রাজশাহীর শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্র: শিশুদের খাবার চিকিৎসার টাকাও হচ্ছে লুট

নিজস্ব প্রতিবেদক:

ঘটনা ১: চার মেয়েকে নিয়ে অভাব-অনটনের সংসার তানজিলার খাতুনের। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সেই মেয়ের স্বামী মারা যাওয়ায় মেয়েটিও এখন বাড়িতে চলে এসেছে। পরের বাড়িতে কাজ করে কোনো মতে মেয়েদের মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দিতে পারেন তানজিলা। কখনো ভাত জোটে আবার কখনো জোটেও না। এই অবস্থায় ছোট মেয়ে রুমি খাতুনকে পড়া-লেখার জন্য রাজশাহী নগরীর উপশহরে অবস্থিত শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে রেখেছিলেন বছর খানেক আগে। তবে মাস সাতেক যেতেই রুমি পেটের ব্যাথায় ভূগতে থাকেন। এরপর সেই শিশুর কোনো চিকিৎসা না করেই তার মা তানজিলাকে খবর দেওয়া হয় মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

মা তানজিলা জানান, গত বছরের অক্টোবর মাসে এসে রুমিকে নিয়ে যান বাড়িতে। তাঁর বাড়ি রাজশাহীর পবা উপজেলার প্রশাদপাড়া গ্রামে। এরপর থেকে শিশুটি এখনো অসুখে ভূগছেন। কিন্তু তাকে চিকিৎসা করানোর মতো সামর্থ নাই মা তানজিলার। এই অবস্থায় চরম বেকায়দায় পড়েছেন তিনি। বাড়িতে যাওয়ার পর থেকে শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের হাজিরা খাতায় এখনো অনুপস্থিত বলে উল্লেখ করা হয় রুমিকে। অথচ রুমির বাড়িতে গিয়ে এই কেন্দ্রের লোকজন জানিয়ে আসেন আর তাকে ভর্তি নেওয়া হবে না। সেই থেকে এই কেন্দ্রের হাজিরা খাতায় রুমি অনুপস্থিত শিশুদের তালিকার মধ্যে একজন।
ঘটনা ২: জাকিরুল্লাহ ও হাবিবুল্লাহ। তার মায়ের নাম সুমি বেগম। বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের রামজীবনপুর কাচারিপাড়া এলাকায়। এই এলাকার হারুনার রশিদের ছেলে জাকিরুল্লাহ ও হাবিবুল্লাহকে মূলত পড়া-লেখার জন্য রেখে যাওয়া হয়েছিল শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে। কিন্তু এই দুই শিশুর পোশাক কেনার জন্য গত বছর দুই হাজার টাকা দাবি করা হয় পরিবার থেকে। শেষে ১৭শ টাকা দিয়ে পোশাক নিজেরাই কিনে দেন হাবিবুল্লাহ ও জাকিরুল্লাহর পরিবার।

তাদের মা সুমি বেগম বলেন, ‘টাকা দেওয়ার পরে আমার দুই শিশুর সঙ্গে এবং এমনকি আমাদের সঙ্গেও নানাভাবে অসাদচরণ করা হতো শেখ রাসেল শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে। বাধ্য হয়ে শিশু দুটিকে বাড়িতেই নিয়ে চলে আসছি। বড় ছেলে হাবিবুল্লাহ এখন আর সেখানে যেতেই চাই না তাদের খারাপ আচারণের কারণে।’

প্রসঙ্গত, শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের খাতায় এই দুই শিশুও অনুপস্থিত বলে উল্লেখ করা হয়। তাদের মতো নানা অব্যবস্থানার শিকার হয়ে সবমিলিয়ে ৩৩ জন শিশু গত ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত অনুপস্থিত ছিলো। অথচ এখানে মোট শিশুর নিবন্ধিত সংখ্যা হলো ১৮৪ জন। গত ২০১২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এখানে মোট ১ এক হাজার ১৬৯ জন নিবন্ধন করেছে। এর মধ্যে বের হয়ে গেছে ৯৯১ জন। যাদের বেশিরভাগরই এখনো কোনো কর্মসংস্থান জোটেনি বা সুরক্ষা পাইনি। অথচ এই কয়েক বছরে প্রতিষ্ঠানটি চালাতে সবমিলিয়ে ব্যয় হয়েছে অন্তত আট কোটি টাকা।

অভিযোগ উঠেছে, রাজশাহীর শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে শিশুদের থাকা, খাওয়া, পড়া-লেখা থেকে শুরু করে সার্বিক সুবিধার জন্য প্রতি তিন মাস অন্তর প্রায় ৩৬ লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয় সরকার থেকে। এই বরাদ্দের অধিকাংশ টাকায় হয় লুটপাট। এতে করে শিশুদের সঠিক পরিচর্যা যেমন হয় না, তেমিন শিশুদের খাবারের মাণও তেমন ভালো দেওয়া হয় না। এমনকি পোশাক কিনতেও অভিভাবকদের নিকট থেকে নগদ টাকা বা পোশাক নেওয়া হয়। ফলে চরম অব্যবস্থাপনা আর অনিয়মের গ্যাঁড়াকলে আটকে পড়া এই প্রতিষ্ঠানটির শিশুরা চরমভাবে অবহেলিত। ফলে এরা অনেকটাই মানবেতর জীবন-যাপন করছে। তিনবেলা যে খাবার দেওয়া হয় সে খাবারের মাণ যেমন নিম্নমাণের, তেমনি অনেকের পোশাকটিও ঠিকমতো দেওয়া হয় না। আবার কারণে-অকারণে এখানকার শিশুদের মারপিট করে রক্তাক্ত জখম করার ঘটনাও ঘটে অহরহ। গত কয়েকদিন আগেও এক শিশুকে পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছি। তার অপরাধ ছিল রাত নয়টার মধ্যে ঘুমিয়ে না পড়া।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এখানে সবমিলিয়ে ২৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন কাগজে-কলমে। কিন্তু পোস্ট ফাঁকা রয়েছে ১০টি। বাকি যে ১৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী এখানে দায়িত্বে রয়েছেন তাঁরাও ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেন না। আবার কেন্দ্রটির উপ-প্রকল্প পরিচালক নুরুল আলম প্রধান হলেন সবচেয়ে দুর্নীতিবাজ একজন কর্মকর্তা। তাঁর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এখানে শিশুদের খাবার থেকে শুরু করে সার্বিক ব্যবস্থাপনায় চরম অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। ফলে সরকারের নেওয়া অবহেলিত ও ঝূঁকির মধ্যে থাকা শিশুদের সুরক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পুনর্বাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগটি চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে।
গত ১২ জানুয়ারি এই কেন্দ্রে সরেজমিন অনুসন্ধানে গিয়ে দেখা যায়, নগরীর উপশহরের দুই নম্বর সেক্টরে অবস্থিত শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রটিতে উপস্থিত বালক শিশু ছিলেন মাত্র ৪৩ জন। অথচ কেন্দ্রটির খাতায় সেদিন উপস্থিত শিশুর সংখ্যা ছিল ৭০ জন। কেন্দ্রে এই প্রতিবেদক যাওয়ার পরপরই হাজিরা খাতায় ৭২ জন দেখানো হলেও পরে ফ্লুইড দিয়ে মুছে সেটিকে ৭০ জনে করা হয়।

অন্যদিকে বালিকা শিশুদের ফ্লাটে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে মেয়ে শিশুর সংখ্যা ছিলো ৮৩ জন। তবে সেদিন উপস্থিত ছিল ৮৬ জন। কিন্তু তার পরেও অন্যরা কোথায় জানতে চাইলে কেন্দ্রের দায়িত্বরত জবপ্লেসমেন্ট অফিসার এবিএম তৌহিদুর রহমান জানান, কেউ স্কুলে কেউ খেলতে গেছে। কতজন খেলতে, আর কতজন স্কুলে গেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি বলতে পারব না। ওরা নিজেদের ইচ্ছেমতো যায় আবার নিজেরাই চলে আসে। বিকেল হলেই সবাই উপস্থিত হবে। তবে দুপুর পৌনে একটা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত কেন্দ্রে অপেক্ষা করেও অন্য বালক শিশুদের আর খোঁজ মেলেনি।

কেন্দ্রের দায়ত্বরত কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানায়, এখানে কোনো শিশুদের কোনো নিরাপত্তা নাই। যে যার মতো বাইরে যাই, আবার চলে আসে। ফলে প্রতিতিদন কতজন শিশু এখানে আছে বা বাড়িতে গেছে অথবা ছুটিতে তার সঠিক তথ্য এখানে থাকে না। কিন্তু হাজিরা খাতায় ইচ্ছেমতো উপস্থিত দেখিয়ে শিশুদের খাবারের টাকা আত্মসাত করা হয়। আবার ঠিকমতো চিকিৎসাসেবাও দেওয়া হয় না। এমনকি শিশুদের বছর মানসম্মত কোনো স্কুলেও ভর্তি করা হয় না। যেসব শিশুদের অভিভাবকরা একটু সচেতন কেবল তাদেরকেই স্কুলে ভর্তি করা হয়। আবার শিশুদের ঠিকমতো প্রশিক্ষণও দেওয়া হয় না। অথচ এখানে ২৯ ধরনের প্রশিক্ষণের কথা উল্লেখ রয়েছে। সেইসব প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য এখানে কর্মকর্তাও রয়েছেন। এদের বেতন-ভাতা বাবদ সরকার প্রতি তিন মাসে প্রায় ১১ লাখ টাকা ব্যয় করছেন। কিন্তু অধিকাংশ টাকায় যাচ্ছে জলে।

সূত্র মতে, গত ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত বর্তমান এই কেন্দ্রের নিবন্ধনকৃত শিশুদের সংখ্যা ছিলো ১৮৪ জন। এর মধ্যে মেয়ে শিশু ছুটিতে ছিল ১৭ জন আর ছেলে শিশু ছুটিতে ছি১৬ জন। তবে এই তথ্যেও নানা গড়মিল পাওয়া যায়। পরে ফ্লইড দিয়ে সেটি সংশোধন করা হয়। ছুটিতে থাকা শিশুদের মধ্যে অধিকাংশ দুই-তিন মাস ধরে আর কেন্দ্রে আসেনি। এদের সকলকেই কেন্দ্রে নানাভাবে অবহেলার শিকার, নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। যে কারণে তারা ছুটি নিয়ে আর ফিরে আসেনি। এরপর থেকে কেন্দ্রের খাতায় তারা অনুপস্থিত রয়েছে। আবার যারা মাঝে মাঝে ছুটিতে বাড়ি যায় আসে, তাদেরকেও ইচ্ছেমতো উপস্থিত দেখিয়ে শিশুদের খাবারের অর্থ লুটপাট করা হয়। খাবারের মাণও দেওয়া হচ্ছে নিম্নমাণের।

সূত্র মতে, ২০১২ সালে একটি বিদেশে প্রকল্পের আওতায় সার্ভিসেস ফর চিলড্রেন এট রিস্ক নামে শিশুদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রটি চালু করা হয় রাজশাহীতে। ২০০ আসনের বিপরীতে এখানে শিশু ভর্তি করা হয়। পরবর্তিতে প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে গেলে ২০১৬ সালের জুন থেকে সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতায় চলে যায় প্রকল্পটি। সেই থেকে সরকারের অর্থায়নে চলছে এই প্রকল্পটি। এখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকার থেকে বেতন পেলেও এখনো তাদের চূড়ান্ত নিয়োগ হয়ে রাজস্ব খাতে বেতন-ভাতাদি যায়নি। কিন্তু তাতে কি এখানে শিশুদের নামে লুটপাট আর অনিয়মে উপ-প্রকল্প পরিচালক নুরুল আলম প্রধান হয়েছে বিত্তবৈভবের মালিক। তার কারণে প্রতিষ্ঠানটির ১৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। গ্রুপিংয়ে জড়িয়ে পড়েছেন। এ নিয়ে সমাজসেবা অধিপ্তরেও অভিযোগ গেছে পাল্টাপাল্টি।

সূত্র মতে, এই প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি হলেন রাজশাহীর পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। সম্প্রতি সভাপতি হিসেবে তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু গত বছরের মাঝামাঝি সময়ের দিকে দুটি সভা করে তিনি আর কোনো সভাতে উপস্থিত হননি।

জানতে চাইলে পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহাদত হোসেন বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটির উপ-প্রকল্প পরিচালক সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ করেন। কিন্তু সেখানে আমি নানা অবব্যস্থাপনা লক্ষ্য করেছি। এমনকি শিশুদের জন্য ওষুধ কেনার নামেও ব্যাপক অনিয়ম দেখা দেখা গেছে। প্রয়োজনীয় ওষুধের বাইরে বিপুল পরিমাণ এন্টিবায়েটিক কিনে ভরে দেওয়া হয়েছে। আমি এসব বিষয়ে ধরেছি। রেজুলেশনেও উল্লেখ করেছি। কিন্তু অব্যবস্থাপনার কারণে দুটি সভার পরে আর সভা করা হয়নি। তবে এসব আর ছাড় দেওয়া হবে না।’

জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির উপ-প্রকল্প পরিচালক নুরুল আলম প্রধান বলেন, ‘একটি প্রতিষ্ঠানটি চালাতে গেলে কিছু সমস্যা থাকবেই। তবে আমরা এই প্রতিষ্ঠানটিকে অনেকটা স্বচ্ছতার মধ্যে চালানোর চেষ্টা করি। তার পরেও হয়তো কিছুটা সমস্যা আছে। এগুলো আমরা কাটিয়ে উঠবো।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, এখানে কোনো অনিয়ম হয় না। তবে আমার পেছনে কিছু লোক লেগে আছে। তারা হয়তো ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। আমি কোনো সম্পদ গড়ে তুলেনি। খাবারের কেনাকাটা হয় ঠিকাদারের মাধ্যমে। এখানে আমার দুর্নীতির কোনো সুযোগ নাই।’

আরকে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যারা ছুটিতে আছে, তারা দীর্ঘদিন ধরে কেন আসেনি সেটি খোঁজ নিয়ে দেখা হবে। তবে শিশুদের নির্যাতনের কারণে একজন গার্ডকে মুচলেকা নিয়ে রাখা হয়েছে। এর বাইরে কোনো অনিয়ম হয়নি।’

স/আর