রাজশাহীতে পুকুরখেকোদের থাবায় রাতারাতি জলাশয় হচ্ছে ভিটা


নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহী নগরীর শিরোইল এলাকায় প্রায় দুই বিঘা আয়তনের একটি পুকুর রয়েছে। এলাকাবাসী পুকুরটিকে এখনো শতবর্ষী শিরোইল পুকুর হিসেবে চেনেন। বাপ-দাদার আমল থেকেই এই পুকুরটির পানি নানা কাজে ব্যবহার করে আসছেন স্থানীয়রা। পুকুর পাড়ের শিরোইল বিহারী কলোনীর বাসিন্দাদের এখনো অনেকেই এই পুকুরের পানিতে গোসল থেকে শুরু করে বাড়ির থালা-বাসন পরিস্কার করেন। কিন্তু সম্প্রতি হঠাৎ করে একদিন সকালে পুকুরের মধ্যে একটি সাইনবোর্ড দেখে এলাকাবাসী চোখ যেন ছানা-বোড়া হয়ে যায়। সাইনবোর্ডে লিখা এই জমির বায়না সূত্রে মালিক মাইনুল হোসেন, আনোয়ার ও শওকত আলী। জমির পরিমাণ ৪৯ একর। শ্রেণী ভিটা।

স্থানীয় বাসিন্দা জাবেদ আলী বলেন, ‘বাপ-দাদার আমল থেকে এই জমি পুকুর হিসেবে দেখে আসছি। এখন পুকুরের মধ্যে দেখি ভিটার সাইনবোর্ড। এটা হয় কিভাবে? তাহলে কি টাকা দিলে পদ্মা নদীকেও সড়কে পরিণত করা যাবে?’


সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজশাহী নগরীতে এভাবে রাতারাতি পুকুরের শ্রেণি পরিবর্তন করে ভিটাতে পরিণত করছে ভূমি অফিসের একটি চক্র। সাবেক একজ জেলা প্রশাসকের সময়ে কাঠা প্রতি ২ লাখ টাকা করে ভূমি অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ম্যানেজ করে পুকুর বা জলাশয়কে রাতারাতি ভিটাতে পরিণত করা হয়েছে। এখনো দুই-একটি পুকুর এভাবে শ্রেণি পরিবর্তন করছে ভূমি অফিসের সেই অসাধ্য চক্রটি।

ওইসব পুকুরগুলো ভরাট করে রাতারাতি সেকানে গড়ে উঠছে ভবন। অথচ উচ্চ আদালতের কড়া নির্দেশনা রয়েছে রাজশাহী নগরীতে কোনোভাবেই পুকুর-জলাশয় ভরাট করা যাবে না। কিন্তু সেই নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একের পর এক পুকুর ভরাট চলছেই নগরীতে। এর পেছনে বড় ভূমিকা রাখছেন স্থানীয় কাউন্সিলররা। কোনো কোনো কাউন্সিলর রীতিমতো পুকুর ভরাট করে সেই পুকুরের মধ্যে গড়ে তোলা আবাসন গড়ে তুলছেন। এর পর সিটি করপোরেশনের বরাদ্দ দিয়ে তাঁর সেই আবাসন এলাকায় পাকা রাস্তাও করছেন। এভাবে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন ওই কাউন্সিলররা। এসব নিয়ে এলাকাবাসীর মাঝে চরম ক্ষোভ দেখা দিচ্ছে। পুকুর খেকোদের বিরুদ্ধে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, জেলা প্রশাসক, পরিবেশ অধিপ্তর ও পুলিশের কাছে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়লেও কোনো লাভ হচ্ছে না। শক্তিশালী এ চক্রটির কাছে উল্টো নাস্তানুবাদ হতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।

সরেজমিন অনুসন্ধানে গেছে, রাজশাহী নগরীর নওদপাড়া এলাকায় প্রায় সাড়ে ৬ বিঘা আয়তনের একটি পুকুর বছর দুয়েক আগে ভরাট করেন স্থানীয় কাউন্সিলর শাহাদৎ হোসেন শাহু। এই কাউন্সিলর এবং তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের মামলাও চলছে। ওই পুকুরটি ভরাট করে তিনি সেখানে প্লট আকারে জমি বিক্রি করেছেন। বছর খানেক হলো সেই প্লটে ভবনও গড়ে উঠতে শুরু করেছে। ওই আবাসন এলাকায় যাতায়াতের জন্য সিটি করপোরেশনের বরাদ্দ দিয়ে শাহু রাস্তা করেছেন। প্রতি কাঠা জমি তিনি বিক্রি করেছেন ৩০-৪০ লাখ টাকা দরে। এতে কোটি কোটি হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। একইভাবে নগরীর শহীদ জিয়া শিশু পার্ক এলাকায় কলমি পুকুর নামে আরও একটি পুকুর ভরাট করে প্লট আকারে জমি বিক্রি করেন ওই কাউন্সিলর। এখানেও রাস্তা তৈরী করা হয়েছে সিটি করপোরেশনের অর্থে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কাউন্সিলর শাহাদৎ আলী শাহু বলেন, ‘কোনো পুকুর আমি ভরাট করিনি। ভিটা ভরাট করে সেখানে প্লট বিক্রি করা হয়েছে। আর আবাস এলাকায় তো রাস্তা দিতেই হবে। যেকানে সিটি করপোরেশনের রাস্তা আছে, সেখানে সিটি করপোরেশনের অর্থে কাজ করা হয়েছে।’

এদিকে নগরীর দায়রা পাক এলাকায় সাড়ে ৬ বিঘা আয়তনের একটি পুকুর ভরাট শুরু করেন হালিম উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি। খবর পেয়ে গত ২৬ মার্চ রাতেই নগরীর চন্দ্রিমা থানা পুলিশ গিয়ে পুকুর ভরাট কাজ বন্ধ করে দেয়।

বিষয়টি নিশ্চিত করে, চন্দ্রিমা থানার ওসি মাহবুব আলম বলেন, ‘উচ্চ আদালতের নির্দেশনা আছে নগরীতে কোনো পুকুর ভরাট করা যাবে না। সে কারণে খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওই কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে রাতেই।’

সরেজমিন অনুসন্ধানের দেখা গেছে, রাজশাহী নগরীর অধিকাংশ ওয়ার্ডেই এভাবে স্থানীয় কাউন্সিলরদের প্রত্যক্ষ মদদে পুকুর ভরাট করে হচ্ছে প্লট। এর সঙ্গে ভূমি অফিসের কিছু অশাধু কর্মকর্তা কর্মচারীরা জড়িত রয়েছেন। নগরীর ৫.৭.৩.১৫. ১৬.১৭.১৮.১৯.২১.২৫.২৬.২৭ নম্বর ওয়ার্ড ছাড়াও প্রায় সবগুলো ওয়ার্ডেই পুকুর ভরাটের মহোৎসব চলছে বা শেষ হয়েছে। কোনটা গোপনে  আবার কোনোটা প্রকাশ্যে। আগে ভরাট হওয়া পুকুর জলাশয়গুলোর শ্রেণী পরিবর্তন করতে কাঠাপ্রতি ২-৩ লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছেন ভূমি অফিসসহ সাবেক এক জেলা প্রশাসক।

এদিকে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অথোরাইজড কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘নগরীতে ব্যাবপক হারে পুকুর ভরাট হচ্ছে। এটি সত্যিই আশঙ্কাজনক। শ্রেণি ভিটা থাকলে, সেখানে আমাদের নকশার অনুমোদন দিতে তখন আর কোনো বাধা দেওয়ার কিছু থাকে না।’

জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, পুকুরের শ্রেণি পরিবর্তনের কোনো সুযোগ আমি দিব না। এই ধরনের ঘটনা ঘটে থাকলে অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’