করছেন চাষিরা। বর্তমানে বড় ও তাজা মাছগুলো প্রকার ভেদে প্রতি কেজি ৩শ’ থেকে ৩৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে করোনাকালে বাজার একটু কমেছে।

চাষী ও ব্যবসায়ীরা আরো জানান, তাজা মাছের জন্য প্রথমে পলিথিন বিছিয়ে সেখানে পানি দিয়ে তাজা মাছগুলো ছাড়া হয়। সারা রাস্তায় পলিথিনে অক্্িরজেন বাড়াতে একজন পা দিয়ে পানি নাড়াতে থাকে। আর ট্রাকের পানি পরিস্কার রাখতে পথে একবার পানি পাল্টাতে হয়। এজন্য সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গাজীপুরের কয়েক জায়গায় রাস্তার পাশে পানির মেশিনের ব্যবস্থা করা আছে। মরা মাছের চেয়ে তাজা মাছের চাহিদা ও দাম বেশি থাকায় এখন শুধু মৎস্য ব্যবসায়ীরাই নয়, অনেক শ্রেণি-পেশার মানুষ মাছ চাষ করছে।

পবা উপজেলার মৎস্য বাবসায়ী সাদিকুল ইসলাম জানান, আমি ২০০৭ সালে সামান্য কয়েক কাঁঠা পুকুর দিয়ে মাছ চাষ শুরু করি। ১৩ বছরে এখন প্রায় ১৮০ বিঘার পুকুর হয়েছে তার। তিনি বলেন, মাছ চাষ লাভজনক ব্যবসা। তবে তাজা মাছ আরো বেশি লাভজনক। মরা মাছ যেখাতে ১০০ টাকা কেজি সেখানে তাজা মাছ ২০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করা হয়। তিনি জানান, করোনায় চাষী ও আড়তদারা দাম পাচ্ছে না। ঢাকায় পাইকারীরা বাড়ি বাড়ি মাছ দিয়ে দ্বিগুণ লাভ করছে। আমার এখানে প্রায় সকল মাছ তাজা অবস্থায় ঢাকাতে পাঠাই।

পুঠিয়া উপজেলার শিলমাড়িয়া ইউনিয়নের মাছ চাষী এরশাদ আলী জানান, গত কয়েক বছর থেকে বাজার ভালো হওয়ায় বর্তমানে এই এলাকায় অনেকেই এখন মাছ চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। অনেক কৃষক তাদের নিচু জমিগুলোতে এখন পুকুর খনন করছেন। আবার কেউ তাদের জমিগুলো পুকুর খনন করতে আগ্রহী হয়ে মৎস্য চাষিদের নিটক লীজ দিচ্ছেন।

তিনি জানান, বর্তমানে এই এলাকায় প্রতি বিঘা পুকুর বছরে ইজারা মূল্য ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। আর আধুনিক প্রযুক্তিতে প্রতিবছর এক বিঘা পুকুরে প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ টাকার মাছ উৎপাদন করা সম্ভব। লাভ বেশি হওয়ায় মাছ চাষ করা হচ্ছে।

মৎস অফিস সূত্র বলছে, রাজশাহীতে এখন ৮৪ হাজার মেট্রিকটন টন মাছে উৎপাদন হচ্ছে। এই মাছের মধ্যে ৫২ হাজার মেট্রিক টন মাছ রাজশাহী বিভাগের চাহিদা পূরণ করে উদ্বৃত্ত বাকি প্রায় ৩২ মেট্রিক টনের পুরোটাই যাচ্ছে বিভাগের বাইরে। তবে রাজশাহীর বিভিন্ন জায়গায় অপরিকল্পিত পুকুর খননের ফলে এখন দেখা দিয়েছে পরিবেশ বিপর্যয়। মাছ চাষে অধিক লাভের আশায় দিনে দিনে ফসলি জমিতে পুকুর খনন করে বিল জলাশয়ে পানি জমে ফসল নষ্ট হচ্ছে। রাস্তাঘাটে পানি জমে যাচ্ছে। সেই সাথে কমে যাচ্ছে ফসলি জমি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মৎস্য অফিসের এক কর্মকর্তা জানান, পুকুর করে মাছ চাষ অবশ্যই একটি লাভজনক পেশা। যার কারণে অনেক চেষ্টা করেও পুকুর খনন প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। কৃষক পুকুরে মাছ চাষ করে যে টাকা পাচ্ছে তা অন্য কোনো ফসলে পাচ্ছে না। তাই অনেকে লিজ দিয়ে দিচ্ছে। এতে নতুন করে রাজশাহীতে জলাবন্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। তবে পকুর খননের বিষয়েও প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে।

রাজশাহী বিভাগীয় মৎস অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক অলোক কুমার বলেন, ‘মাছ চাষের জন্য রাজশাহী আগে থেকেই উপযুক্ত জায়গা। তবে কয়েক বছরে রাজশাহীসহ পাশর্^বর্তী জেলা নাটোরে এই মাছ চাষে বিপুল মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। বর্ষায় ধান ক্ষেতে মাছ চাষ, খাঁচায় মাছ চাষ অনেক লাভজনক। এখন নদীর মধ্যেও পুকুর করে মাছ চাষ করা সম্ভব হচ্ছে। সবমিলিয়ে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষে এখন স্বাবলম্বী রাজশাহী।’

এএইচ/এস