রাজশাহীর সীমান্তে থামছে না মৃত্যু

নিজস্ব প্রতিবেদক:

বিজিবি-বিএসএফ বার বার পতাকা বৈঠকের পরও রাজশাহী অঞ্চলের সীমান্ত এলাকায় এখনো মৃত্যু থামছে না। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী-বিএসএফের গুলিতে মাঝে মধ্যেই প্রাণ হারাচ্ছে বাংলাদেশি নাগরিক। যাদের অধিকাংশই গবাদিপশু আনতে যাওয়া রাখাল।

ভুক্তভোগীসহ সংশ্লিষ্ট সকলেই স্বীকার করছেন, এই মৃত্যু রোধে প্রথমেই দরকার সীমান্তপথে রাখালদের অনুপ্রবেশ কঠোরভাবে বন্ধ করা। কিন্তু চোরাপথে আসা ভারতীয় গবাদিপশু থেকে রাজস্ব আদায়ের জন্য ‘সীমান্ত খাটাল’ খুলে রাখার ফলে সেটাও কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না।

সর্বশেষ চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মাসুদপুর সীমান্তে সোমবার গভীর রাতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে দুই বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা ইউনিয়নের তারাপুর ঠুটাপাড়া গ্রামের আফসার হোসেনের ছেলে সেনারুল ইসলাম (২৪) ও একই ইউনিয়নের মন্ডলপাড়া গ্রামের কালু মোহাম্মদের ছেলে মো. মিলন (২২)।

সীমান্তে বসবাসকারীদের দাবি, সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশিদের প্রাণহানি ঠেকাতে আগে সীমান্ত খাটাল স্থায়ীভাবে বন্ধ করা দরকার। তবেই হত্যা বন্ধ হবে। গরু পাচার রোধ হলেই সীমান্তে হত্যা বন্ধ হবে।
সীমান্তে প্রাণহানি সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক মানবাধিককর্মী অ্যাডভোকেট আশফাকুর রহমান বলেন, সীমান্তে ঘটা অধিকাংশ প্রাণহানির ঘটনা গরু পাচারকেন্দ্রিক। সীমান্তে গবাদিপশুর খাটাল বন্ধ করে এসব হত্যাকা- অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। খাটালের কারণে মাদক পাচারও বাড়ছে বলে জানান তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সর্বশেষ গত ১৯ মার্চ রাতে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর ভুবনপাড়া সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হন আব্দুস সালামের ছেলে আল্লাম হোসেন (৩৫)। ওই রাতে আল্লাম কয়েকজন সহযোগী নিয়ে সীমান্তের কাঁটাতারের কাছে গরু আনতে গেলে বিএসএফ গুলি করে। এতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায়। গত ১৯ জানুয়ারি রাতে একই সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে মারা যায় গোলাম মোস্তফার ছেলে জামাল উদ্দিন (৩৬)। গত ৩ মার্চ রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের জোহরপুর সীমান্ত দিয়ে গরু আনতে গেলে বিএসএফের গুলিতে মারা যায় চর পশ্চিম পাঁকা বিশরশিয়া গ্রামের সরদারপাড়ার ফড়িং বিশ্বাসের ছেলে টিপু বিশ্বাস (২৭)। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে জোহরপুর সীমান্ত পথে গরু আনতে গিয়ে বিএসএফের গুলিতে গুরুতর আহত হয় চর পশ্চিম পাঁকা খিটকারিপাড়া গ্রামের মোজাম্মেল হক মোজামের ছেলে রুহুল হক (২৬)। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রুহুল মারা যান।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হত কয়ে বছরে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ সীমান্তে বছরে বিএসএফের গুলিতে শতাধিক বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে। প্রতি বছর আহত হচ্ছে অনেকেই। সীমান্তে চলমান এই হত্যাকা- বন্ধে সীমান্তের সাধারণ মানুষ গত কয়েক বছর ধরে সীমান্ত খাটাল বন্ধের দাবি জানিয়ে আসলেও তা বন্ধ করা হচ্ছে না অজ্ঞাত কারণে। বরং বছর বছর এসব সীমান্তে খাটালের সংখ্যা আরও বেড়ে চলেছে। এর ফলে সীমান্তে হত্যাকা-ও বেড়ে চলেছে।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, রাজশাহীর পদ্মার চর, সোনাইকান্দি, খরচাকা, প্রেমতলী, সাহেবনগর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফরিদপুর, বাগডাঙ্গা, হাকিমপুর, বাখের আলী, জোহরপুর ট্যাক, জোহরপুর, ওয়াহেদপুর, ফতেপুর, মাসুদপুরসহ ১২টি সীমান্ত পয়েন্টে খাটাল রয়েছে। এছাড়াও নওগাঁর বিভিন্ন সীমান্তে রয়েছে বেশকিছু খাটাল। এরমধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের জোহরপুর ট্যাক ও জোহরপুর সীমান্ত পয়েন্টে বিএসএফের গুলিতে হতাহতের সংখ্যা সর্বাধিক।

একাধিক ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যেসব ব্যক্তি সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের স্বজনরাও নিদারুন সঙ্কটের মধ্যে জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। সরকার বা কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে তাদেরকে কোনো ক্ষতিপূরণও দেওয়া হয় না। এমনকি হতাহতের ঘটনাগুলির কোনো সুষ্ঠু তদন্তও হয় না। ফলে ধারাবাহিকভাবে সীমান্তে হত্যাকা- ঘটেই চলেছে।

তবে এ বিষয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ বিজিবির ব্যাটালিয়ান কমান্ডোর ও রাজশাহী বিজিবির সেক্টর কমান্ডোরের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। সীমান্তে হত্যাকারি একমাত্র কারণ খাটাল ব্যবস্থার কথা স্বীকার করে রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার ও আঞ্চলিক টাস্কফোর্সের সভাপতি (অতিরিক্ত সচিব) নুর উর রহমান বলেন, রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন সীমান্তে খাটালের সংখ্যা না বাড়িয়ে বরং কমিয়ে আনার জন্য বিজিবিকে বলা হয়েছে। সীমান্তে নিরীহ কোনো বাংলাদেশির প্রাণহানি আমাদের কারোরই কাম্য নয়।