রাজশাহী অঞ্চলে নানা পেশার আড়ালে ছড়িয়ে পড়ছে জঙ্গিবাদ

নিজস্ব প্রতিবেদক:
জঙ্গিরা কোথাও স্থায়ী হতে পারছে না। তাই তারা বিভিন্ন পেশার মাধ্যমে জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। আবার প্রত্যন্ত অঞ্চলের হতদরিদ্র বিভিন্ন পেশার এবং শিক্ষার্থীদেরও জঙ্গিবাদে জড়াতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। তবে কারা অন্তরালে থেকে এ কাজ করছে-এটি এখনো বুঝে উঠতে পারছে না আইনশৃঙ্খরা বাহিনী। বিশেষ করে রাজশাহী অঞ্চলে সাম্প্রতিক সময়ে প্রত্যন্ত এলাকায় যেভাবে জঙ্গিবাদের বিস্তার লাভ করেছে-তা অনেকটাই ভাবিয়ে তুলেছে আইনশ্খৃলা বাহিনীকে।

এই অঞ্চল থেকে নিখোঁজ হওয়া অন্তত অর্ধশতাধিক যুবক ও ব্যক্তির সন্ধানেও চালানো হচ্ছে বিভিন্ন স্থানে অভিযান। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য পাইনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আর এসব নিয়ে চরম অশ্বস্তিতে আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

জানতে চাইলে রাজশাহী রেঞ্জ ডিআইজ খুরশিদ হোসেন গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় বলেন, ‘এ অঞ্চলে কারা জঙ্গিবাদের ঘাটি গড়ে তুলছে, তা আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করছি। আমরা বিভিন্ন তথ্যের উপর ভিত্তি করে অভিযান অব্যাহত রেখেছি। সে ক্ষেত্রে জঙ্গিরা ধরাও পড়ছে। বা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, ‘নিখোঁজদের কারো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। আবার নতুন করে কেউ কেউ নিখোঁজ হচ্ছে। ফলে রাজশাহী অঞ্চলে ঠিক কতজন এই মুহূর্তে পলাতক আছে-তা বলা যাচ্ছে না। তবে তাদের বিষয়ে আমরা কড়া নজর রাখছি। খোঁজ-খবরও নিচ্ছি।’

পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে এ অঞ্চলে অনেকটা কোণঠাসাও হয়ে পড়েছে জঙ্গিরা। এর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে জঙ্গি আস্তানায় তিন জঙ্গি নিহত হওয়া, গোদাগাড়ীতে আত্মঘাতি বোমা হামলায় ৫ জঙ্গি নিহত হওয়া এবং নাচোলে অভিযান চালিয়ে ৪ জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের পর এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

 

  • নাচোলে এবং শিবগঞ্জে আটক হওয়া মোট সাত জঙ্গির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী চাঁপাইনবাবগঞ্জ পুলিশ অভিযান এখনো অব্যাহত রেখেছে। অপরদিকে গোদাগাড়ীর বেনিপুরে অপারেশন সান ডেভিলে আটক হওয়া নারী জঙ্গি সুমাইয়াকে নিয়ে অভিযান অব্যাহত রেখেছে গোদাগাড়ী থানা পুলিশ। গতকাল শনিবার পর্যন্ত জেলার কয়েকটি স্থানে অভিযান চালানো হয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার টিএম মোজাহিদুল ইসলাম সিল্কসিটিনিউজকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্দেশ পাওয়ার পরে আমরা চাঁপাইনবাবগঞ্জে জঙ্গি ও মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানে নামি। গত ১০ মে থেকে এই অভিযান শুরু হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে আমরা অন্তত ২২টি বাড়িতে সাঁড়াশি অভিযান করি। তবে ১৭-১৮টি বাড়িতেই আমরা বিফল হয়। কিন্তু বড় সাফল্য পাই ৪-৫টি বাড়িতে। এর মধ্যে নাচোল একযোগে গ্রেপ্তার করা হয় ৪জঙ্গিকে। তাদের দেওয়া স্বীকারোক্তি মোতাবেক আমরা আরো বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায়। এর মধ্যে নব্য জেএমবির সাত সদস্যক আমরা গ্রেপ্তারও করি।’

পুলিশ সুপার বলেন, গ্রেপ্তারকৃত জঙ্গিদের মধ্যে মাত্র একজন একটি কলেজের শিক্ষার্থী। বাকিরা সবাই বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। তবে তারা সকলেই একেবারে নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আসা। তাদেরকে নানাভাবে মোটিভেট করে জঙ্গিবাদে জড়ানো হয়েছে। আর এরা কেউই এক স্থানে স্থায়ী থাকে না। সবাই বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার আড়ালে একেক স্থানে ঘুরে বেড়ায়। এতে করে তাদের স্থান প্রায় সময় বদল করা হয়। আবার কোনো রকমে শিক্ষিত হলেও ইন্টারনেট নির্ভরতাকে কাজে লাগিয়ে জঙ্গি কার্যক্রম চালিয়ে থাকে। এদের অধিকাংশই হোটাসঅ্যাপ ব্যবাহর করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে।’

  • পুলিশ সুপার আরো জানান, গত ১০ মে থেকে সাঁড়াশি অভিযানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার হওয়া ৭ নব জেএমবি সদস্যদের মধ্যে নাচোল উপজেলার গুঠইল গ্রামের তাইফুর রহমানের ছেলে হারুন অর রশিদ (২৫) একই গ্রামের মোস্তাফার ছেলে কামাল উদ্দীন ওরফে সরকারকে (৩২) সিট কাপড়ের ব্যবসায়ী। তারা দুজনেই সিট কাপড়ের ফেরি করে ব্যবসা করে সংসার চালায়। পাশাপাশি জঙ্গিবাদেও জড়িয়ে পড়ে।

এছাড়াও শিবগঞ্জের রাঘবপুর আজিজুল হক (৩৮) ও শিবনগর এলাকার এসলামের ছেলে বাবু অটোরিকশা চালক। একই উপজেলার নাসিম রেজা একটি মসজিদের ইমাম। অন্য দুজনের মধ্যে নাচোল উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামের কেতাবুল ইসলামের ছেলে দিনমজুর ফিরোজ (২২) এবং একটি কলেজের শিক্ষার্থী এবং শিবগঞ্জের দেবিনগর এলাকার বুদুর ছেলে আব্দুল হাকিম (২০)।  এসব জঙ্গিরা একেক সময় একেক স্থানে অবস্থান নিয়ে জঙ্গিবাদ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছিল। তারা বিভিন্ন পেশার আড়ালেই এ অপকর্ম করে চলেছিল। যাতে করে সহজে কেউ টের না পায়।

  • পুলিশ সুপার টিএম মোজাহিদুল ইসলাম বলেন, জঙ্গিদের মধ্যে যারা একেবারে লেখা-পড়া জানেন না, তারা হলেন বিস্ফোরক ও অস্ত্র মুজদাকারী। আর অন্যরা হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে জঙ্গিবাদের সঙ্গে স্মপৃক্ত। এরা সংগঠনের বিস্তার লাভেও কাজ করে। তবে তাঁদের আর চাঁপাইনবাবগঞ্জে ঠাঁই হবে না। প্রত্যেককে খুঁজে খুঁজে বের করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর জন্য অভিযান এখনো অব্যাহত রয়েছে। এটি চলতেই থাকবে। যতদিন না জঙ্গিবাদমুক্ত করা যাবে চাাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে। পাশাপাশি মাদক ব্যবসায়ীদেরও এখন থেকে শক্ত হাতে দমন করা হবে। এদেরও আর উত্থান হতে দেওয়া হবে না। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছাড়া করা হবে তাদের।’

এদিকে রাজশাহীর গোদাগাড়ী থানার ওসি হিফজুর আলম মুন্সি জানান, মাদকের স্বর্গরাজ্য বলে পরিচিত রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে গত ৫ মে থেকে মাদক ব্যবসায়ী ও জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সাড়াশি অভিযানে নামে পুলিশ। এরপর থেকে মাদক স¤্রাট সোহেলসহ বেশ কয়েকজন আটক করে পুলিশ। তবে সবচেয়ে বড় সাফল্য আসে গত ১০ মে রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পুলিশের দেওয়া তথ্য মতে গোদাগাড়ীর বেনিপুরে অভিযান চালিয়ে। অপারেশন সান ডেভিল নামের ওই অভিযানে একটি বাড়ি ঘিরে রাখে পুলিশ। পরের দিন সকালে আত্মঘাতি বোমা হামলায় ৫ জঙ্গি নিহত হয়। এসময় একজন ফায়ারকর্মীও জঙ্গিদের হামলায় নিহত হন। তবে ওই অভিযানে আত্মসমর্পণকারী জঙ্গি সাজ্জাদ আলীর মেয়ে এবং জেএমবি সদস্য জোহরুলুরে স্ত্রী সুমাইয়ার নিতট থেকে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে পুলিশ। তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ ওইদিন থেকেই গোদাগাড়ীসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযানও অব্যাহত রেখেছে।
ওসি হিফজুর আলম মুন্সি বলেন, ‘জঙ্গিরা সাধারণত অতি দরিদ্র ঘরের সন্তান। এদের টার্গেট করেই এ পথে নামানো হচ্ছে। তবে কারা এর পেছনে কাজ করছে, সেটি আমরা এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি। এর জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আত্মসমর্পণকারী সুমাইয়া পুলিশকে অনেক তথ্য দিয়েছে। সেগুলোর ওপর ভিত্তি করেও অভিযান চালানো হচ্ছে।’

  • এদিকে পুলিশের আরেক সূত্র জানিয়েছে, রাজশাহী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ মিলে এখনো অর্ধশতাধিক ব্যক্তি ও যুবক নিখোঁজ হয়ে আছে। ধারণা করা হচ্ছে, এরা সকলেই জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। আড়ালে থেকে এরাই জঙ্গিবাদের মদম দিচ্ছে কিনা, সেটিও খুঁজে দেখছে পুলিশ। তবে নিখোঁজ ওই জঙ্গিদের বিষয়ে এখনো তেমন কোনো তথ্য না পাওয়ায় অনেকটাই ভাবিয়ে তুলেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।

তাদের ধরতে যদিও বিভিন্ন স্থানে অভিযান অব্যাহতও রেখেছে পুলিশ। তবে এখনো ওই জঙ্গিদের নিয়ে বড় কোনো সাফল্য আসেনি বলেও স্বীকার করেছেন রাজশাহী অঞ্চলের একজন পুলিশ কর্মকর্তা।
তারপরেও সম্প্রতি শিবগঞ্জের জঙ্গি আস্তানায় তিন জঙ্গি নিহত হওয়া এবং গোদাগাড়ীতে একসঙ্গে ৫ জঙ্গি নিহত হওয়ার ঘটনায় এ অঞ্চলের জঙ্গিদের মনোবল অনেকটা ভেঙে গেছে বলেও দাবি করেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা।

প্রসঙ্গত: গত ১০ মে রাতে গোদাগাড়ীর বেনিপুরে একটি জঙ্গি আস্তানায় অপারেশন সান ডেভিল অভিযানের সময় আত্মঘাতি বোমা হামলায় নিহত সাজ্জাদ ও তার ছেলে আল আমিনও ছিলে ফেরি করে সিট কাপড়ের ব্যবসায়ী। আরেক জঙ্গি আইটি বিশেষজ্ঞ আশরাফুল ইসলাম ছিলেন প্রকৌশলী। এর আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের জঙ্গি আস্তানায় নিহত তিনজনের মধ্যে রফিকুল ইসলাম আবু ছিলেন মশলা ব্যবসায়ী।

স/আর