রাজশাহী কলেজের সেকাল-একাল

শাহিনুল আশিক:

রাজশাহী কলেজ। প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৭৩। কলেজজুড়ে অনেক স্মৃতি রয়েছে। শতবর্ষ কলেজটি স্মৃতিময় হয়ে রয়েছে; যে কলেজটি শিক্ষা বিস্তারের নেতৃত্ব দিচ্ছে। শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিস্তারের এক গৌরবোজ্জ্বল জীবন্ত ইতিহাস এই কলেজ। জ্ঞানচর্চায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে। ২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে পর পর তিনবার বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি অর্জন করে। শুধু তাই নয়, কলেজ তার অতীত গৌরবের ধারা অব্যাহত রেখেছে।
দীর্ঘ সময়ের পথ চলায় এর পরতে পরতে স্মৃতি জড়িয়ে আছে বেরিয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীদের। বর্তমানে রাজশাহী কলেজ রূপান্তরিত হয়েছে জাতীয় উন্নয়নের অনুপ্রেরণার উৎসে।
তবে ১৮৭৩ সালের সেই পরিচিত কলেজটি পাল্টেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। যদিও সেই প্রাচীন ভবনগুলো আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সেই রঙে-ঢঙে। শুধু বছর-বছর আগমন ঘটেছে নতুন অতিথির। এই ক্যাম্পাস থেকে পড়ালেখা শেষ করে কর্মজীবনে সফল হয়েছেন বহুজন।
১৮২৮ সালে বোয়ালিয়া ইংলিশ স্কুল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির শুরু। ১৮৭৮ সালে এই প্রতিষ্ঠানকে প্রথম গ্রেড মর্যাদা করা হয় এবং রাজশাহী কলেজ নামকরণ করা হয়। কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করে এখানে বিএ কোর্স চালু করা হলে উত্তরবঙ্গের সর্বপ্রথম এবং পরবর্তীকালে সর্বশ্রেষ্ঠ কলেজ হিসেবে পরিচিতি পায় এই কলেজ। ১৮৮১ সালে এই কলেজে স্নাতকোত্তর কোর্স প্রবর্তন করা হয়।
প্রতিষ্ঠার শুরুতে রাজশাহী কলেজের কোনো নিজস্ব ভবন ছিল না। রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ কলেজের প্রথম ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেন। রাজশাহী কলেজের প্রসিদ্ধির অন্যতম কারণ হলো এর গ্রন্থাগার। যেখানে পুরাতন মূল্যবান ও সাম্প্রতিক সংস্করণের বই, জার্নাল এবং সাময়িকীর প্রাচুর্য রয়েছে। এটি আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত মুদ্রিত তথ্যপ্রাপ্তির নির্ভরযোগ্য উৎস। কলেজ লাইব্রেরিতে অনেক দুর্লভ বই, গেজেট, এনসাইক্লোপিডিয়া এবং পাণ্ডুলিপি রয়েছে।
এই প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ২২ জন অধ্যাপক, ৫৭ সহযোগী অধ্যাপক, ৮০ জন সহকারী অধ্যাপক ও ৮২ জন প্রভাষক সমন্বয়ে শিক্ষা পরিষদ বিদ্যমান।
কোর্সগুলো- স্নাতক (পাস) : বিএ, বিএসএস, বিএসসি, বিবিএস। স্নাতক (সম্মান)- বাংলা, ইংরেজি, আরবি, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, সমাজ কর্ম, অর্থনীতি, মার্কেটিং, ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং, হিসাব বিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, উদ্ভিদ বিজ্ঞান, প্রাণিবিদ্যা, ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, পরিসংখ্যান ও গণিতসহ ২৩টি বিষয়।
মাস্টার্স প্রিলিমিনারি- বাংলা, ইংরেজি, আরবি, ইতিহাস, ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি, দর্শন, ইসলামিক শিক্ষা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, সমাজকর্ম, অর্থনীতি, হিসাব বিজ্ঞান, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং, মার্কেটিং, ব্যবস্থাপনা, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, উদ্ভিদ বিজ্ঞান, প্রাণিবিদ্যা, ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, পরিসংখ্যান ও গণিতসহ ২৩টি বিষয়।
মাস্টার্স ফাইনাল- বাংলা, ইংরেজি, আরবি, ইতিহাস, ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি, দর্শন, ইসলামিক শিক্ষা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, সমাজকর্ম, অর্থনীতি, মার্কেটিং, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং, হিসাব বিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, উদ্ভিদ বিজ্ঞান, প্রাণিবিদ্যা, ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, পরিসংখ্যান ও গণিতসহ ২৩টি বিষয়।
প্রতিষ্ঠাকাল-১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ ওয়েবসাইট : ডডড. ৎপ. বফঁ. নফ। শিক্ষার্থী ২৬ হাজার ৩৭৫ জন। বর্তমানে অধ্যক্ষ প্রফেসর মহা. হবিবুর রহমান। মোট শিক্ষক ২৬১ জন।
কলেজটির শিক্ষার্থী সম্পা ইসলাম বলেন, রাজশাহী কলেজ অনেক উন্নত হয়েছে। কলেজটি কৃতিত্বের সঙ্গে শিক্ষা বিস্তার করে আসছে। কলেজে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন রয়েছে। এছাড়া স্কাউট দলও রয়েছে। বিভন্ন দিবসগুলো পালন করা হয়। কলেজটি সব সময় আনন্দন ময় হয়ে থাকে। সেই লক্ষ্যে কাজ করছে কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মহা. হবিবুর রহমান।
প্রথিতযশা প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা হলেন- রাজশাহী কলেজের (রাক) ছাত্র (১৮৭৮-১৮৮৫) প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় (১৮৬১-১৯৩০), প্রাক্তন ছাত্র (১৮৮৫) কান্তকবি রজনীকান্ত সেন (১৮৬৫-১৯১০), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য রাক’র প্রাক্তন ছাত্র (১৮৮৭-১৮৮৯) প্রখ্যাত ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকার (১৮৭০-১৯৫৮), রাক’র প্রাক্তন ছাত্র (১৮৯০-১৮৯৩) খান বাহাদুর এমাদউদ্দীন আহমদ (১৮৭৫-১৯৩৬), রাক’র ছাত্র (১৯১৪-১৯১৮) ও অধ্যক্ষ (১৯৫১) গণিতবিদ আবদুল করিম মণ্ডল (১৯৬-১৯৫৮), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দাবারু কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১), রাক’র ছাত্র (১৯১৫-১৯১৮) সাহিত্যিক মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ (১৮৯৮-১৯৭৪), রাক’র ছাত্র (১৯১৮-১৯২০) ইতিহাসবিদ সাদত আলি আখন্দ (১৮৯৬-১৯৭১), রাক’র ছাত্র (১৯৩৪-১৯৩৬) সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশী (১৯০১-১৯৮৫), রাক’র ছাত্র (১৯২৪-১৯২৬) ও শিক্ষক (১৯৪১) বিশিষ্ট লেখক ও সাহিত্যিক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন (১৯০৪-১৯৮৭), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজের স্বপ্নদ্রষ্টা ও সাবেক এমএলএ, রাক’র ছাত্র (১৯২২-১৯২৬) মাদার বখশ (১৯০৫-১৯৬৭), রাক’র ছাত্র (১৯৩৪-১৯৩৬) বিশ্ববরেণ্য সরোদশিল্পী পণ্ডিত রাধিকা মোহন মৈত্র (১৯১৭-২০০৭), শিক্ষা বিভাগের খ্যাতিমান কর্মকর্তা আবদুল হক (১৯১৬-১৯৯৮), বাংলাদেশ সংসদের সাবেক স্পিকার ও রাক’র ছাত্র (১৯৩৭-১৯৩৯) মির্জা গোলাম হাফিজ (১৯২০-২০০০), বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি রাক’র ছাত্র (১৯৪২-১৯৪৪) বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী (১৯২৫-১৯৯৮), রাবির সাবেক উপাচার্য বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সাবেক সদস্য ও রাকর ছাত্র (১৯৪৬-১৯৪৮) মুহাম্মদ আব্দুর রবি (১৯২৬-২০১৭), বাংলাদেশ সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ও প্রধান বিচারপতি, রাক’র শিক্ষক (১৯৫৫-১৯৫৬) ও রাক’র ছাত্র (১৯৪৭-১৯৪১৯) মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান (১৯২৮-২০১৪), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ও ফলিত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা বিভাগীয় প্রধান রাক’র শিক্ষক (১৯৫৬-১৯৫৮) ও রাক’র ছাত্র (১৯৪৮-১৯৫০) প্রফেসর ড. এম মকবুলার রহমান সরকার (১৯২৮-১৯৮৫), রাক’র শিক্ষক (১৯৪০-১৯৪১) বরেন্দ্র জাদুঘরের পরিচালক ও রাবির প্রফেসর ড. মুখলেসুর রহমান (১৯২৪-১৯৯৩), বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক ঘটক (১৯২৫-১৯৭৬), রাক’র শিক্ষক (১৯৫৯-১৯৬২) ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ একরামুল হক (১৯২৭-১৯৯৬), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষক শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশা (১৯২৮-১৯৭১), ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ সুলতান (১৯২৮-১৯৮৩), বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ার ভাইস-মার্শাল মুহাম্মদ গোলাম তওয়াব (১৯৩০-১৯৯৯), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও রাক’র প্রাক্তন ছাত্র (১৯৪৬-১৯৫০) বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস (ইঅঝ) ফেলো বিশিষ্ট বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আব্দুল আজিজ খান (১৯৩১-২০১২), বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক, রাবির সাবেক উপাচার্য ও রাক’র প্রাক্তন ছাত্র (১৯৪৬-১৯৫০) বিশিষ্ট সাহিত্যিক প্রফেসর ড. মাযহারুল ইসলাম (১৯২৯-২০০৩), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. এমাজ উদ্দিন আহমেদ (১৯৩৩), বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধান ভাইস-মার্শাল এম খাদেমুল বাসার (১৯৩৫-১৯৭৬), রাক’র ছাত্র (১৯৪৯) ও শিক্ষক (১৯৫৪-১৯৫৮) শিক্ষাবিদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত প্রফেসর কাজী আব্দুল মান্নান (১৯৩০-১৯৯৪), রাবির প্রাক্তন উপাচার্য ও রাক’র ছাত্র (১৯৫৭-১৯৬০) প্রফেসর ড. আবদুল খালেক (১৯৩৭), বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুসন্ধান প্রতিষ্ঠান (ঝচঅজজঝঙ)-এর প্রাক্তন চেয়ারম্যান, রাক’র ছাত্র (১৯৫৫-১৯৫৮), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ডিন প্রফেসর ড. আবু আব্দুল্লাহ প্রমুখ। (কলেজ ম্যাগাজিন)।
কলেজটির অধ্যক্ষ প্রফেসর মহা. হবিবুর রহমান বলেন, হিরণায় ঐতিহ্যের আকর এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার অনন্য প্রতিষ্ঠান রাজশাহী কলেজ। প্রায় সার্ধশত বছরের প্রাচীন এই কলেজটি কালান্তরে শিক্ষার্থীদের মেধা, মনন ও জীবন বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। বাঙালির জাতিসত্তা বিকাশের ঐতিহাসিক সব সন্ধিক্ষণে সক্রিয় থেকে রাজশাহী কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীবৃন্দ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।