রাজশাহীতে কৃষকের সার নিয়ে গুদাম কর্মকর্তার বাণিজ্য, বাজারে অতিরিক্ত মূল্য

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহীতে কৃষকের সার নিয়ে ব্যাপক বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। জিম্মি ডিলাররা সার বিত্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন গুদামেই। সেই সার চলে যাচ্ছে অন্য জেলায়। এরপর সেগুলো বিক্রি হচ্ছে বেশি দামে। বিশেষ করে কাফকো ইউরিয়া সার নিয়ে চলছে এ বাণিজ্য বেশি হারে। রাজশাহীর বাফার গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শামীম আক্তার ও বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার এসোসিয়েশনের রাজশাহী জেলা সাধারণ সম্পাদক ও বিসিআইসি’র সার ডিলার রবিউল ইসলাম এ বাণিজ্যে জড়িত বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এর ফলে প্রতি মাসে সরকারিভাবে বরাদ্দ পাওয়া কৃষকের ইউরিয়া সার বাণিজ্য করে তাঁরা লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। আর এ বাণিজ্যের কারণে কৃষকপর্যায়ে এক বস্তা ইউরিয়া সার বিক্রি হচ্ছে ৮২০-৮৫০ টাকা দামে। যেটি সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা দরে বিক্রি করার কথা বলা হয়েছে। গুদাম কর্মকর্তার বাণিজ্যের কারণে ডিলাররা ইউরিয়া সার ঠিকমতো উত্তোলন না করায় বাজারে তৈরী হচ্ছে কৃতিম সঙ্কট। এই অবস্থায় রাজশাহীর বাজারে বিসিআইসির নরমাল ইউরিয়ায়ও ৮১০-৮২০ টাকা বস্তা দরে বিক্রি হচ্ছে। ফলে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে কৃষকদের।

এদিকে গোডাউন কর্মকর্তা ও ডিলার নেতার এসব অনিয়ম নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ক্যামিকেল ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান (বিসিআইসি), দুদক, রাজশাহী জেলা প্রশাসক থেকে শুরু করে বিভিন্ন দপ্তরে একাধিক বার লিখিত অভিযোগও করেছেন ডিলাররা। এ নিয়ে তদন্তের পরে রাজশাহীর বাফার গোডাউনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শামীম আক্তারকে সম্প্রতি ঢাকায় ৩৪ বাফার গুদাম প্রকল্পে বদলি করা হয়। কিন্তু অদ্যবধি ক্ষমতার জোরে টিকে রয়েছেন এ কর্মকর্তা। এ নিয়ে চরম ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের সার ডিলারদের মাঝে।

সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবঞ্জ মিলে ১৭৫ জন ডিলারের আওতায় উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তর থেকে ইউরিয়া সার বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই সার বরাদ্দ পাওয়ার পরে সরকারি কোষাগারে নির্ধারিত মূল্য জমা দেন ডিলাররা। এরপর সেই সার রাজশাহীর বাফার গুদাম থেকে সংগ্রহ করতে হয় ডিলারদের।

ডিলাররা সেই সার তাঁদের নিজ নিজ এলাকায় নিয়ে গিয়ে কৃষকদের মাঝে ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করে থাকেন।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ডিলাররা যখন রাজশাহী বাফার গুদাম থেকে ইউরিয়া সার সংগ্র করতে যান, তখন সেখানকার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শামীম আক্তার নিজ ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে ইচ্ছেমতো তাঁর পছন্দের ডিলারদের কাফকো ইউরিয়া সরবরাহ করেন। আর যেসব ডিলার তাঁকে টাকা দেন না, তাদের দেওয়া হয় নরমাল ইউরিয়া। এতে করে কোনো কোনো ডিলার ১০ টন ইউরিয়া বরাদ্দ পেলেও তাকে সম্পূর্ণটাই দেওয়া হয় কাফকো ইউরিয়া সার। আবার কাউকে দেওয়া হয় ১-৩ টন কাফকো। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার এই ক্ষমতার অপব্যাহারের সুযোগ গ্রহণ করছেন রাজশাহীর বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার এসোসিয়েশনের রাজশাহী শাখার সাধারণ সম্পাদক রবিউল ইসলাম। তিনি ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শামীম আক্তারের সঙ্গে যোগসাজস করে ৬০-৬৫ জন ডিলারের বরাদ্দকৃত ইউরিয়া সারের বরাদ্দপত্র কিনে নিয়ে ওই বরাদ্দপত্রের বিপরীতে অধিকাংশই কাফকো সার উত্তোলন করছেন গুদাম থেকে।

এরপর সেই সার তিনি রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাইরের জেলাগুলো বা উপজেলা পর্যায়ের ডিলারদের কাছে অতিরিক্ত মুল্যে বিক্রি করছেন। এরপর সেই ডিলাররা কৃষকদের নিকটও উচ্চেমূল্যে কাফকো ইউরিয়া বিক্রি করছেন। এভাবে কাফকো ইউরিয়া সার নিয়ে রাজশাহীর গুদাম কর্মকর্তা ও ডিলার নেতা রবিউল ইসলাম প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য করে যাচ্ছেন বলেও ওই অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।

ওই অভিযোগগুলোতে আরো উল্লেখ করা হয়, গত জানুয়ারি-মার্চ মাস পর্যন্ত রাজশাহীর ডিলারদের কাছে ১৬ মেট্রিক টন করে কাফকো সার সরবরাহ করা হয় গুদাম থেকে। সেই হিসেবে ১৭৫ জন ডিলারের মাঝে সর্বোচ্চ দুই হাজার ৮০০ মেট্রিক টন কাফকো সার সরবরাহ করা হয় গুদাম থেকে। কিন্তু গুদাম কর্মকর্তার যোগসাজসে ওই তিন মাসে অন্তত ১১ হাজার মেট্রিক টন কাফকো সার উত্তোলনের প্রতিবেদন দাখিল করা হয় বিসিআইসিকে।

রাজশাহীর একজন সার ডিলার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কাফকো সারের চাহিদা কৃষক পর্যায়ে বেশি। এ কারণে ডিলাররা সেই সারই উত্তোলন করতে চান বেশি পরিমাণে। কিন্তু ডিলার নেতা রবিউলের যোগসাজসে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শামীম আক্তার নিজ ক্ষমতা বলে তাঁর পছন্দের ডিলারদের সেই সার বিতরণ করেন। ফলে অনেক ডিলার বাধ্য হয়ে বরাদ্দপত্রই বিক্রি করে দিচ্ছেন রবিউলের কাছে। আর সেই বরাদ্দপত্র নিয়ে রবিউল তার ম্যানেজার রিপনের মাধ্যমে গুদাম থেকে বেশি পরিমাণে কাফকো সার উত্তোলন করে বাইরে বিক্রি করে দিচ্ছেন বেশি দামে। ফলে ওই সার সরকারি নির্ধারিত মূল্য সর্বোচ্চ ৮০০ টাকার চেয়েও বেশি দামে ৮৫০ টাক পর্যন্ত দরে বিক্রি হচ্ছে কৃষকদের কাছে। এ নিয়ে বার বার অভিযোগ করেছি আমরা। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। বরং বদলি হওয়ার পরেও নিজের ক্ষমতার জোরে একই কর্মস্থলে থেকে একই বাণিজ্য করে চলেছেন গুদাম কর্মকর্তা শামীম আক্তার।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের একজন ডিলার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘রাজশাহীর ডিলার নেতা রবিউল ইসলাম ও গুদাম কর্মকর্তা শামীম আক্তারের কাছে আমরা জিম্মি। আমরা সার নিতে গেলেই ১-২ টনের বেশি কাফকো সার দেওয়া হয় না। কিন্তু রবিউলের কাছে বরাদ্দপত্র বিক্রি করে দিলে তাকে ঠিকই অধিকাংশ পরিমাণ কাফকো সারই দেওয়া হয়। এ কারণে কোনো কোনো ডিলাররা নরমাল ইউরিয়া উত্তোলন না করে বরাদ্দ বিক্রি করে দিচ্ছেন রবিউলের কাছে। ফলে বাজারে সারের কৃতিম সঙ্কটও তৈরী হয় কখনো কখনো।’

রাজশাহীর বাফার গুদাম থেকে সরবরাহকৃত সারের চালানপত্রের মধ্যে একই দিনে একাধিক চালানে ডিলার রবিউল ইসলামের প্রতিনিধি (ম্যানেজার) রিপনের স্বাক্ষর দেখা গেছে। রবিউল ইসলামের নামেই ওইসব স্যার উত্তোলন করেছেন তার প্রতিনিধি রিপন। যেটি তিনি করতে পারেন না। আবার একই মাসে শত শত টন ইউরিয়াও উত্তোলন করেছেন এই রিপন। অভিযোগে সার কারসাজির সঙ্গে জড়িত হিসেবে রিপনের নামও উল্লেখ রয়েছে।

এদিকে গতকাল রাজশাহীর বানেশ্বরে ও দুর্গাপুরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ দুটি বাজারে কফকো ইউরিয়া বিক্রি হচ্ছে ৮৩০-৮৪০ টাকা দরে। আর বিসিআইসির নরমাল ইউরিয়া বিক্রি হচ্ছে ৮২০-৮৩০ টাকা দরে।
দুর্গাপুরের মাড়িয়া গ্রামের সোহাগ আলী বলেন, ‘তিনি দুই বস্তা কাফকো সার গতকাল কিনেছেন ৮৫০ টাকা বস্তা দরে। অথচ ৮০০ টাকার উপরে ডিলাররা ইউরিয়া সার বিক্রি করতে পারেন না। কিন্তু তদারকি না থাকায় অতিরিক্ত দামেই ডিলাররা সার বিক্রি করছেন।’

সিংগা গ্রামের চাষি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ইউরিয়া সার ৮২০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। সার কিনতে গেলেই ডিলাররা বলছেন বাড়তি দাম। এ কারণে দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে হরহামেশাই।‘

অন্যদিকে ডিলারদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৩ জুলাই রাজশাহীর গুদাম কর্মকর্তা শামীম আক্তারকে বদলি করা হলেও এখনো তিনি বহাল তবিয়তে রয়েছেন। ক্ষমতার জোরে নতুন বদলিকৃত স্থানে যোগদান করেননি গতকাল পর্যন্ত। এ নিয়ে রাজশাহীর গুদাম কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে সার নিয়ে বাণিজ্য প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার এসোসিয়েশনের রাজশাহী জেলা সাধারণ সম্পাদক ও বিসিআইসি’র সার ডিলার রবিউল ইসলাম বলেন, ‘আমার বরাদ্দপত্রের বাইরে আমি সার উত্তোলন করি না। যারা এসব অভিযোগ করেছেন, তারা মিথ্যে বলেছেন। আমার প্রতিনিধি হিসেবে রিপন গুদাম থেকে সার উত্তোলন করেন।’

জানতে চাইলে রাজশাহীর বাফার গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শামীম আক্তার বলেন, ‘এসব অভিযোগ ঠিক নয়। আমি কোনো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নয়। কোনো ডিলারের প্রতিনিধি হিসেবে যে কেউ সার উত্তোলন করতে পারে। কিন্তু একজন ডিলারের একজনই প্রতিনিধি থাকেন।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘একই ব্যক্তি কিভাবে একই মাসে একাধিক ডিলালের সার উত্তোলন করেছেন-তা বলতে পারব না। তবে কোনো অনিয়ম হয়নি। অভিযোগের তদন্ত হয়েছে। কিন্তু কোনো প্রমাণ কেউ পাননি।’

স/আর