রাজশাহীর এক বাড়ি মালিকের বাধা: থমকে আছে ১৮২ কোটি টাকার সড়ক নির্মাণকাজ

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহী নগরীর আলিফ লাম মীম ভাটা এলাকা থেকে একটি নতুন বাইপাশ নির্মাণ হচ্ছে শহরের ভিতর দিয়ে। রাজশাহী-নাটোর মহাসড়ক হয়ে রাজশাহী নওগাঁ মহাসড়ক সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটির ব্যয় হবে ১৮২ কোটি। এছাড়াও এই প্রকল্পের আওতায় রাজশাহীতে এই প্রথম একটি ফ্লাইওভারও নির্মাণ করা হবে। এরই মধ্যে ফ্লাইওভার নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্থর উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

গত ২২ ফেব্রয়ারি রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের জনসভায় যোগ দিতে এসে প্রধানমন্ত্রী ফ্লাইওভার নির্মাণকাজে ভিত্তিপ্রস্থর উদ্বোধন করেন। ফ্লাইওভার নির্মাণকাজ শুরুর দিকে। অপরদিকে সংযোগ সড়ক নির্মাণকাজেরও প্রায় ৬৭ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে; কিন্তু এতোকিছুর পরেও পুরো প্রকল্পটিই যেন থমকে আছে একটি বাড়ির কারণে।

নগরীর আলিফ লাম মীম ভাটা এলাকার প্রয়াত আব্দুল মতিন নামের এক ব্যক্তির বাড়ির কারণে থমকে আছে প্রকল্পটির প্রায় শেষ অংশের কাজ।

আব্দুল মতিনের ওয়ারিশ তার স্ত্রী মাহমুদা বেগম, ছেলে নাহিদ বিল্লাহ ও মেয়ে ফাহমিদা বেগম তাদের বাড়ির ওপর দিয়ে রাস্তাটি নির্মাণ কাজের ওপর আপত্তি জানিয়ে উচ্চ আদালতে রিট করেছেন। এ কারণে উচ্চ আদালত থেকে সম্প্রতি ওই অংশ দিয়ে রাস্তা নির্মাণকাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ফলে বাড়ির পূর্বদিকে প্রায় সাত কিলোমিটার রাস্তার অধিকাংশ কাজ সম্পন্ন হলেও বাড়ির অংশের কাজ এখন আর করা যাচ্ছে না। এর ফলে থমকে আছে সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি। এ নিয়ে নগরবাসীর মাঝে চরম ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের উদাসীনতার কারণেই বাড়ি মালিকের দায়েরকৃত রিট পিটিশনটি নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি হয়নি। এতো বড় একটি প্রকল্প মাত্র একজন ব্যক্তির আপত্তির কারণে থমকে থাকার বিষয়টি নিয়ে নগরবাসীর মাঝে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।

স্থানীয় এলাকাবাসীর দাবি, এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কারণে স্থানীয় কয়েক শ লোকের বাড়ি-ঘর ও জমি গেছে। যদিও ক্ষতিগ্রস্থ সবাই ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন। তার পরেও জমি-ভিটা হারিয়ে নগরবাসীর সুবিধার কথা বিবেচনা করে প্রকল্পটিতে বাধা দেননি অন্যরা। কিন্তু আলিফ লাম মীম ভাটা মালিকের ওয়ারিশরা সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করেন ওই প্রকল্পের বিপরীতে। এর ফলে এখন পুরো প্রকল্পটিই বাস্তবায়ন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হবে কিনা-তা নিয়ে শংসয় সৃষ্টি হয়েছে।


জানা গেছে, সাবেক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের সময়ে ২০১২ সালে এই প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৬০ ফিট প্রস্থের এই সংযোগ সড়কটি কাজ শেষ হলে নগরীর যানজট নিরসনে এবং শহরবাসীর চলাচলেও গতি আসবে। পাশাপাশি এই প্রথম ফ্লাইওভারের মুখ দেখবে রাজশাহীবাসী।

গতকাল বৃহস্পতিবার সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, আলিফ লাম মীম ভাটার (অনেক আগে সেখানে আলিফ লাম মীম ইটভাটা নামে ইটখোলা ছিল) পূর্বদিকে রাস্তার কাজের এখন শুধু কার্পেটিং করতে বাকি রয়েছে। ভাটা এলাকার সাথেই একটি নালা থাকায় সেখানে ব্রিজ নির্মাণকাজও চলছে। ফলে কার্পেটিং ছাড়া প্রায় সব কাজই শেষ হয়েছে। কিন্তুভাটা এলাকায় এসে থমকে আছে এ সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি।

ভাটা এলাকার পূর্বদিকের কলার জমি এবং পশ্চিম দিকে রয়েছে একটি বাড়ি। কলার জমি এবং বাড়ির মাঝখান দিয়ে বাকি অংশটুকুর কাজ করতে হবে এখন। কিন্তু এই অংশেরই মালিক হলেন আলিফ লাম মীম ভাটা মালিক আব্দুল মতিনের ওয়ারিশরা। তারাই উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করে ওই অংশের কাজ স্থগিত করে রেখেছেন। এতে করে রাস্তাটির অপর অংশ দিয়ে যান চলাচল শুরু হলেও ওই অংশের কাজ শেষ না হওয়ায় ভাটা এলাকার পূর্ব পাশে এসে যানবাহন চলাচল করছে গলির ভিতর দিয়ে।

স্থানীয় ছোট বনগ্রাম পশ্চিমপাড়া এলাকার বাসিন্দা আকবর আলী বলেন, ‘এই সংযোগ সড়কটির কারণে আমাকে বাড়িসহ ভিটা হারাতে হয়েছে; তবে ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়ে অন্যত্রবাড়ি করেছি। এভাবে অনেক ক্ষতিগ্রস্থ মানুষ রাজশাহ শহরের হাজার হাজার মানুষের কথা বিবেচনা করে কোনো আপত্তি তুলেনি। এই সংযোগ সড়কটি করতে জায়গা-জমি, বাড়ি-ঘর সব দিয়েছে। তবে একজন ব্যক্তির কারণে এখনো শেষ হচ্ছে না রাস্তাটির কাজ। এটি হতে দেওয়া যায় না। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে এককভাবে কেউ সুবিধা নিতে পারে না।’

আরেক ব্যক্তি মকবুল হোসেন বলেন, ‘এই সংযোগ সড়কটির নির্মাণকাজ শেষ হলে নগরীর শপুরা এলাকা থেকে চোদ্দপাই এলাকায় যেতে সময় লাগবে সর্বোচ্চ ১০ মিনিট; কিন্তু এখন মূল শহরের ভিতর দিয়ে চলাচল করতে সময় লাগে অন্তত ৪০ মিনিট। আবার রাস্তাটি হলে বাস-ট্রাক চলচল করবে এই সংযোগ সড়ক দিয়ে। তখন মূল শহরে চাপ কমবে। তবে একজন বাড়ি মালিকের কারণে এই সুবিধা কতদিন নাগাদ মানুষ পাবে-তা নিয়েই এখন সংশয় দেখা দিয়েছে।’

তবে বিষয়টি নিয়ে প্রয়াত আব্দুল মতিনের স্ত্রী মাহমুদা বেগমসহ অন্য ওয়ারিশদের সঙ্গে সঙ্গে এ নিয়ে যোগাযোগ করা হলে তাঁদের পাওয়া যায়নি।

জানতে চাইলে প্রকল্পটির পরিচালক ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম মোর্শেদ জানান, প্রকল্পটির মেয়াদ রয়েছে ২০১২ সাল থেকে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এর মধ্যেই কাজটি শেষ করতে হবে। আমরা অধিকাংশ কাজ শেষ করেও ফেলেছি। কিন্তু একজন বাড়ি মালিকের বাধার কারণে কাজটির বাকি অংশ শেষ করতে সময় লাগছে। ওই বাড়ির অংশে রাস্তার মাটি ফেলাসহ বিভিন্ন কাজ করা হয়নি। এর ফলে বাড়ির পূর্ব অংশের প্রায় পৌনে সাত কিলোমিটার কাজের অধিকাংশই শেষ হয়েছে। কিন্তু বাড়ির অংশে এখনো হাত দেওয়া যায়নি। এতে করে পুরো রাস্তাটির কার্পেটিংও থমকে আছে।

ওই কর্মকর্তা বলেন, আশা করছি দ্রুতই উচ্চ আদালত থেকে স্থগিত আদেশ প্রত্যাহার হয়ে যাবে। তখন ওই অংশের কাজও সম্পন্ন হবে।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারলে কিছু জটিলতা সৃষ্টি হবেই। তবে আশা করছি সময়মতো কাজটি আমরা শেষ করতে পারব।

স/আর