রাজশাহীর গাঙপাড়া বসতি উচ্ছেদ, শীতে চারজনের মৃত্যু

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহীর গাঙপাড়া খালের দুই পাড়ে বসতি গড়েছিলেন প্রায় ২৩০টি পরিবার। কিন্তু সহায়-সম্বলহীন দিনমজুর এসব মানুষের এই আশ্রয়টুকুও গত গত ২২ ডিসেম্বর উচ্ছেদ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। কোনো রকম নোটিশ ছাড়ায় তাদের এসব বসতি উচ্ছেদ করা হয়েছিল।

তীব্র শীতের মধ্যে চালানো এই উচ্ছেদের সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা বাধা প্রদান করেছিলেন। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। এমি চলে যাওয়ার পর সব বাড়ি-ঘর উচ্ছেদ করা হয়। উচ্ছেদের কারণে এখন তীব্র শীতে চরম মানবেতর জীবনযাপন করছেন নগরীর গাঙপাড়া এলাকার সেই বসতির প্রায় দুই হাজার মানুষ। এর মধ্যে তীব্র শিতে মারা গেছেন ৪ জন। সর্বশেষ গতকাল আব্দুর রাজ্জাক (৬০) নামের আরেক ব্যক্তির মৃত্যু হয় তীব্র শীতের কারণে।

উচ্ছেদ হওয়া বসতিবাসী জানান, ঘর ভেঙে দেয়ার পর কেউ কেউ পাশের কারও জমিতে কিংবা কারও বাড়ির বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছেন। উদ্বাস্তু হয়ে কেউ কেউ নিয়েছেন বাড়ি ভাড়া। তবে এখনও অনেক মানুষ ভেঙে দেয়া বাড়ির ভিটায় টিনের অস্থায়ী একটা ঘর তুলে বসবাসের চেষ্টা করছেন। একটা ঘরেই গবাদিপশুর সঙ্গে থাকছেন তারা। বন্ধ হয়ে গেছে শিশুদের পড়াশোনা। নিদারুণ কষ্টে আছেন তারা। গতকাল বুধবার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় বসতির বাসিন্দা ফিরোজা বিবির (৪০) সাথে। ঘরবাড়ি ভেঙে দেয়ার পর ওই ভিটাতেই টিন দিয়ে ছোট্ট একটা ঘর বানিয়েছেন তিনি। সে ঘরেই বৃদ্ধা মা সুরাতন বিবিকে (৭৫) নিয়ে থাকেন। ফিরোজা জানালেন, স্বামী মারা গেছেন ২৫ বছর আগে। তারপর ভাঙড়ি কুড়িয়ে সংসার চালান তিনি। ঋণ নিয়ে ইট দিয়ে দুটি ঘরও করেছিলেন। কিন্তু সেই ঋণ পরিশোধের আগেই তাঁকে ঘর হারাতে হয়েছে। এখন জমি কিনে কোথাও ঘর করার সামর্থ্য তার নেই।

আরকে বাসিন্দা মোফাজ্জল হোসেন জানালেন, খালের দুই পাড়ে প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দরিদ্র শ্রেণির লোকেরা প্রায় ৪২ বছর আগে বসতি গড়েন। পরিবার প্রায় ২৩০টি। মানুষের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। সবাই পড়েছেন চরম বিপাকে।
মোফাজ্জল বলেন, ‘বাড়ির সঙ্গে দর্জির দোকান ছিল। দর্জির কাজ করে সংসার চালতো বেশ ভালোই। কিন্তু বাড়ি ভেঙে দেয়ায় আশ্রয় নিয়েছি শ্বশুরবাড়ির বারান্দায়। দোকানও হারাতে হয়েছে। আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছি।’

তিনি জানান, কোনো রকম নোটিশ ছাড়াই এলাকার বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করা হয়। উচ্ছেদ শুরুর দিন স্থানীয় সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা বসতিতে যান। তিনি সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বসতিতে বসে থাকেন। এই শীতের মধ্যে উচ্ছেদ না করার জন্য তিনি কিছু দিন সময় চান। তিনি যতক্ষণ ছিলেন ততক্ষণ বাড়িঘর ভাঙা হয়নি। কিন্তু ফিরে আসার পরই চলতে থাকে ড্রেজার। মূহুর্তেই ভেঙে ফেলা হয় সবার ঘর।

বসতি উচ্ছেদের পর রিকশাচালক তৌফিক আলী আশ্রয় নিয়েছেন পাশের এক আমবাগানে। সেখানে তৌফিকসহ পাঁচটি পরিবার রয়েছে। সবাই টিন দিয়ে অস্থায়ীভাবে দু’একটি ঘর করেছেন। তৌফিক বলেন, একটা ঘরেই তিন মেয়ে, এক ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকতে হচ্ছে। জমিওয়ালা এখান থেকেও চলে যাওয়ার জন্য এক মাস সময় দিয়েছেন। পরিবার নিয়ে এখন যাব কোথায়!
বসতির বাসিন্দা আবদুস সোবহান একজন দিনমজুর। বাড়ি ভেঙে দেয়ার পর তিনিও পাশের এক ব্যক্তির জমিতে টিন দিয়ে একটা ঘর করেছেন। ঘরে ঢুকে দেখা যায় দুটি চৌকি। এক ঘরেই থাকেন সোবহানের ছেলে, মেয়ে ও স্ত্রী। থাকে গরু এবং ছাগলও। তার ভেতরেই রান্না করছিলেন স্ত্রী শাহিদা বেগম। তিনি বলেন, এই শীতের ভেতর কী যে কষ্টে পড়েছি তা বলে বোঝানো যাবে না।

এভাবে পুরো বসতির মানুষই ঘরবাড়ি হারিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন। এলাকার লোকজন জানালেন, ঘরবাড়ি উচ্ছেদ করে দেয়ার পর টেনশনে এবং শীতজনিত রোগে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এই গত এক মাসে আব্দুর রাজ্জাক, আবদুস সালাম, সুফিয়া বেগম ও সায়েরা বেগম নামে চারজন নারী-পুরুষ শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আর উচ্ছেদের কথাবার্তা যখন চলছিল তখন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান উম্মত আলী নামের আরেক ব্যক্তি। শীতে মারা যাওয়া সুফিয়া নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতেন। সালামের স্ত্রী লতিফা বিবি বলেন, ঘর হারানোর পর স্বামীকেও হারালাম। এখন অন্যের বাড়ির রান্নাঘরে আশ্রয় নিয়েছি। জীবনে এতো কঠিন সময় আসবে ভাবিনি।

এদিকে বসতি রক্ষার জন্য এমপি ফজলে হোসেন বাদশা যখন সেখানে অবস্থান করছিলেন, তখন মাসুদ রানা নামের সাম্যবাদী দলের বহিষ্কৃত এক নেতা তাকে ফোন করে এলাকা এলাকা থেকে চলে যেতে বলেন। আর তা না হলে ‘প্রাণ থাকবে না’ বলে হুমকি দেন। এ নিয়ে মাসুদ রানার বিরুদ্ধে দুটি সাধারণ ডায়েরি হয়েছে।

রাজশাহী-২ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, এই শীতের মধ্যে বসতি উচ্ছেদ না করার জন্য আমি অনুরোধ করেছিলাম। তার জন্য আমাকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়েছে। এখন উচ্ছেদের ফলে শীতে তিনজন মানুষ মারা গেলেন। এর দায় কে নেবে? অমানবিক এবং দায়িত্বহীন কাজে তিনজনের মৃত্যুর জন্য যারা উচ্ছেদ করেছেন আমি তাদের শাস্তি চাই।