রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে প্রতিদিন হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হচ্ছে কোটি কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহীর গোদাগাড়ী, পবা, চারঘাট এবং বাঘা সীমান্ত এলাকা এবং পাশবর্তি জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ ও ভোলাহাট সীমান্ত এলাকা চরাচালানের অন্যদম রুট হিসেবে পরিচিত। তবে সবচেয়ে বেশি পরিচিত এসব সীমান্ত এলাকার মধ্যে রাজশাহীর পবা এবং গোদাগাড়ী আর চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর, শিবগঞ্জ এবং ভোলাহাট সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রবেশ করে ভারতীয় গরু-মহিষ, ফেনসিডিল, হেরোইনসহ অবৈধ শাড়ি-কাপড়। আর এসব অবৈধ গরু-মহিষসহ মাদকদ্রব্য ও বিভিন্ন মালামাল আনতে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা ভারতী পাচারকারীদের হাতে তুলে দিতে হয়। কিন্তু সব টাকায় চলে যাচ্ছে কয়েকটি হুন্ডি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। এর ফলে সরকার যেমন হারাচ্ছে রাজস্ব, তেমনি সীমান্ত এলাকায় অপরাধ প্রবনতা কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না।

এর বাইরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দর হয়ে আসা ঘোষণাপত্রের বাইরে অতিরিক্ত মালামাল অবৈধভাবে আমদানির জন্য যে টাকা লেনদেন হয়, সেটিও পাচার হয়ে থাকে হুন্ডির মাধ্যমে। ফলে রাজশাহী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে প্রতিদিন অন্তত ৮ কোটি টাকা চলে যাচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে। বিনিময়ে ওপার থেকে আনা হচ্ছে অবৈধ মালামাল।

জানতে চাইলে রাজশাহী রেঞ্জের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এম খুরশিদ আলম বলেন, ‘হুুন্ডি ব্যবসায়ীদের কোনো তথ্য-প্রমাণ থাকলে পুলিশ অবশ্যই ব্যবস্থা নিবে। ওই এলাকার পুলিশ সুপারদের নির্দেশ দিয়ে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা এবং সরেজমিন অনুসন্ধান করে জানা গেছে, এই অঞ্চল থেকে হুন্ডির মাধ্যমে যেসব টাকা ভারতে পাচার করা হয়, তার সিংহভাগই চলে যাচ্ছে ঢাকা এবং চট্টগ্রামের ডিলারদের মাধ্যমে। রাজশাহী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের হুন্ডি ব্যবসায়ীরা এজেন্টরা অবৈধ টাকা সংগ্রহ করে ব্যাংকের মাধ্যমে টিটি (টাকা ট্রান্সফার) করে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ডিলারদের কাছে পাঠান। এরপর সেখান থেকে নানা কৌশলে টাকা চলে যাচ্ছে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের হাতে। এভাবেই হুন্ডির টাকা লেনদেন করছেন রাজশাহীর কালোবাজারিরা। আর অবৈধভাবে টাকা সংগ্রহ করে সেগুলো ভারতীয় ব্যবসায়ীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য মাঝখানে কমিশন খাচ্ছেন হুন্ডি ব্যবসায়ীরা। এই রকম বেশ কয়েকজন হুন্ডি ব্যবসায়ীর ব্যাংক একাউন্ট থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা লেনদেনের তথ্য পেয়েছেন একটি গোয়েন্দা সংস্থা। যাদের কেউ কেউ মাসে এক-তিন কোটি টাকা পর্যন্তও লেনদেন করেছেন স্থানীয় ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে।

 

স্থানীয় ব্যাংকগুলোর ম্যানেজারকে ম্যানেজ করেই এই অবৈধ টাকা লেনদেন হচ্ছে বলেও তথ্য পেয়েছে ওই গোয়েন্দা সংস্থাটি। তবে উচ্চ পর্যায় থেকে এ নিয়ে গ্রিণ সিগন্যাল না আসায় হুন্ডি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযানে মাঠে নামতে পারছেন না কোনো আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। ফলে প্রতিদিন রাজশাহী অঞ্চল থেকে অবাধে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে। যা থামানোর কোনো উদ্যোগ এখ নপর্যন্ত গ্রহণ করা হয়নি। এর ফলে রাজশাহী অঞ্চলের সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় গরু-মহিষসহ ফেনসিডিল, হেরোইন, অস্ত্র এবং অবৈধ পণ্য পাচার করে আনা অব্যাহত রয়েছে যুগ যুগ ধরেই। এতে করে এই সীমান্ত এলাকাগুলোতে বছরজুড়েই নানা ধরনের অপরাধ প্রবনতা লেগেই থাকে। কখনো কখনো সীমান্ত এলাকার দখল নিয়ে চলে বোমাবাজি, খুনোখুনি বা বিএসএফ-এর হাতে খুনের ঘটনা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা দিয়ে মাসে অন্তত ৩০ কোটি টাকার হেরোইন পাচার করে আনা হয় ভারত থেকে। এর বাইরে এ সীমান্ত এলাকা দিয়ে আসে গরু-মহিষসহ বিভিন্ন ধরনের অবৈধ পণ্য। এসব আনতেও মাসে কয়েক কোটি টাকা লেনদেন হয় ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। অন্যদিকে পবা সীমান্ত এলাকা দিয়ে ঢুকে মাসে অন্তত ২০ কোটি টাকার ফেনসিডিলসহ ভারতীয় নানা ধরনের পণ্য। এই টাকার সবগুলো চলে যায় হুন্ডির মাধ্যমে। গোদাগাড়ী জমির আলী ও মোশারফ হোসেন ও রাজশাহী নগরীর এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ীসহ জেলার অন্তত ২০ জন হুন্ডি ব্যবসায়ীর মাধ্যমে মাসে অন্তত ৫০ কোটি টাকা যাচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে।

সম্প্রতি জমির এবং মোশাররফকে পুলিশ আটকও করেছিল। তবে বিপুল অংকের টাকা নিয়ে গোদাগাড়ী থানা পুলিশ দুজনকেই ৩৪ ধারায় আটক দেখিয়ে আদালতে পাঠায়। পরের দিন তারা আদালত থেকে ছাড়া পান।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজশাহী অঞ্চলের সবচেয়ে বড় হুন্ডি ব্যবসায়ী হলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর এলাকার গোলাম নবী ওরফে জেন্টু মিঞা। তার মাধ্যমে দিনে অন্তত দুই কোটি টাকা হুন্ডি মাধ্যমে পাচার হয় ভারতে।
তবে জেন্টু মিঞা এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তিনি ভারথীয় গরুর বিট-খাটালের সঙ্গে যুক্ত বলে কিছু টাকা লেনদেন হয় তার মাধ্যমে। এর বাইরে কোনো অবৈধ টাকা তিনি হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করেন না বলেও দাবি করেন।

চাঁপাইনাববগঞ্জের বড় হুন্ডি ব্যবায়ীদের মধ্যে আরো যাদের নাম উঠে এসেছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন সদর এলাকার আব্দুল খালেক, চরবাগডাঙ্গা এলাকার আমিনুল ও তার ভাই আনারুল, ভোলাহাটের আহমেদ শাহ নজমুল ওরফে ইয়ারুল, সাবেক ইউপি সদস্য সেলিম রেজা এবং স্থানীয় কামরুজ্জামানের নাম। এদের মাধ্যমে দিনে কয়েক কোটি টাকা পাচার হচ্ছে ভারতে।

 

তবে আহমেদ শাহ নজমুল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘একটি ব্যাংকের মাধ্যমে আমার কয়েক কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে এটা ঠিক। তবে ওই টাকা আমি আমের ব্যবসার জন্য লেনদেন করেছি। কোনো হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে আমি জড়িত নয়।’ অন্যদিকে অন্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চেষ্টা করেও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

কয়েকটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাঠপর্যায়ের গোয়েন্দা শাখার একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচারকারী রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের কয়েকজন ব্যবসায়ীর ব্যাংক একাউন্ট থেকে সন্দেহজনক বিপুল অংকের টাকা লেনদেনের কথা জানা গেছে। এতেই প্রমাণ করে এসব লোক হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু উচ্চ পর্যায় থেকে এ নিয়ে কোনো নির্দেশনা না আসায় কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।’

ওই কর্মকর্তারা আরও বলেন, হুন্ডি ব্যবসায়ীরা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে টাকা সংগ্রহ করে কমিশন আদায় করে সেগুলো ব্যাংকের মাধ্যমে টিটি করে বা কখনো কখনো গাড়ী যাত্রীদের মাধ্যমে নগদ পাঠিয়ে দেয় ঢাকা এবং চট্টগ্রামের হুন্ডি ডিলারদের কাছে। ওই ডিলালরারা এই অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের কথামতো পাঠিয়ে দেন ভারতের ব্যবসায়ীদের কাছে। হুন্ডির একটি বড় অংকের টাকা পৌঁছে যায় ভারতের কলকাতার বড় বাজার এলাকায়। যেখানে বসে ভারতীয় হুুন্ডি ব্যবসায়ীদের আসর। আর এভাবেই রাজশাহী অঞ্চল থেকে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে।

স/আর