রাজশাহীতে পথে পথে চাঁদার হাট চাঁদা, মহাসড়কেও অবৈধ যানের দাপট

নিজস্ব প্রতিবেদক:

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাতের ঘটনা। রাজশাহী নগরীর নওদাপাড়া আমচত্তর এলাকায় লাঠি হাতে নিয়ে ট্রাক থেকে চাঁদা তুলতে গিয়ে ট্রাকের ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান রাজশাহী ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের প্রচার সম্পাদক শামীম হোসেন। তারপরেও থামেনি সেখানে চাঁদা আদায়। প্রতিদিন ২৪ ঘন্টা ট্রাক শ্রমিকরা সেখানে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থেকে চাঁদা আদায়ে ব্যস্ত থাকেন। এই দৃশ্য শুধু নগরীর নওদাপাড়া আমচত্তরেই নয়, ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়ন, অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন, হিউম্যান হোলার শ্রমিক ইউনিয়ন, পৌর সভার নামে স্থানীয় মাস্তানরা জেলার বিভিন্ন স্থানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাস, ট্রাক, অটোরিকশা, ভুটভুটি, সিএনজি, হিউম্যান হোলারসহ সাইকেল আর মোটরসাইকেল বাদে সব ধরনের যানবাহন থেকেই সমানে চাঁদা আদায় করে যাচ্ছে। আর চাঁদা দিয়ে সমানে মহাসড়কের চলছে অবৈধ যান ভুটভুটি, সিএনজি, অটোরিকশা, হিউম্যান হোলারের মতো যানবাহন। এতে করে রাজশাহীর সড়কে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে প্রাণহানিসহ সড়ক দুর্ঘটনা।

অভিযোগ উঠেছে, পুলিশ প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এসব চাঁদা উঠছে রাস্তা থেকে। চাঁদার একটি ভাগও সংশ্লিষ্ট থানাসহ ট্রাফিক বিভাগের যাচ্ছে। ফলে পথে পথে যেন চাঁদার হাট বসেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজশাহী নগরী থেকে শুরু করে জেলার উপজেলা ও পৌর সদরের বাজারগুলোর বিভিন্ন পয়েন্টে পয়েন্টে দাঁড়িয়ে চাঁদাবাজরা এই চাঁদা উত্তোলন করে যাচ্ছে। সম্প্রতি বাঘা পৌর সদর এলাকার স্কুল শিক্ষার্থীদের বহনকারী পিকনিকের দুটি বাসে চাঁদা দাবিতে হামলা করে ভাঙচুর করে পৌর সভার শ্রমিকরা।

এসময় কয়েকজ শিক্ষক-শিক্ষার্থীও আহত হয়। এর বাইরেও রাস্তায় চাঁদা উত্তোলন নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ছোট-খাটো ঝামেলার খবর পাওয়া যায়। কিন্তু এই চাঁদা আদায় বন্ধ হচ্ছে না এখনো। এতে করে মহাসড়কেও বন্ধ হচ্ছে অবৈধ যান চলাচল। ফলে ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজশাহী থেকে নাটোর মহাসড়কের ছয়টি পয়েন্ট থেকে ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের নামে প্রতি ট্রাক থেকে ১৫০ টাকা করে আদায় করা হয়। আবার নাটোরের বাসপাশ মোড়ের একটি স্থানেই প্রতিটি ট্রাক থেকে আদায় হয় ১০০ টাকা করে। ফলে প্রতিদিন অন্তত ৮০ লাখ টাকা চাঁদা উত্তোলন হয় শুধু এই কয়েকটি পয়েন্টে। অথচ এই টাকার কোনো হিসেব জানেন না ট্রাক শ্রমিকরা। সব টাকাই চলে যায় রাজশাহী ও নাটোরের পরিবহণ শ্রমিক নেতাদের পকেটে।

গতকাল নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ৮-১০ জনের একটি দল লাঠি হাতে নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা পণ্যবাহী ট্রাকসহ বিভিন্ন ট্রাক থেকে ১০০ টাকা হারে চাঁদা আদায় করছে। জানতে চাইলে হোসেন আলী নামের একজন শ্রমিক বলেন, এই টাকা ইউনিয়নের ফান্ডে জমা হয়। এখন পর্যন্ত কতটাকা জমেছে জানতে চাইলে তিনি এর কোনো উত্তর দিতে পারেননি।

রাজশাহীর তালাইমারীতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ট্রাক প্রতি ৫০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে। এর বাইরে পুঠিয়াতে ৫০ টাকা এবং নাটোরে আদায় করা হয় ১০০ টাকা, নগরীর শিরোইলে বাফার সার গোডাউনের সামনে ৫০ টাকা এবং নওদাপাড়ায় আদায় হয় ৫০ টাকা করে।

এদিকে নগরীর রেলগেটে সিএনজি চালকদের নিকট থেকে ১০০ টাকা, কোর্ট এলাকায় হিউম্যান হোলার থেকে ১০০ টাকা, কাটাখালিতে অটোরিকশা থেকে ১০ টাকা, দুর্গাপুরে বাস ট্রাক থেকে পৌর সভার নামে ১০-৫০ টাকা, পুঠিয়াতে ১০-৫০ টাকা, আড়ানী ও বাঘায় ১০-৫০ টাকা, ভবানিগঞ্জে ১০-১২ টাকা, তাহেরপুরে ১০-১০০ টাকা, মোহনপুরে ১০-২০ টাকা, তানোরে ১০-৫০ টাকা, গোদাগাড়ীতে ১০-২০ টাকা ও চারঘাটে ১০-২০ টাকা হারে বিভিন্ন যানবাহন থেকে চাঁদা আদায় হচ্ছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা পণ্যবাহী ট্রাকের চালক আলমাস আলী বলেন, ‘আমার পণ্যবাহী ট্রাক যাবে ঢাকায়। কিন্তু রাজশাহী ট্রাক টার্মিনালের নামে চাঁদা দিতে হলো ৫০ টাকা। এর বাইরে ট্রাক শ্রমিকদের নামে দিতে হলো আরো ৫০ টাকা। সবমিলিয়ে দুটি স্লিপে এই টাকা আদায় করা হলো।’

আরেক ট্রাক চালক নাজমুল হোসেন বলেন, ‘টাকা না দিতে চাইলেই লাঠি দিয়ে ট্রাকে আঘাত বা চালক এবং হেলপারকে ধরে মারতে শুরু করে। ফলে বাধ্য হয়ে টাকা দিতেই হয়।’

ভুটভুটি চালক আজিবুর রহমান বলেন, আমরা পেটের দায়ে কখনো কখনো ভুটভুটিতে গরুসহ বিভিন্ন পণ্য নিয়ে মহাসড়কে উঠি। আর মহাসড়কে উঠলেই টাকা দিতে হয়। এই টাকা কাদের পকেটে যায় বলা মুশকিল। নিশ্চয় পুলিশের লোকজন টাকা খাই। টাকা না দিলে তখন রাস্তা গাড়ি চলতে দেয় না।’

ট্রাক শ্রমিক বুলবুল হোসেন বলেন, ‘টাকা যায় বিভিন্ন থানা এবং ট্রাফিক পুলিশের কাছেও। রাজশাহীর ট্রাফিক পুলিশ তো রাস্তায় অৎ পেতে থাকে। গাড়ী থামালেই টাকা দিতে হয়। টাকা না দিলেই বিপদ। হয় মামলা না হয় টাকা। আবার ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামেও আদায় হয় চাঁদা। এতো চাঁদা দিতে গিয়ে পণ্যবাহী ট্রাক চালানোয় দায় হয়ে পড়েছে।

আরেক ট্রাক চালক মাজেদ বলেন, রাজশাহীতে সবচেয়ে ট্রাক থেকে চাঁদা উত্তোলনের হার বেশি। মালিক-শ্রমিক ও পরিবহণ শ্রমিক ইউনিয়নের নামে ছাড়াও ট্রাক টার্মিনালের নামে প্রতিটি ট্রাক থেকে দেড় শ টাকা আদায় করা হয়। কিন্তু এই টাকার কোনো হিসেব নাই।

অন্যদিকে ভুটভুটি থেকে চাঁদা করতে দেখা যায় নগরীর নওদাপাড়া আমচত্তর ও বড় বনগ্রাম এলাকায়। রাস্তার ধারে লাঠি হাতে নিয়ে কয়েকজন লোক অবৈধ যান ভুটভুটি থেকে প্রতিদিন চাঁদা আদায় করে পুলিশের সামনেই। ভুটভুটি প্রতি ২০ টাকা হারে চাঁদা নিয়ে মহাসড়কে চলতে দেওয়া হয়। টাকা না দিলেই ভুটভুটি চাবি কেড়ে নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। এভাবে করে সপ্তাহের দুইদিন শত শত ভুটভুটির লাইন ধরে নগরীর সিটি বাইপাশ গরুর হাটে।

রাস্তায় চাঁদা আদায় সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজশাহী ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ফরিদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের টাকা ব্যয় হয় মালিক-শ্রমিকদের কল্যাণেই। কিন্তু আমাদের বাইরেও রাস্তায় নেমে জোর করে টাকা আদায় হয় ট্রাক থেকে। এই টাকার কোনো হিসেব নাই।’

রাজশাহী মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের আহ্বায়ক কামাল হোসেন রবি বলেন, অধিকাংশ টাকায় উত্তোলন হয় ট্রাক মালিক-শ্রমিকের নামে। শুধুমাত্র ৫০ টাকা করে উত্তোলন হয় ট্রাক টার্মিনালের নামে। তাও যেসব ট্রাক রাজশাহীর বাইরে থেকে আসে, কেবল সেগুলো থেকেই আমরা চাঁদা তুলি। রাজশাহীর ট্রাক চালকরা চাঁদা দিতে চান না।’
ট্রাক টার্মিনালের বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চাঁদা উত্তোলন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি আমরা করতে পারি।’

এদিকে রাস্তায় অবৈধ যান থেকে চাঁদা আদায়ের বিষয়টি স্বীকার করলেও পুলিশ এর সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা নাই বলে দাবি করেন রাজশাহী মাহনগর পুলিশের মুখপাত্র ইফতে খায়ের আলম। তিনি বলেন, তার পরেও কারো বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ এলে আমরা ব্যবস্থা নিব।’