রাজশাহীর চিকিৎসা জগতে একজন গোলাম মাওলার ঘাটতি পড়েছ বেশ

রাজশাহীর রাস্তায় চলেছে একটি গাড়ি। ভস্কওয়াগান কোম্পানির। বাচ্চারা এটাকে বলতো ব্যাঙ গাড়ি। এটি যখন যেতো তার শব্দটা হতো অনেকটা শ্যালো ইঞ্জিনের মতো। তবে অতটা তীব্র না। আশির দশকে রাজশাহীতে এমন অ্যান্টিক গাড়ি চালাতেন এই ভদ্রলোক। ফর্সা লম্বা তবে কেশ বিরল। তিনি কিছুটা সামনে ঝুকে গাড়ি চালাতেন। ছোট চোখে ছিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। ইনি ডাক্তার গোলাম মওলা। পুরো নাম গোলাম মওলা চৌধুরী। সার্জারির এই প্রফেসরের ক্লিনিক ছিল তার লক্ষ্মীপুর এলাকার বাড়িতে। বাড়ির নিচ তলায় তার ক্লিনিক। ক্লিনিকের নাম নিস্কৃতি। মানুষের অসাধারণ আস্থা ছিল তার ওপর।

সকল শ্রেনির মানুষের মাঝে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন। গ্রামের সাধারণ মানুষও তার কাছে সব কিছু খুলে বলতে স্বস্থি পেতে। তার ক্লিনিকটি ছিল ভিন্ন ধাঁচের। বাড়ির সামনে একটা বারান্দা। সেটি পেরিয়ে বসার জায়গা। তার বাকি অর্ধেক রোগিদের থাকার জায়গা। সেটা পেরিয়ে ডাক্তার সাহেবের চেম্বার। তার সামনে একটা বড় টেবিল। সামনে দুটি চেয়ার। পূর্ব দিকে একটি চেয়ার। পশ্চিমে রোগী দেখার একটি বিছানা। বেশ উঁচু।একটা টুলের ওপর উঠে তাতে উঠতে হতো।

এ চেম্বারে সকল আসবাবপত্র পুরাতন আমলের সাধারণ মানের। এই অতি সাধারণ চেম্বারে বসতেন এই অসাধারণ ডাক্তার। ডাক্তার বিধান রায়কে বলা হয় ধন্বন্তরী। সেই অভিধা তাকে দেয়া যায় অনায়াসে। রোগির চেহারা দেখে বাইরে থেকে নাড়ি টিপে প্রথমে বলে দিতেন কি হয়েছে। পরে নিশ্চিত হওয়ার জন্য টেস্টের জন্য পাঠাতেন রাস্তার উল্টো দিকে রাজ প্যাথলজীতে। এক্সরের জন্যেও সেখানে। সপ্তায় দুই দিন ওটি হতো। ওটি বা অপারেশান থিয়েটারটি ছিল তার বসার জায়গার পেছনে ছোট্ট একটা রুমে। তার ওটির অ্যাসিস্টেন্ট ছিলেন ‘রাহেলা’ নামের এক সহযোগি।

আর থাকতেন এক অজ্ঞানের ডাক্তার। হালকা গড়নের এই ডাক্তার ছিলেন তার দীর্ঘ দিনের সহযোগি। এই ক্লিনিকে তার আর দুজন সহযোগি ছিলেন যারা রোগিদের দেখা শোনা করতেন। ছোট খাটো গড়নের এই দুজন সব সময় ফুট ফরমায়েশ খাটতো। ক্লিনিকের ভেতরে একটা বড় ঘরে সাধারণত পুরুষ রোগিদের রাখা হতো। ভেতরে একটা রুম ছিল কেবিন। সাধারণত এই কেবিন ফাঁকা পাওয়া যেতো না। এই ক্লিনিকের পেছনের দিকে গ্রিল ঘেরা জায়গাতে রাখা হতো দেশী জাতের ছাগল।

এর বাচ্চাগুলোকে ফিডারে দুধ খাওয়াতেন এই দুইজন। ডাক্তার সাহেব সাধারণত সকালের দিকে যেতেন লক্ষ্মীপুর বাজারে তাদের একজন থাকতো বাজারে ঝোলা ধরে। বাজারে তিনি আসলে সব বিক্রেতারা উঠে দাড়িয়ে সম্মান দেখাতো। সবার সাথে কথা বলতেন। এটা বিরল একটা ঘটনা। ডা. গোলাম মওলা সম্ভবত সময়ের আগেই অবসরে যান। তারপরে তিনি সেবা দিয়ে গেছেন তার ক্লিনিকে। অবসরে যাওয়ার পরে একবারাই তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাথে ছাত্র শিবিরের সংঘর্ষের পরে অনেক ছাত্র আহত হন।

সে সময় রাকসু ভিপি রাগিব আহসান মুন্নার অনুরোধে তিনি সেখানে যান। সব আহত ছাত্রের অপারেশানসহ চিকিৎসা নিশ্চিত করে তিনি হাসপাতাল ত্যাগ করেন। তার ক্লিনিকে যেদিন অপারেশান হয় সে রাতে তিনি রোগিদের দেখতে আসতেন। গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে লঙ্গি ঠিক করতে করতে তিনি রোগির অবস্থা দেখতেন। তিনি আসতেন ওটির পাশের একটি সিঁড়ি দিয়ে। তিনি থাকতেন এই ভবনের দোতালায়। রোগির নাড়ি দেখে। স্যলাইনের অবস্থা দেখে তিনি আবার যেতেন ঘুমাতে। তার অপারেশানের পরে কোনো গজ-ব্যান্ডেজ ব্যবহার করতেন না। একাটা গামছা দিয়ে বাধা হতো অপারেশানর স্থান।

ভেতরের ক্ষতের ওপর তুলা লিওকোপ্লাস্টের ওপর বাধা থাকতো এই গামছা। অপারেশানের একদিন পরে সব রোগিকে বলা হতো হাটতে। তার বাড়ির বাইরের প্যসেজে হাঁটা ছিল বাধ্যতামূলক। তার কথায় রোগি তাড়াতাড়ি সেরে বাড়ি যেতে চাইলে হাঁটতে হবে। আমার বড় চাচা হাবিবুর রহমানের ফুসফুসে পানি জমে। সব পরিক্ষা নিরিক্ষার পরে তার ফুসফুসের পানি বের করার সিদ্ধান্ত হয়। সিরিঞ্জ দিয়ে পানি বের করা হয়। সে রাতে দেখা শোনার জন্য আমি ছিলাম। রাতে অন্য রোগিদের সাথে চাচাকেও দেখে গেলেন গভীর রাতে ঘুম ভেঙে। পর দিন তার চেম্বারে ক্ষতের জায়গায় অনেক টেপাটিপি করে বের করলেন পানি।

এ সময় চাচা চেচামেচি করায় দিলেন ধমক। কাজ শেষে বললেন এ টুকু কস্ট করার কারনে অবস করতে হলো না। শরিরের অনেক ক্ষতি বাঁচলো। আমার ফিস্টুলা জনিত সমস্যার কারনে তার কাছে গেলাম। সাথে বন্ধু কেতন। তার চেম্বারের পর্দা টেনে ডাকলেন রাহেলা। হুকুম ‘ল্যাম্প আনো’। বন্ধুর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন কে হয়? বললাম বন্ধু। বন্ধুর সামনে সমস্যা নাই। আমার দিকে তাকিয়ে হুকুম দিলেন ‘প্যান্ট খোলো’।

সব সময় মগ্ন থাকতেন নিজের কাজে। সময়ে মৃদু স্বরে আবার প্রয়োজনে চড়া স্বরে কথায় সবাই থাকতো তটস্থ। চিকিৎসায় যখন করপোরেট কেতা আসলো। তখন তার বিরুদ্ধে চলে অনেক প্রচারণা। তখন নগরীতে অনেক বড় বড় ক্লিনিক হয়ে গেছে। সেখানে রোগি টানার বিষয় ছিল। তার পরেও তার প্রতি মানুষের ছিল অগাধ আস্থা। তার এই ক্লিনিকে রোগির অপারেশানের পরে ইনফেকশানের কথা শোনা যায় নি। তিনি সার্জারির ডাক্তার তার পরেও অনেক সাধারণ রোগি জ্বর জ¦ালা নিয়ে তার কাছে যেতেন। শুধু আস্থার কারনে। ডা. গোলাম মওলার বিষয়ে সার্চ দিয়ে কোনো কিছুই পাওয়া গেল না।

তার স্মৃতি ধরে রাখার জন্য রাজশাহীতে কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে নি। এই কিংবদন্তি চিকিৎসক রাজশাহীতে হাজার হাজার মানুষের সেবা দিয়েছেন। সেটা কম খরচে। তার সে কাজের ধারাবাহিকতায় রাজশাহীতে একটা হাসপাতাল হতে পারে। যেখানে করপোরেট চিকিৎসার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া যেতে পারে। সেখানে কম খরচে চিকিৎসা দেয়া যেতে পারে আস্থার সাথে।